২৯টি আইসিইউ বেড নিয়ে করোনার প্রস্তুতি

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে। দেশে ক্রিটিক্যাল রোগীদের এই সাপোর্ট দেওয়ার জন্য পাঁচটি হাসপাতালে মাত্র ২৯টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকার বাইরে করোনা আক্রান্তদের জন্য কোনো হাসপাতালে আইসিইউ বেড নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১০টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রো লিভার হাসপাতালে ৮টি, উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি, মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি ও যাত্রাবাড়ির সাজেদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবে এ হাসপাতালগুলোর মধ্যে শুধু করোনা ভাইরাসে অক্রান্ত রোগীদের মধ্যে র্নিধারিত একমাত্র হাসপাতাল কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল। ২০০ বেডের ওই হাসপাতালেই এখন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ও আইসোলেশন করা হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কোনো কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে মাত্র ৫ বেডের ডায়ালাইসিস বেড প্রস্তুত রয়েছে। যদিও দেশে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের ডায়ালাইসিস প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগীর আইসোলেশন ও আইসিইউ প্রয়োজন। এর মধ্যে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখেরও ওপরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট আইসিইউ বেড রয়েছে ১২৮৫টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ২১১টি। প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই কম।
তবে দেশে যে আইসিইউ বেড রয়েছে সেগুলোতে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়া যাবে না। কারণ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে কোনো আইসিইউতে ঢোকানো হলে সেখানে থাকা অন্য রোগীরাও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন।
সম্প্রতি রাজধানীর ডেল্টা হাসপাতালের আইসিইউতে এক রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর সে হাসপাতালের আইসিইউ ব্ন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে আইসিইউতে থাকা অন্য রোগীরাও এখন করোনার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে। আর যেসব মানুষের কোমর্বিডিটি আছে বা ইমিনিউটি কম, তারা এ রোগে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যে হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হবে সেগুলো ডেজিগনেটেড হসপিটাল হতে হবে। সেখানে অন্য কোনো রোগীর চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের আলাদা আইসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহারুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কমিউনিটিতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে যে পরিমাণ আইসিইউ বেড দরকার হয়েছে, সেই তুলনায় আমাদের রয়েছে খুবই স্বল্প। জনসংখ্যা ও পারসেন্টজ অব সিনিয়র সিটিজেনের তুলনায় এ একেবারে কম। আইসিইউ বেডের সংখ্যা শিগগিরই আরও বাড়াতে হবে এবং প্রস্তুত রাখতে হবে।
এদিকে, করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতালের ১৫০টি বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে আইসিইউ নেই।ফলে করোনা আক্রান্ত কোনো মুমূর্ষু রোগীর আইসিইউ সেবা প্রয়োজন হলেও সেটি দেওয়া সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন অধ্যাপক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, করোনা রোগীর অবস্থা যেকোনো সময় মুমূর্ষু হতে পারে। তখন তার আইসিইউ প্রয়োজন হবে। অথচ চিকিৎসার জন্য আইসিইউ ছাড়া হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নয়।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, চট্টগ্রামে শুধু চমেক হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু সেখানে নিয়মিত আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। করোনার রোগীর চিকিৎসা সেখানে হলে সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে। তাই বিকল্প দুটি হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে হাসপাতাল দুটিতে আইসিইউ নেই।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, রোগী এখন কম পাওয়া যাচ্ছে, তাই সবার আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে না। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে রোগীর চাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের অনেকরই আইসিইউ প্রয়োজন হবে। অতি শিগগিরই কয়েক'শ আইসিইউ বেড প্রস্তুত করা প্রয়োজন।
২১ মার্চ প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের জন্য ১০০টি আইসিইউ স্থাপন করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪০০ ইউনিট স্থাপন করা হবে। কিন্তু কবে সে বেড স্থাপন করা হবে, তা নিশ্চিত করে বলেননি তিনি।
'পর্যাপ্ত ভ্যান্টিলেটর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে'
চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর সুবিধা প্রয়োজন।
অধ্যাপক মুজাহারুল হক বলেন, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ভ্যান্টিলেটর থাকতে হবে। যাদের শ্বাস নিতে সমস্যা হবে, তাদের অক্সিজেন দিতে হবে। সব রোগীকে আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না, কাউকে শুধু ভ্যান্টিলেটর দিলেও হবে। এ ভ্যান্টিলেটর প্রয়োজন হবে ইয়াং পেশেন্টদেরও।
যেসব হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা দেওয়া হবে সেগুলোতে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর সুবিধা আছে কি না- সে বিষয়ে জানাতে পারেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, যে কয়টি আইসিইউ বেড রয়েছে, শুধু সেগুলোতেই ভেন্টিলেটর সুবিধা রয়েছে।
এক নজরে:
- ৫টি হাসপাতালে ২৯টি আইসিইউ বেড রয়েছে।
- করোনার জন্য একমাত্র নির্ধারিত হাসপাতাল কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে আইসিইউ বেড ১০টি।
- কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ডায়ালাইসিস বেড প্রস্তুত ৫টি।
- দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী ৮০ লাখ- যাদের সবচেয়ে বেশি আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে।
- ঢাকার বাইরে কোনো হাসপাতালে করোনার জন্য আইসিইউ বেড নেই।