ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে মানসম্মত স্কুলের দাবি নগর পরিকল্পনাবিদদের

রাজধানী ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে মানসম্মত স্কুল তৈরীর দাবি জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। দরকার হলে শিশুদের জন্য খেলার মাঠসহ বাকি সুবিধাগুলো নিয়ে স্কুল তৈরীর আলাদা প্রকল্প নিয়ে তা বাস্তবায়নের দাবি তাদের।
শিশুদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকায় ড্যাপে প্রস্তাবিত স্কুল, খেলার মাঠ, পার্ক তৈরিতে আশু উদ্যোগ প্রয়োজন- বলছেন তারা।
মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনাতায়নে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ও সেভ দ্য চিলড্রেন এর যৌথ আয়োজনে 'অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শিশুবান্ধব ঢাকা: বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রেক্ষিত' শীর্ষক এক নগর সংলাপে বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত দেন।
পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) বলেন, "এ শহর শিশুবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে উঠেনি। এলাকাভিত্তিক নগর উন্নয়ন হতে হবে। বিদ্যালয় ভিত্তিক মহল্লা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে মানসম্মত স্কুল তৈরী করতে হবে। এলাকাভিত্তিক মানসম্পন্ন স্কুল লাগবে। আলাদা প্রকল্প নিয়ে হলেও মানসম্পন্ন স্কুল গড়ে তোলা দরকার।"
এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, "ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর যদি তার মেয়াদকালীন সময়ে অন্তত একটি খেলার মাঠ বা পার্ক করবার উদ্যোগ নিতে পারেন তাহলেও ঢাকার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব। একইসাথে আমাদের উন্মুক্ত স্থান ও গণপরিসর এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের ব্যাকরণ শেখবার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন এবং এলাকাভিত্তিক সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।"
পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, "এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে, এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে শিশুদের সম্পৃক্ত করে তাদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে শিশুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাসযোগ্য ঢাকা শহর গড়তে আইনি কাঠামো তৈরি এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নির্ধারণ করা দরকার।"
"পাশাপাশি শিশুদের অধিকার সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করা এবং কমিউনিটি ও জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের অধিকার নিয়ে 'গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা ও করণীয়সমূহ নির্ধারণ' করার সহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আমাদের কাজ করা উচিত," যোগ করেন তিনি।
স্থপতি রোকসানা রশিদ অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা শহরের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ক্যানবেরা'তে শহরের জনসংখ্যা নির্ধারণ করেই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের নগর এলাকার পরিকল্পনায় 'ডিজাইন পপুলেশন' সুনির্দিষ্ট না করাতেই পরিকল্পনাসমূহ অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনায় স্বার্থের সংঘাত আসবেই, তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে বৃহত্তর জনস্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই স্থপতি।
ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের ডেপুটি টিম লিডার পরিকল্পনাবিদ খন্দকার নিয়াজ রহমান বলেন, "দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা ঢাকা শহরে মানসম্মত স্কুল কেন তৈরি করতে পারিনি সেই আত্মবিশ্লেষণ দরকার। ড্যাপ এরিয়ায় সুপারিশ অনুযায়ী ৬২৭ টি স্কুল বানাতে মাত্র ২৫ হাজার কোটি টাকা লাগে। যেখানে সরকার শহরের উন্নয়নে এর থেকে বেশি টাকারও প্রকল্প নেয়।"
সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ছাড়া ড্যাপ বাস্তবায়ন করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, "যাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত এসেছে, তারাই ড্যাপ নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করছে। কিন্তু বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে সকলেরই ড্যাপের প্রস্তাবনার ভাল-মন্দ দিকগুলো নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করা উচিত, যা জনস্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, "ড্যাপ গেজেট হবার সাথে সাথেই যারা ড্যাপ অকার্যকর বলে মন্তব্য করছেন, তারা গোষ্ঠীস্বার্থে পরিকল্পনা অকার্যকর করবার মাধ্যমে ঢাকাকে অবাসযোগ্য করে তুলতে চায়। ড্যাপের প্রকৃত বাস্তবায়নের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।"
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, "এবারের ড্যাপে প্রস্তাবিত স্কুল জোনিং এর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুদের হাঁটা দূরত্বে স্কুলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে রাজউক পিপিপি'সহ বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে মানসম্মত স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে না পারি ৫টি ওয়ার্ড মিলে একটি ভালো মানের স্কুল যদি করতে পারি তবে অনেক সমস্যাই সমাধান হবে।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম বলেন, "সিটি করপোরশনকে নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনীয় গণপরিসর বাস্তবায়নে অত্যন্ত সহায়ক দলিল হিসেবে কাজ করছে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা।"
ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রস্তাবিত বিদ্যালয়কেন্দ্রিক মহল্লা পরিকল্পনা, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন, এলাকাভিত্তিক পার্ক-খেলার মাঠ তৈরি ইত্যাদি প্রস্তাবনার কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব বলে আলোচনায় উঠে আসে। তবে এর জন্য প্রয়োজন স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাসমূহের কার্যকর উদ্যোগ, সঠিক প্রকল্প গ্রহণ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নের রুপরেখা প্রণয়ন।
সংলাপে আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, সাভার, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ি এলাকার শিশু কিশোরেরা বলেন, "আমাদের খেলার কোন জায়গা নেই, দৌঁড়ানোর জায়গা নেই। স্কুলে যাবার জন্য ফুটপাতে হকারদের কারণে হাঁটতে কষ্ট হয়। সবুজ এলাকা বা খোলা জায়গার বড্ড অভাব।"