গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি হবে

গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি করবে বাংলাদেশ ও ভারত। যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কমিশন এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রস্তুতি কমিটি করেছে। ওই কমিটির একটি সভাও হয়েছে। কমিটির মতামত অনুযায়ী, ভারতের নদী কমিশনকে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব করবে বাংলাদেশ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও ফারাক্কায়৩ থেকে ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছে যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম বৈঠক। এ বৈঠকে অংশ নিতে বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সোমবার (৩ মার্চ) সকালে ঢাকা ছেড়েছে।
ভারত সফরে যাওয়ার আগে মোহাম্মদ আবুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, এবারের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ১১টি এজেন্ডা রয়েছে। কিন্তু সেখানে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়টি নেই। কারণ এ বিষয়ে যৌথ নদী কমিশন আলাদা আলোচনা করবে।
'বাংলাদেশ ইতিমধ্যে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কমিটি জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মাথায় রেখে পরবর্তী চুক্তিটি করতে হবে।'
তিনি বলেন, পর্যালোচনা করার জন্য কমিটি একটি যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি করার সুপারিশ করেছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় পক্ষকে উভয় দেশের পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জানানো হয়েছে।
'ভারতও জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটি করার পক্ষে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ কমিটি গঠন করা হবে। এতে উভয় দেশ থেকে তিনজন করে সদস্য থাকবেন,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ফারাক্কায় গঙ্গার পানি প্রবাহ সরেজমিনে দেখবে এবং উজানে পানি প্রবাহের তথ্যও সংগ্রহ করবে বলে জানান মোহাম্মদ আবুল হোসেন।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি করেন।
এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গা নদীতে যে পানিপ্রবাহ তৈরি হয়, সেটি দুই দেশ ভাগ করে নেয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, ফারাক্কায় গঙ্গার পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত হলে দুই দেশ সমান সমান, অর্থাৎ মোট পানির ৫০ শতাংশ করে পাবে। আর পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেকের বেশি কিন্তু সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার কিউসেক পর্যন্ত হলে বাংলাদেশ পাবে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার কিউসেক পাবে, অবশিষ্ট পানি পাবে ভারত।
কিন্তু ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানির পরিমাণ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক রেখে বাকি পানি বাংলাদেশকে দিয়ে দেবে। এই পানি ভাগ হয় প্রতি ১০ দিনের পানির পরিমাণ হিসাব করে।
তবে চুক্তিতে শর্ত রয়েছে যে, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ ও ভারত ১০ দিন ১০ দিন করে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। অর্থাৎ ১১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে, তার পরের ১০ দিন ভারত গ্যারান্টিযুক্তভাবে ২৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। এভাবে ১০ মে পর্যন্ত চলতে থাকবে। এই সময়ে পানির প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সেজন্য উভয় দেশ প্রতি দশ দিনে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে চুক্তিতে এই শর্ত রেখেছে।
যৌথ নদী কমিশন সূত্রমতে, এই চুক্তি করা হয়েছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গঙ্গা নদীর পানির গড় প্রবাহ ধরে। এই চুক্তি অনুযায়ী গত ২৮ বছর ধরে বাংলাদেশ-ভারত পানি ভাগ করে আসছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৭ কিউসেক পানি পেয়েছে। আর এ সময়ে ভারত পেয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৮ কিউসেক পানি।
২০২৬ সালের ডিসেম্বরে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ২০২৪ সালে হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে দুই দেশ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনায় রাজি হয়েছে।
কিন্তু গত বছরের আগষ্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে আগের মত উষ্ণতা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দুই দেশের সরকার একে অপরকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে এ নিয়ে চুক্তি হয়নি।
বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা হবে
এবারের বৈঠকে ধরলা, দুধকুমার, গোমতী, খোয়াই, মনু ও মুহুরীসহ মোট ১৪টি নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তাব করবে। বাংলাদেশ চায় এসব নদীর পানি উভয় দেশ আন্তর্জাতিক পদ্ধতি মেনে ব্যবহার করুক।
মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে এসব নদীর পানি ব্যবহারের তথ্য আদান-প্রদান করা হয়েছে। ৮টি নদীর পানি বণ্টন চুক্তির জন্য পানি ব্যবহার-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হবে।
উজানের পানির চাপে বাংলাদেশে যেহেতু বন্যা হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে বন্যা পূর্বাভাস মডেল তৈরি করতে চায়। এবারের নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব দেওয়া হবে। এছাড়া সরাসরি তথ্য বিনিময় করার প্রস্তাবও থাকবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জয়েন্ট ফ্লাড ফোরকাস্টিং সিস্টেম দাঁড় করাতে চায়।
যৌথ নদীতে কোনো ধরনের খনন, বাঁধ নির্মাণ, ড্রেজিং সংক্রান্ত কার্যক্রম ও সংস্কার করতে হলে এক দেশ থেকে অন্য দেশের অনুমোদন নিতে হয়। গত বছরে বন্যায় বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নদীর বাঁধ সংস্কার ও ড্রেজিংয়ের উদ্দেশ্যে ৭৫টি জায়গায় কাজের অনুমোদন চাওয়া হবে কমিশনের বৈঠকে।
২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিলেটে কুশিয়ারা নদীর রহিমপুর খাল পয়েন্টে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে। একই পরিমাণ পানি ভারতেরও উত্তোলন করার কথা।
শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর বাংলাদেশ অংশে গড়ে ৫ হাজার ২৯৫ থেকে ১৭ হাজার ৬৫০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। চুক্তির ফলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদে সুবিধা হবে বলে আশা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ সেজন্য প্রয়োজনীয় পাম্পও স্থাপন করেছে।
ভারত ত্রিপুরার সাব্রুমের জনসাধারণের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ করতে এই নদী থেকে পানি নেবে। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ এখনও পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে চুক্তিটি কার্যকর হয়নি।
এবারের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ যাতে পানি উত্তোলন করতে পারে, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ আবুল হোসেন।