মহাসড়কে বাড়ছে ডাকাতি, জনমনে আতঙ্ক

দেশের মহাসড়কগুলোতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত ৫টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ব্যবসায়ী, প্রবাসী থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ফলে ক্রমবর্ধমান ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
যদিও পুলিশ বলছে, মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধে টহল জোরদার করার পাশাপাশি আসামিদের ডেটাবেজ তৈরিসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকার ফাল্গুনকড়ায় ডাকাতির শিকার হয়েছেন কুয়েত প্রবাসী নাইমুল এবং মালয়েশিয়া প্রবাসী বেলাল।
শনিবার ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চৌদ্দগ্রাম এলাকায় ডাকাতির শিকার হন ফেনীর দাগনভূঞা এলাকার প্রবাসী বেলাল আহমেদ। ঢাকা হতে বাড়ি যাওয়ার পথে চৌদ্দগ্রাম এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যান এসে তার প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয়। এতে রাস্তার পাশে ছিটকে যান তারা। এরপর তাদের গাড়ির গ্লাস ভেঙে ডাকাতি করা হয়।
দুইদিন আগে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে ভোরে ডাকাত চক্র হামলা চালিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে কুয়েত প্রবাসী নাইমুল ইসলামের সব মালামালসহ সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে।
শুক্রবার দিবাগত রাত ১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বেড়া-সাঁথিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে গাছ ফেলে অন্তত ১০টি গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতদের মারধরে অন্তত ৫ জনের আহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি দেলওয়ার হোসেন টিবিএসকে জানান, ৫ আগস্টে পর শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন পাওয়ায় চুরি, ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। এছাড়া, একটি গ্রুপ ক্রমাগত চেষ্টা করছে দেশকে অস্থিতিশীল করার।
মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সড়কে পুলিশের টহলের সময় সূচি পরিবর্তন, অপরাধীদের ডেটাবেজ তৈরিসহ তারা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। চলতি সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি বলেন, "গত পাঁচ বছরে মহসড়কে ডাকাতির ঘটনায় যাদের নাম এসেছে, তাদের ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এছাড়া, আমাদের টহল পুলিশের সময়সূচিতে পরিবর্তন এনেছি। বর্তমান সিডিউল অনুযায়ী, সকাল ৬টা পর্যন্ত একটি টিম থাকে। ৬টা থেকে অন্য টিম আসে। দুই টিমের আসা-যাওয়ার মাঝে ডাকাতরা সুযোগ নিচ্ছে। এই অবস্থায় আমরা নতুন করে শিডিউল করেছি, যেখানে ৭টার পর থেকে বাইরোটেশন হবে।"
"অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডাকাতরা প্রবাসীদের টার্গেট করছে। এজন্য প্রবাসীদের যাত্রা নিরাপদ করতে আমরা একটি অ্যাপস চালুর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যার মাধ্যেমে বিপদে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে হাইওয়ে পুলিশকে জানাতে পারবে ভুক্তভোগী," যোগ করেন তিনি।
ডাকাতির কবলে পোশাক কারখানা
ঢাকার আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় বন্ধ থাকা একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ডাকাতি ও মালামাল লুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় অবস্থিত ম্যাগপাই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ম্যাগপাই নিটওয়্যার লিমিটেডে এ ঘটনা ঘটে। গত বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে কারখানাটি বন্ধ রয়েছে।
ডাকাতির বিষয়টি নিশ্চিত করে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি, ঠিক কী ঘটেছিল সেটি আমরা তদন্ত করছি।"
তিনি বলেন, "তারা (ডাকাত) সংখ্যায় ৩০ থেকে ৩৫ জন ছিল। সিকিউরিটির লোকজন যেটি বলছে যে, রাত ৯টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত ছিল ডাকাতরা। কিন্তু এই পুরো সময়ে আমরা একটা কল পর্যন্ত পাইনি; এমনকি ৯৯৯ এও কেউ একটা কল করেনি।"
এদিকে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, শুক্রবার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি ডাকাতদল বন্ধ থাকা কারখানাটিতে প্রবেশ করে। কারখানাটিতে প্রবেশের পর ডাকাতরা কারখানার নিরাপত্তায় নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মীদের দেশীয় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে কারখানা থেকে পরিত্যাক্ত এসি, কম্পিউটার, বৈদ্যুতিক মোটর, দামি ক্যাবল, আইপিএস এর ব্যাটারিসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে একটি ট্রাকে তুলে ভোর রাত ৪টার দিকে কারখানা ত্যাগ করে।
ম্যাগপাই গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) কায়সার আলী খান বলেন, "সশস্ত্র ডাকাত দল রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে কারখানায় প্রবেশ করে। ডাকাতরা নিরাপত্তারক্ষীদের বন্দুকের মুখে তাদের বেঁধে ফেলে। পরে তারা কারখানা থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।"
"লুট হওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে ব্যাটারি, ইউপিএস সিস্টেম, কেবল, এয়ার কন্ডিশনার, মোটর, কম্পিউটার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ছিল—যার আনুমানিক মূল্য অন্তত ৮-১০ কোটি টাকা," যোগ করেন তিনি।
কায়সার জানান, এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে ম্যাগপাই গ্রুপ। যদিও গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি।
এদিকে, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া আরও বলেন, "আমরা এখনও তথ্য সংগ্রহ করছি, এবং স্থানীয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী উভয়ই তদন্তে কাজ করছে। খবর পাওয়া মাত্রই আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি এবং তদন্ত চলমান রয়েছে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া উচিত, নাহলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরেও দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।"
"আইনশৃঙ্খলা এখনও স্বাভাবিক হয়নি, যা বায়ারদের আস্থা ফিরে পাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ," যোগ করেন তিনি।
ডাকাতির ঘটনা
শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় ছেঁচানিয়া তলট ব্রিজের পাশে সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অন্তত ১৫-২০টি বাস ও ট্রাকে ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অন্তত ৫ জন আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
যদিও পাবনার ঘটনাটি অতিরঞ্জিতভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব আজাদ মজুমদার।
তিনি বলেন, "পাবনার সাথিয়ায় উপজেলার একটি এলাকায় গতরাতে গণ-ডাকাতি নিয়ে মিডিয়ায় যে রিপোর্ট হয়েছে, সেখানে অতিরঞ্জিত তথ্য উপস্থাপন হয়েছে।"
এ সময় তিনি বলেন, "কিছু মিডিয়ায় বলা হয়েছে ৪০টি গাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, আবার কিছু মিডিয়া বলা হয়েছে ১০টি গাড়ি ডাকাতি হয়েছে। যে মিডিয়ায় ১০টি গাড়ি ডাকাতির কথা বলা হয়েছে তাদের রিপোর্টে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় পাঁচটি গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা জেনেছি, এই ডাকাতির ঘটনা একটি মাইক্রোবাস, দুটি ট্রাক ও একটি মোটরসাইকেলে হয়েছে। পুলিশ বিষয়টি জেনে ঘটনাস্থলে ১০ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে।"
আজাদ মজুমদার বলেন, "আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, আমরা সে বিষয়ে সদা সতর্ক রয়েছি।"
এর আগে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মাহমুদাবাদ সেতুসংলগ্ন নামাপাড়া এলাকায় একটি প্রাইভেটকার সড়কের ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ডাকাত দলের ১০/১২ জন সদস্য। পরে ডাকাতরা দেশীয় অস্ত্র ও হকিস্টিক দিয়ে মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারের গ্লাস ভেঙে গাড়িতে থাকা ব্যক্তিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এ সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ ৯৫ হাজার টাকা ও তিনটি মোবাইল ফোন এবং স্বর্ণালঙ্কার লুট করে পালিয়ে যায় ডাকাতরা।
পুলিশ ওয়েবসাইটে ফেব্রুয়ারি মাসের অপরাধের ডেটা পাওয়া যায়নি। তবে জানুয়ারি মাসে গত ৫ বছরের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডাকাতির ঘটনায় দেশব্যাপী মামলা হয়েছে ৭১টি—যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০২৪ সালে ডাকাতির মামলা হয় ২৯টি, ২০২৩ সালে ২৭টি, ২০২২ সালে ৩০টি, ২০২১ সালে ৩৩টি এবং ২০২০ সালে ৩৯টি মামলা হয়েছে।
মহাসড়কে চলাচলকারী বেশ কয়েকজন মাইক্রোবাসের চালক জানান, ডাকাত দল কখনও বিমানবন্দর ও কখনও মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে হোটেলে অবস্থান নিয়ে প্রবাসীদের গাড়ি ফলো করে। ভোর ৪টার পর মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কম থাকে। পুলিশও টহলে থাকে না। এ সময় তারা ডাকাতির সুযোগ নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাইক্রোবাস চালক বলেন, "পরিস্থিতির উন্নতি না হলে রমজানের মধ্যে ডাকাতির ঘটনা আরও বাড়বে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশকে আরও কার্যকর হতে হবে।"
এদিকে, ডাকাতির পাশাপাশি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনাও সম্প্রতি বেড়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে তার বাসার সামনে গুলি করে ১৬০ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের ওপরে এক ব্যক্তিকে গুলি করে টাকা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছেন নেটিজেনরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করতে হবে। অন্যথায় দেশের পোশাক শিল্পখাত হুমকির মুখে পড়বে।