‘ঢোক গিলার সময় মনে হয় আমার ভেতর করোনা ঢুকে যাচ্ছে’

'নিশ্বাস নিতে খুব অস্বস্তি লাগে। নিজেরই মুখের লালা যখন গলা দিয়ে পেটে ঢুকে, মনে হয় কোভিড-১৯ আমার ভেতরে যাচ্ছে,' বলছিলেন ফারহানা ফাহমি (ছদ্মনাম), একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট।
আর দশটা সাধারণ সময়ের মতোই রোজ অফিস করছেন তারা। যদিও সময়টা মোটেও সাধারণ নয়। বলা হচ্ছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কথা; করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে একেবারে সামনে থেকে যারা লড়ছেন।
রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও সেগুলো পরীক্ষা করার কাজ মূলত তারাই করে থাকেন। লোকবল কম হওয়ায় ধকলে সবার জেরবার অবস্থা। প্রতি মুহূর্তে নিজেই করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ভয়। তবু কাজ, কাজ, আর কাজ।
বেশিরভাগ দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে- রোগীর বাড়িতে, হাসপাতালে বা মর্গে গিয়ে নমুন সংগ্রহ। অফিস শুরু সকাল ৯টায়, তবে মোটামুটি ১০টার মধ্যে সব প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় নমুনা সংগ্রহের জন্য; আর তা চলে প্রায় বিকাল ৫টা অবধি।
'শুরুতে নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠ পর্যায়ে যেতে হতো না,' বললেন ফাহমি, 'তবে ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হওয়ার পর কাজের চাপ বেড়ে গেছে অনেক বেশি।'
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বাংলাদেশে সংক্রমণের তথ্য প্রথম প্রকাশ করে ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যুর খবর জানা যায় ১৮ মার্চ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট সংক্রমিত হয়েছেন ১৩ হাজার ৭৭০ জন এবং মারা গেছেন ২১৪ জন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শুরুর দিকে সকাল ৯টা থেকে রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত টানা ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের। সাপ্তাহিক ছুটি মেলেনি। পরে তাদের দাবির মুখে কিছু সংখ্যক লোক নিয়োগ দিয়ে কাজের সময় কমিয়ে ৯টা-৫টা করা হয়।
সম্প্রতি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২ হাজার ডাক্তার, আনুমানিক ৫ হাজার ৫৪ জন অভিজ্ঞ নার্স নতুন করে নিয়োগ করলেও, সেখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ সংক্রান্ত কথা নাই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ৭ হাজার ৯২০টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কাজ করছেন ৫ হাজার ১৮৪ জন। অবশিষ্ট পদে এখন পর্যন্ত কোনো নিয়োগ হয়নি।
'সরকার চাইলেই আরও লোক নিয়োগ দিয়ে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কাজের চাপ কমাতে পারে,' বললেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হাবিবুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। 'মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সুস্থ থাকা জরুরি। তাদের ছাড়া নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা সম্ভব নয়।'
'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মান অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিন জন নার্স এবং পাঁচজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকার কথা,' হাবিবুল বললেন, 'সেখানে আমাদের লোকবল প্রায় নেই বললেই চলে।'
মাঠ পর্যায়ে শুরুর দিকে প্রথম দুই সপ্তাহের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না বলে জানালেন ফাহমি। কর্মীদের নিজেদেরই সিএনজি বা উবার ঠিক করে নিতে হতো। "আর প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে করে যখন যাওয়া আসা শুরু করলাম, ততদিনে মানুষ করোনাভাইরাস সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে গেছে; যে এলাকায় যেতাম বা যাই, কিছু হেনস্তার শিকার হতে হয়। লোকজন গাড়ি দেখলেই 'করোনা আসছে, করোনার গাড়ি আসছে' বলে চিৎকার করতে থাকে; চারপাশে ভিড় করে থাকে, নানান ধরনের প্রশ্ন করে।"
সামাজিক হেনস্তার কারণে রোগীরাও দ্রুত রিপোর্ট পেতে চান উল্লেখ করে ফাহমি বলেন, 'কিন্তু সেটা তো আমাদের হাতে থাকে না; তখন খুব খারাপ লাগে।'
যাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়, তাদের হয়রানি যেন আরও বেশি, জানালেন তিনি। 'অনেকেই হেয় করে, একঘরে করে দেয়। যদিও নমুনা সংগ্রহ করা মানেই কোভিড-১৯ হওয়া নয়। এমনও হয়েছে, ঢাকার এক ফ্ল্যাট থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসার পর ভদ্রলোকের বাড়িতে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ বাড়িতে ওনার ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত মা রয়েছেন, যার নিয়মিত চেক-আপ করাতে হয়। পরবর্তী সময়ে ওনার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল।'

'এখন নতুন হয়ে যুক্ত হয়েছে আরেক বিড়ম্বনা,' বললেন হাবিবুল, 'অনেক জায়গায় আমরা নমুনা সংগ্রহ করতে গেলে রোগীরা বলছেন, আমাদের টেস্টের মান ঠিক নেই। এর কারণ, সিলেটে কিছুদিন আগে বেশ কিছু স্যাম্পল রিজেক্ট করা হয় ভুল পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য। যার অধিকাংশ নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সরকারের স্বল্প সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এক বা দুই দিনের ভিডিও কনফারেন্সে ট্রেনিংপ্রাপ্ত টিকাদান কর্মীরা।'
'টিকা দেওয়া আর মানব শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ- দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তারা এমনিতেই এই বিষয়ে পড়াশোনা করেন না, সেখানে কোভিড-১৯ নমুনা সংগ্রহ সম্পর্কে তাদের জানার স্বল্পতা থাকা স্বাভাবিক।'
'প্রায় ১২ বছর এই সেক্টরে স্থায়ী সরকারি নিয়োগ বন্ধ, তাই বেকার বসে আছেন হাজারও টেকনোলজিস্ট। আর গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে কাজ করানো হচ্ছে অপেশাদার কাউকে দিয়ে; হচ্ছে কাজে ভুল। আবার সেই দায়িত্ব নিতে হচ্ছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের। অথচ সরকার নিয়মিত জেলা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময়ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কোনো প্রতিনিধি থাকেন না,' কিছুটা উষ্মার সঙ্গেই বললেন হাবিবুল।
করোনাভাইরাস মোকাবেলা যুদ্ধে সামনের কাতারের যোদ্ধা হিসেবে মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক ধকলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কখনো হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা পিপিই পরেই দীর্ঘসময় কাজ করতে হওয়ায় পানি বা খাবার খাওয়ার সুযোগ পান না, ফলে ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। পাশাপাশি নিজের চোখে দেখেন রোগীদের নিদারুণ শ্বাসকষ্ট। আবার কখনো মর্গে মৃতের হাঁ করা মুখ থেকে নমুনা সংগ্রহের সময় বীভৎস গন্ধ আর আলো আঁধারিতে গা ছম ছম করে।
'দীর্ঘ সময় পিপিই পরে থাকার ফলে পুরো শরীর ঘামে ভিজে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় যখন সেই ঘাম কপাল বেয়ে চোখে ঢুকে; একদিকে চোখ জ্বালা করে, কিন্তু ঘাম মোছার কোনো উপায় থাকে না,' করোনা ওয়ার্ডে রোগীর নমুনা সংগ্রহের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ফাহমি বলেন।
'তারপরও, যখন দেখি একজন করোনা রোগী একা একাই নিজের দেখাশোনার চেষ্টা করছেন এবং চারপাশে কেউ সাহায্য করার নেই, তখন নিজের কষ্ট অনেক কম মনে হয়। কোভিড রোগীদের অনেকেরই শ্বাসকষ্ট মারাত্মক হয়। সেকেন্ডে অনেকবার শ্বাস নিতে হয়। এটা যে না দেখেছে, তাকে বোঝানো যাবে না। যখন কোনো রোগীর এমন শ্বাসের সমস্যা হয়, মনে হয় যেন নিজে একটু কম নিশ্বাস নিয়ে যদি তাকে কিছুটা দেওয়া যেত!'
'সেই সময়, নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, চাকরি করছি- এই অনুভূতি কিছুই কাজ করে না। মানসিকভাবে এসব সহ্য করা বেশ কষ্টসাধ্য। অনেক রোগী রয়েছেন, যাদের নমুনা নেওয়ার পর মারা গেছেন; তখন সব কিছু অর্থহীন মনে হয়। এই যে, এক মুহূর্ত পরেই একটা মানুষের নাই হয়ে যাওয়া!'
'সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা,' এক নিশ্বাসে বললেন ফাহমি। 'সেই মুখগুলো ভুলে থাকা যায় না। একটু একা হলেই ঘুরে ফিরে আসে। নিজেকে প্রচুর মোটিভেট করতে হয়, সময় দিতে হয়। কিন্তু কাজ তো বন্ধ রাখা যায় না।'
ফাহমি জানান, তিনি নিজে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে, পাশের মানুষকে আক্রান্ত করে ফেলার ভয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত তার ৭-৮ জন সহকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের অনেকেই, সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া সত্ত্বেও, এন-৯৫ মাস্ক পরে কাজ করা সত্ত্বেও আক্রান্ত হয়েছেন।
'তারপরও কোয়ারেন্টিনে যেতে পারছি না; সমস্যা সেই লোকবল সংকট,' বলেন মাঠ পর্যায়ের আরেক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট শাহানা (ছদ্মনাম)। 'যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে বলা আছে, আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা সবাইকে কোয়ারান্টিনে যেতে হবে।'
শাহানা জানান, তিনি পরিবার থেকে আলাদা থাকতে পারছেন না বলে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আশেপাশের মানুষেরা ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। তাছাড়া, সরকারি প্রকল্পের অধীনে ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় কর্মরত কর্মীদের জন্য এখন পর্যন্ত নেই কোনো স্বাস্থ্য বীমা। শুধু সরকারি রাজস্ব খাতের অধীনে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন- এমন কর্মীরাই স্বাস্থ্য বীমার আওতাভুক্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। কেননা তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে অন্য সবার সুরক্ষাও ঝুঁকিতে থাকবে।
'ঘুম প্রায় হয়ই না; তন্দ্রার মতো আসে। তাও অবসরে প্রতিদিনকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ভুলে থাকতে গান শুনি, মুভি দেখি, কবিতা পড়ি, যদি কিছুটা ভুলে থাকা যায়,' বললেন ফাহমি।
'বাড়িতে বাবা-মাকে জানাইনি যে, সরাসরি কোভিড রোগীদের সঙ্গে আমার কাজ; তাহলে চিন্তা করবেন, অসুস্থ হয়ে পড়বেন, চাকরি ছেড়ে দিতে বলবেন। কিন্তু কাজটা তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে; আমি না করলে অন্য কেউ। কিভাবে এই বিপদে আমার যা কাজ, দায়িত্ব- তা ফেলে সরে যেতে পারি!'
চিকিৎসকদের অন্যতম কেন্দ্রীয় পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সংক্রমিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর নিয়মিত হিসাব রাখছে। তবে হিসাবটা হালনাগাদ নয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিএমএ-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩০ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত ৮৮১ জন স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। তাদের মধ্যে চিকিৎসক ৩৯২, নার্স ১৯১ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ২৯৮ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২ জন চিকিৎসক।