৩,৮০০ কোটি টাকার বিশাল যুব কর্মসংস্থান প্রকল্প শুরু হচ্ছে আগামী অর্থবছরে

প্রায় ৯ লাখ স্বল্প-শিক্ষিত ও বেকার যুবক আগামী পাঁচ বছরে দেশের মূলধারার অর্থনীতিতে নিযুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশের সুফল নিতে এমন এক প্রকল্পের মাধ্যমে তাদেরকে নিয়োজিত করা হবে, যেখানে তারা দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ পাবেন।
প্রকল্পের নথি অনুসারে, প্রথম ধাপে, প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে; যাদের ৭০ শতাংশই নারী।
'ইকোনমিক এক্সিলারেশন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ফর নিট (আর্ন)' শীর্ষক এই উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কালন করা হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছর থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সহজ শর্তে (সফট লোন) ৩৫৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩,৬৭৫ কোটি টাকা) ঋণ প্রদানের প্রাথমিক সম্মতিও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
প্রকল্পের ব্যাপারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) ড. মোঃ আবুল হোসেন বলেন, "প্রস্তাবটি মূল্যায়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন আগামী ১৫ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গে বৈঠক করবে। এছাড়া, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সামনে প্রস্তাবটি রাখার আগে বৈঠকের সুপারিশ অনুযায়ী ঋণদাতা গোষ্ঠীর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনাও শুরু হবে।"
যুবাদের প্রকল্প প্রস্তাবে 'নিট' (এনইইটি) বলে উল্লেখ করা হয়েছে; নিট হচ্ছে- নট ইন এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অর ট্রেইনিং, অর্থাৎ যারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নেই। তাদেরকে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং স্থানীয় শিল্পের চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তৃত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, প্রকল্প প্রস্তাবে যুবকদের প্রশিক্ষণের ধরণ এবং সময়কাল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। সেইসঙ্গে, এই প্রশিক্ষণার্থীদের উদ্যোক্তায় পরিণত হতে অনুদান হিসেবে কত টাকা দেওয়া হবে, সে বিষয়েও নির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের স্কাইসোয়াম উইংয়ের যুগ্ম প্রধান মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, প্রকল্পের কিছু বিষয় সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চাইবে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের (ডিওয়াইডি) কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতে, ২০২৮ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত রয়েছে ডিওয়াইডি।
তারা আরও জানিয়েছেন, দারিদ্র্য, দুর্বলতা এবং নিট যুবকদের সংখ্যা ও তাদের সম্ভাবনার ভিত্তিতে দেশের ২৫০টি উপজেলা থেকে প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের নির্বাচন করা হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে অনুমানিক প্রায় ৩৭.১ মিলিয়ন নিট জনসংখ্যা রয়েছে; এদের মধ্যে প্রায় ১২.৬ মিলিয়নই তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। এই সংখ্যা দেশের মোট তরুণ জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ। আর এরমধ্যে নিট নারীদের সংখ্যা প্রায় ৮৯.৬ শতাংশ। এছাড়া, দেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নিট জনসংখ্যা ১৫.৯৩ মিলিয়ন।
বিবিএস জরিপে দেখা গেছে, তরুণদের মধ্যে যারা কর্মসংস্থান বা শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ কোনোটির সঙ্গেই জড়িত নন, তারা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই বর্তমানে দেশে নিট জনসংখ্যার পরিমাণ কমিয়ে আনা একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে নিট জনসংখ্যার হার ১৫ শতাংশে এবং ২০৩১ অর্থবছরের মধ্যে ৫ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য হাতে নিয়েছে।
এদিকে, এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার উচ্চ হার বজায় থাকবে; অর্থাৎ, বর্তমানে দেশে জনমিতিক লভ্যাংশের স্বর্ণযুগ চলছে। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত এই তরুণ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, বিশেষ করে নারীরা, জনমিতিক লভ্যাংশের সুযোগটি সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর পথে কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অনেক নিট তরুণ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য যে যোগ্যতাটুকু প্রয়োজন, সেটিও তাদের থাকে না।
সরকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর একাধিক উদ্যোগের পরেও এই নিট জনসংখ্যার অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা দেশে অনেকাংশেই উপেক্ষিত।
লক্ষ্যসমূহ
বিকল্প শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক বাজার-ভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নে প্রকল্পের প্রথম অঙ্গে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫.৫৮ মিলিয়ন ডলার। মাধ্যমিকের পর শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া নিট যুবাদের দক্ষতার মই পর্যন্ত আনতে এর আরেকটি অংশে ব্যয় করা হবে ৩০.৩৫ মিলিয়ন ডলার।
প্রকল্পের দ্বিতীয় অঙ্গে ১২১.৫৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, এর লক্ষ্য কর্মদাতা, প্রশিক্ষণ পরবর্তী বেতন-ভিত্তিক নিয়োগ এবং উদ্যোক্তা সমর্থনের সাথে প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের সংযোগ স্থাপন করে মজুরি ও স্বকর্মসংস্থানে সহায়তা দান। উদোক্তা সমর্থনে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিড ফাইন্যান্সিং বা প্রাথমিক পুঁজি দিয়ে সহায়তার কার্যক্রম, কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ পরবর্তী বিশেষ দক্ষতা অর্জন এবং কর্ম সহায়ক কর্মকাণ্ডের সাথে দ্বিতীয় অঙ্গটি যুক্ত থাকবে।
তৃতীয় অঙ্গটি হলো- ইতিবাচক সামাজিক অনুশাসন ও কর্মক্ষেত্র-সহায়ক পরামর্শ প্রচারণার মাধ্যমে সামাজিকভাবে শক্তিশালীকরণ, নিযুক্তি, মালিকানা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে নিট যুবকদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা।
প্রকল্পের চতুর্থ অঙ্গের অধীনে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ব্যয় করা হবে প্রায় ১০৪.০৮ মিলিয়ন ডলার।
সুবিধাভোগীরা
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি নথি অনুসারে, ছয় লাখের বেশি নিট যুবক প্রকল্প থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণ লাভ করবে এবং আগে প্রশিক্ষণ পাওয়া আরো ২ লাখ জন উদ্যোক্তা উন্নয়নে সহায়তা পাবে।
উপবৃত্তি বরাদ্দের পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় কোভিড-১৯ এর কারণে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়া অন্তত এক লাখ শিক্ষার্থীর জন্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) এমএ আখের জানান, গ্রামীণ এলাকার ৫০ হাজার জনের সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরি করবে এ প্রকল্প। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৬-১৮ হাজার পল্লী-পর্যায়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ভিএলটিসি) একইসঙ্গে পরিচালিত হবে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রকল্প সামলানোর সক্ষমতা রয়েছে?
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)'র অধীনে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এরমধ্যে সর্ববৃহৎ হলো 'কম্প্রিহেন্সিভ টেকনোলজি বেজড ইন্টেগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ফর পোভার্টি অ্যালিভেশন (ইমপ্যাক্ট- ৩য় পর্যায়), এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৯ কোটি টাকা।
সে তুলনায় আরো বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা।
এবিষয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক এমএ আখের টিবিএসকে বলেন, সরকারের মুষ্টিমেয় যেসব প্রতিষ্ঠানের উপজেলা পর্যায়েও অফিস আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। প্রতিটি কার্যালয়ে অন্তত সাতজন কর্মকর্তা আছেন।
তিনি বলেন, 'প্রকল্প বাস্তবায়নে আমি কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না। বাস্তবতা হলো, বছরে আমরা প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করি, এখন ৭০০ কোটি টাকা করতে হবে'।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা টিবিএসকে বলেন, 'জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিপুল সংখ্যক নিট যুবক। তাদের অর্থনীতির মূল ধারায় যুক্ত করতে দক্ষতা-ভিত্তিক প্রশিক্ষণের দরকার আছে। কিন্তু, প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রশিক্ষণের ধরন, কারিকুলাম এবং প্রশিক্ষকদের মান নিশ্চিত করতে হবে'।