লকডাউন উঠে গেছে, তবু দুর্দশা কাটেনি তাদের

সিএনজি অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ আনোয়ার ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড থেকে দুজন যাত্রী নিয়ে মৌচাক আসেন মাত্র ১০০ টাকা ভাড়ায়। স্বাভাবিক সময় এই পথ তিনি ১৫০-২০০ টাকার কমে আসেন না। তার ওপর তাকে প্রায় ৩০ মিনিট জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে।
'আসলে গত দুই সপ্তাহ আমাদের কোনো আয় নাই। খুব খারাপ অবস্থায় আছি। টাকার দরকার। তাই যে যা ভাড়া বলছে, কোনো রকম পোষালেই চলে যাচ্ছি,' শুকনো মুখ ও চিন্তিত চেহারা নিয়ে কথা বলছিলেন আনোয়ার।
তিনি অসহায়ের মতো বলতে থাকেন, 'এই সাত-আটদিন আয় করার সুযোগ পাব, তারপর তো আবার লকডাউন। এ মাসের ঘর ভাড়া দেই নাই। আগামী মাসে দিতে পারব বলে মনে হয় না। সামনে ঈদ, বউ-বাচ্চার মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে পারলেই হয়।'
'এতদিন ধার-দেনা করে চলেছি, সেই টাকাও ফেরত দিতে হবে। আমাদের ইনকাম তো যাত্রীদের ওপর নির্ভর করে, তারা উঠলেই কেবল আয় হবে। দুই ঘণ্টা যাবত অপেক্ষা করে একটা ট্রিপ পেলাম, তাও অর্ধেক ভাড়া,' তিনি বলেন।
লকডাউন উঠে যাওয়ায় আনন্দের চেয়ে চিন্তা ও আশঙ্কা নিয়েই প্রথম দিন কেটেছে আনোয়ারের মতো নিম্ন-আয়ের বহু মানুষের।
'গত ১৪ দিন খুব কষ্টে কেটেছে আমাদের। এই সাতদিন আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। বাচ্চাদের নিয়ে অন্তত ঈদে দুমুঠো খাওয়া যাবে,' বলেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কুলি মোহাম্মদ রাজা।
আরও বলেন, 'যদিও সামনের লকডাউনে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে কিভাবে চলব তা এখনো জানি না। এই লকডাউনে কেউ আমাদের ১০ টাকাও দিয়ে সাহায্য করে নাই, আর ভবিষ্যতেও পাব আশা করি না।'
মোহাম্মদ আলী বলেন, '২০৩ জন কুলির প্রায় সবাই গত ১৪ দিন, প্রতিদিন এখানে এসেছি, সারাদিন বসে থেকেছি। দিন শেষে না খেয়ে বাড়ি গিয়েছি। খুব কষ্ট করে নিয়ে সংসার খরচ অর্ধেক দিয়ে চালিয়েছে।'
'লকডাউন উঠে গেলেও আমাদের আয় কিন্তু বাড়েনি, (বৃহস্পতিবার) দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এখানের মাত্র ১০ থেকে ১২ জন মালটানার সুযোগ পেয়েছে। দেড়শ থেকে দুইশ টাকার মতো ইনকাম হয়েছে তাদের, অথচ স্বাভাবিক সময়ে কয়েকগুণ বেশি আয় হতো', তিনি বলেন।
'সামনে লকডাউন আমাদের জন্য খুবই দুশ্চিন্তার। কিছুই জানি না কিভাবে চলব। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নাই।'
ট্যাক্সি ড্রাইভার উত্তম বলেন, 'মানুষের হাতে টাকা নাই, তারা ট্যাক্সিতে না উঠে বাসে বা রিকশায় করে চলে যায়। তাই আমরা আয় নিয়ে সন্দিহান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।'
'লকডাউনে সময়ে গোপনে দুয়েকটা ট্রিপ মারতে পেরেছি। তা দিয়ে কোনোরকম কষ্ট করে চলেছি। ৯ সদস্যের পরিবার আমার একার উপরে চলে এসেছিল। কোনো রকমে বেঁচে রয়েছি,' তিনি বলেন।
প্রাইভেট কার ড্রাইভার আজিজুল ইসলাম বলেন, 'আজ পর্যন্ত কোনো ড্রাইভার কোনো সহযোগিতা পাই নাই। কমলাপুর স্টেশনে ৪০ জনের মতো ড্রাইভার আছে, সবারই একই অবস্থা।'
'এক সময় আমরা দিনে ৭০০-১০০০ টাকা আয় করতাম। গত দুই-তিন মাসে তা ২৫০-৫০০ টাকায় নেমে গেছে,' বলেন তিনি।
সিএনজি অটোরিকশা চালক আশরাফুল বলেন, 'রাস্তায় যাত্রী আছে, কিন্তু কেউ আমাদের চাহিদা মতো ভাড়া দিচ্ছে না। কেউ কেউ ন্যায্য ভাড়াও বলছে না। তাই আমাদের ট্রিপ খুব কম। আজ আমি খুব সকালে নেমেছি এখন বারটা বাজে মাত্র ২০০ টাকার একটা খ্যাপ মেরেছি। আগে এই সময়ে আয় হতো ৫০০-৭০০ টাকা।'
বুধবার পর্যন্ত রিকশাগুলোও বাড়তি ভাড়া আদায় করলেও বৃহস্পতিবারের দৃশ্য ছিল ভিন্ন। রিকশাচালক মোহাম্মদ শাহিন গতকাল রামপুরা থেকে যাত্রী নিয়ে মৌচাক আসে ৪০ টাকা ভাড়ায়। অথচ এই একই পথের ভাড়া ৫০-৬০ টাকা ছিল ঠিক আগের দিন।
যাত্রী নিলুফার বললেন, 'আজকে (বৃহস্পতিবার) রিকশার যাত্রী একটু কম, তাই ভাড়া কমেছে। আগে আমি আবুল হোটেল থেকে মৌচাক পর্যন্ত আসতে ভাড়া দিতে হতো ৪০-৫০ টাকা, আজ সেটা ৩০ টাকায় এসেছি।'
এদিকে, লকডাউন উঠে যাওয়ার প্রথমদিনই মার্কেটগুলোতে মানুষের ভিড়, ঈদের অগ্রিম টিকিটের জন্য বাস কাউন্টার ও রেল স্টেশনে দীর্ঘ লাইন ও পুরো ঢাকায় তীব্র ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়।