থমকে আছে আলোচিত ক্যাসিনো মামলার বিচারকাজ, মামলায় নেই চাঁদাবাজির অভিযোগ

রাজধানীতে আলোচিত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের দুই বছর হয়েছে আজ শনিবার। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার অভিযানে বেরিয়ে আসে খোদ রাজধানীতেই অবৈধ জুয়ার কারবার, মতিঝিল ও পল্টন এলাকার বেশ কয়েকটি ক্লাব বন্ধও করে দেওয়া হয়।
ক্যাসিনো–কাণ্ডে সম্রাট ও আরমানের মতো আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ধরা পড়েছিলেন ১৪ জন। তাদের বিরুদ্ধে মোট ৫৫টি মামলা করেছিল পুলিশ, র্যাব ও দুদক। এর মধ্যে ৩৬টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাকি ১৯টি মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না।
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, মানি লন্ডারিং আইন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৫৫টি মামলা করে র্যাব, সিআইডি ও দুদকের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে র্যাব-সিআইডি মিলে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা এবং মানি লন্ডারিং আইনে ৩২টি মামলা করে। অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়ে গ্রেপ্তার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক (মনজু) ছাড়া বাকি ১৩ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করে দুদক।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলার তদন্ত শেষ করতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। মামলাগুলোর তদন্তকাজ প্রায় গুটিয়ে এনেছেন তারা। যেসব মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে, ওইসব মামলাতেও এখনো চার্জ গঠন হয়নি।
অভিযানের শুরু থেকেই এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠলেও এমন অভিযোগে কোন মামলা করা হয়নি, এমনকি অন্য মামলার চার্জশিটের এসবের উল্লেখ করা হয়নি।
আসামিদের বিরুদ্ধে র্যাব ১৮টি মামলা করে। অপরাধলব্ধ আয় ও দেশের বাইরে অবৈধ অর্থ পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইনে ১৪টি মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আর অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে ২৩টি মামলা করে দুদক।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান টিবিএসকে জানান, মানি লন্ডারিং আইনে হওয়া ১৪ মামলার মধ্যে ১১টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। যুবলীগের নেতা সম্রাটের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাসহ মোট তিন মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, সম্রাটের পাচার করা অর্থের বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত বছরের ২৫ অক্টোবর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠির জবাব না পাওয়ায় মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে।
দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২৩টি মামলা করেছিল দুদক। এর মধ্যে সম্রাটের বিরুদ্ধে করা মামলাসহ ১০টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক।
এসব বিষয়ে জানতেই চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ক্যাসিনো–কাণ্ডের ঘটনায় র্যাব ১৩টি মামলার তদন্তভার পায়। তদন্ত শেষে ১৩টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মঈন।
এছাড়া, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ৫টি মামলার তদন্ত ভার পেলেও মাত্র একটি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি।
ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার ১৪ জনের মধ্যে ইতোমধ্যে তিনজন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। গত বছরের জুলাইয়ে সর্বশেষ জামিন পান ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
এর আগে জামিনে বের হন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ)। এদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম।
ক্লাব পাড়ায় ভুতুড়ে পরিবেশ
রাজধানীর মতিঝিল ক্লাবপাড়া ক্যাসিনোর কারণে এক সময় দিন-রাত জমজমাট থাকলেও এখন পরিস্থিতি অনেকটা ভুতূড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর থমকে গেছে জমজমাট এই এলাকা। ক্লাবগুলোতে সাধারণের চলাচল সীমিত তো বটেই, সংশ্লিষ্টদের অনেকেও সেখানে প্রবেশ করেননা বললেই চলে।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে এই পাড়ার অধিকাংশ ক্লাব বন্ধ। দেখভালের জন্য নিরাপত্তা কর্মীদের দেখা মিলেছে দুই একটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তারা মুখ খুলতে চান না। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরের শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে এসব প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যপট এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
অভিজাত একটি ক্লাবের একজন নিরাপত্তাকর্মীর সাথে কথা হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফটকে করোনাভাইরাসের সতর্কবার্তা সম্বলিত নির্দেশনা দেখিয়ে সায়েফ আহমেদ (ছদ্ননাম) বলেন, করোনার কারণে এখন সর্বসাধারনের যাতায়াত সীমিত। জমজমাট সেই অবস্থা নেই। ক্যাসিনো প্রসঙ্গ সামনে আনলে তখন আর কথা বলতে চাননি তিনি।
লোকজন না থাকলেও আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা মিলেছে সেখানে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব থেকে ২০০ গজ দূরত্বের মাধ্যে টহল পুলিশের টহল ভ্যান দাঁড়ানো। কিছুটা অলস সময় পার করছে তারা। কথা বলতে চাইলে খুব একটা আগ্রহ না দেখিয়ে এক পুলিশ সদস্য জানালেন, নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা।
আশপাশের কিছু অস্থায়ী দোকানীর সাথে কথা হয়। তাদেরই একজন আরমান হোসেন যিনি এই ক্লাব পাড়ায় অন্তত ১৫ বছর ধরে পান-বিড়ি-সিগারেটের ব্যবসা করে আসছেন। তিনি টিবিএসকে জানান, বানিজ্যিক এলাকা হওয়ায় এখানে প্রায়সময় মানুষজন থাকে। করোনা যাওয়ার পারে আমরাও ব্যবসা-বানিজ্য করছি। তবে ক্লাবকে কেন্দ্র করে আগে যে জমজমাট অবস্থা ছিল, সেটা নেই।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম বলেন, ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের অন্যদিন মানুষজন ভালোই থাকে। তবে এখন অধিকাংশ এদিকে আসে কাজ মেটাতে। আগে রাত বেরাতেও ভালো আড্ডা জমতো। ক্যাসিনো অভিযানের পর থেকে সেটা প্রায় নাই বললেই চলে, বলে জানান তিনি।
এখানকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেড, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, সোনালি অতীত ক্রীড়াচক্র, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকে ঘিরে সেই জমজমাট রুপ যেন একেবারেই অচেনা। অধিকাংশ ক্লাবই এখন সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান।