কাপ্তাই হ্রদে কমেছে মাছের উৎপাদন, ৩ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হ্রাস

গত ৩০ এপ্রিল মধ্যরাতেই কাপ্তাই হ্রদে বন্ধ হয়ে গেছে মাছ আহরণ। প্রতিবছরের মতো এবারও নিয়ম মেনে তিনমাস পর ফের শুরু হবে মাছ আহরণ। ইতোমধ্যে কেটেও গেছে পুরো একটি মাস। কিন্তু বন্ধ হওয়ার আগে কেমন ছিল হ্রদের মাছ আহরণ?
জানা গেছে, আগের চেয়ে সর্বশেষ বছরে মাছ অবতরণ কম হয়েছে অন্তত ১৭২৬ টন ! অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাছ অবতরণ যেখানে ছিল ৮,৫০৬ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ বছরে সেটা দাঁড়িয়েছে ৫৭৮১ মেট্রিক টনে। যা পূর্বের বছরের তুলনায় ১৭২৬ মেট্রিক টন কম! একই সময়ে মাছের উৎপাদনও কমেছে প্রায় ৩০৫ মেট্রিক টন। কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) তথ্য জানান দিচ্ছে এই দু:সংবাদটি। মাছ অবতরণ কম হওয়ায় সঙ্গতকারণেই আয়ও কমেছে প্রতিষ্ঠানটির, যা টাকার অংকে আগের বছরের তুলনায় অন্তত তিন কোটি টাকা কম।
বিএফডিসির সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাসময়ে বৃষ্টিপাতের অভাব ও উজান থেকে পানি না নামার কারণে মৌসুমের শুরুর দিকে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে পানিস্বল্পতা দেখা দিয়েছিল, যা মৌসুমের শেষ দিকে ফের ফিরে আসে। এতে করে মৌসুমের প্রথম প্রান্তিকে হ্রদে প্রচুর মাছ ধরা পড়লেও পরবর্তী সময়ে হ্রদে মাছ ধরায় ভাটা পড়ে। প্রথমদিকে মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে বাকী পুরো মৌসুমেই মাছ শিকার তুলনামূলকভাবে কম ছিল। মৌসুম শেষে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) বিএফডিসির বিপণনকেন্দ্রে মাছ আহরণ ও রাজস্ব আয় কমেছে। স্বল্প পানিতে জেলেরা মৌসুমের শুরুর দিকে মাছ ধরায় বেশি পরিমাণে ছোট মাছ ধরা পড়ে গেছে। এতে করে পরবর্তী সময়ে মাছের উৎপাদন বাড়েনি।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি মৌসুম ২০২০-২১ অর্থবছরে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ থেকে বিএফডিসির চারটি বিপণনকেন্দ্রে ৬ হাজার ৭৮০ টন অবতরণ করা হয়েছে। অবতরণ করা মাছের বিপরীতে বিএফডিসির রাজস্ব আদায় হয়েছে ১২ কোটি ১১ লাখ টাকা। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৮ হাজার ৫০৬ টন মাছ অবতরণ করা হয়। অবতরণ করা মাছের বিপরীতে বিএফডিসির রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সে হিসেবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছ অবতরণ কমেছে ১ হাজার ৭২৬ টন এবং রাজস্ব আদায় কমেছে তিন কোটি ১৩ লাখ টাকা। অবতরণ করা মাছের মধ্যে কেঁচকি, চাপিলা, মলা ও দেশি মলাসহ অন্যান্য ছোট মাছের আধিক্য বেশি। কিন্তু লাভজনক এবং সবচেয়ে বেশি অর্থকরী মাছ হিসেবে পরিচিত কার্প জাতীয় মাছের আহরণের চিত্র ছিল খুবই হতাশাজনক।
বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের সহকারী বিপণন কর্মকর্তা শোয়েব সালেহীন জানান, পুরো কাপ্তাই হ্রদ এলাকায় ধরা পড়া মাছ আহরিত মাছ হিসেবে ধরা হয়। আর যেসব মাছ বিএফডিসির বিপণনকেন্দ্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্নস্থানে বাজারজাতকরণ করা হয় সেগুলো অবতরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থানীয় মাছের চাহিদা আহরিত মাছের হিসেবে ধরা হয়,যেগুলো রাজস্বের সাথে সম্পর্কিত নয়, কিন্তু উৎপাদনের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক, নৌ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম জানান, 'কাপ্তাই হ্রদে ২০২০-২১ অর্থবছরে অন্যান্য অর্থবছরের চেয়ে মাছ অবতরণ কমেছে। এতে করে বিএফডিসির রাজস্ব আদায় কমেছে। এই অর্থবছরের প্রথম দিকে পানিস্বল্পতার কারণে আমাদের অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে ব্যাপকহারে মাছ ধরা পড়েছে। তাই শেষ সময়ে এসে অবতরণ হ্রাস পেয়েছে। তবে আমরা আশা করছি, আগামী মৌসুমে মাছের উৎপাদন ধারাবাহিকতায় ফিরে যেতে পারব। এক্ষেত্রে হ্রদে মাছ ধরার শুরুর আগে থেকে পানি বাড়ে কিনা সেটি দেখার বিষয়। পানি না বাড়লে এই অর্থবছরের মতো স্বল্প পানিতে মাছ ধরা পড়ে গেলে শেষের দিকে রেকর্ড পতন হতে পারে'।
তিনি আরো বলেন, 'আমরা এসব বিষয়কে মাথায় রেখেই এবার ১ মে মাছ আহরণ বন্ধের পরদিনই (২ মে) হ্রদে মাছের পোনা অবমুক্ত করেছি। যদিও অন্যান্য বছরে সেটি আরো দেরিতে করা হতো। এবার শুরুতেই মাছের পোনা অবমুক্ত করার কারণে মাছ বড় হতে সময় পাবে এবং আদর্শ আকার হয়ে উঠবে। এ বছর আমরা কাপ্তাই হ্রদে বিএফডিসির নিজস্ব হ্যাচারিতে উৎপাদিত ৫০ মেট্রিক টন কার্পজাতীয় মাছের পোনা অবমুক্ত করেছি। যা অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি'।

তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'এই বছর হ্রদে ৪৬ টন রুই কাতল ও মৃগেল মাছের পোনা ছাড়ার পাশাপাশি আমরা ১ হাজার শোল এবং ৫০০ চিতল মাছও ছেড়েছি। যেহেতু একসময় এই হ্রদে বড় বড় চিতল ও শোল মাছ পাওয়া যেতো। আগামীতে আমরা বিলুপ্তির পথে থাকা মহাশোলসহ অন্যান্য মাছের পোনা সংগ্রহ করে হ্রদে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়েছি,যাতে করে হ্রদের সুদিন ফিরিয়ে আনা যায়'।
রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোঃ হারুনুর রশীদ বলেন, 'গেল বছর কাপ্তাই হ্রদের মাছ আহরণ-অবতরণ দুটোই কম হয়েছে। এতে করে জেলে-ব্যবসায়ী ও সরকার সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মৎস ব্যবসায়ীরা সবসময়ই দাবি করেন, হ্রদে মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণার পরপরই যেন মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়; যাতে করে পোনাগুলো তিনমাস সময়ে বড় হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু গত বছর মাছ আহরণ বন্ধের অনেক পরে পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। আবার হ্রদে পানির পরিমাণ কম থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ১০ দিন পর মাছ ধরা শুরু হয়। তাই কম পানিতে শুরুর দিকে বেশি পরিমাণ মাছ ধরা পড়ে। যে কারণে শেষের দিকে হ্রদে মাছ শূন্যতা দেখা দেয়। তাই আমাদের আহরণ-অবতরণ কমে যায়। তবে এই বছর ঠিকসময়ে মাছের পোনা ছাড়া হয়েছে। কিন্তু এখনো বৃষ্টিপাতের দেখা নেই! ফলে এবার কি হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না'।
কাপ্তাই হ্রদের অন্যতম বড় মৎস ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত মোঃ মাহাফুজ বলেন, 'হ্রদে মাছের উৎপাদন,আহরণ কিংবা অবতরণ, সবকিছুই কমছে। কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও সমন্বিত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। আগে হ্রদে যে হারে বড় মাছের দেখা মিলত,সেখানে এখন শতকরা ৮০ ভাগ মাছই কাঁচকি-চাপিলার মতো ছোট মাছ। এইভাবে চললে,এই হ্রদ নিয়ে আমাদের যে গর্ব সেটা থাকবে না। হ্রদের উপর নির্ভরশীল জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা পেশা ছাড়তে বাধ্য হবেন।'

পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন 'গ্লোবাল ভিলেজ রাঙামাটি'র প্রধান নির্বাহী সৈয়দ হেফাজত সবুজ বলেন, 'আমরা বহু বছর ধরেই বলে আসছি, হ্রদকে বাঁচাতে হবে। দূষণ,দখল এবং নৈরাজ্য থেকে যদি এই হ্রদকে বাঁচানো না যায়,তবে হ্রদের সামগ্রিক ইকোসিস্টেমেই এর প্রভাব পড়বে। এখন সেটাই হচ্ছে। হ্রদ থেকে বড় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে, যা আছে তাও নগণ্য। পোনা ছাড়া হচ্ছে ঠিক, কিন্তু সেই পোনা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারছে না। অবৈধ কারেন্ট জাল,কাঁথা জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায়নি। মাছের ব্রিডিং গ্রাউন্ডগুলোকে আগের অবস্থায় ফেরানো যায়নি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে'।
প্রসঙ্গত,দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ মিঠা পানির জলাশয়সমূহের মধ্যেও সর্ববৃহৎ। কাপ্তাই হ্রদের আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। যা বাংলাদেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। ১৯৬১ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এ হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি রাঙামাটিতে মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে।
শুধু তাই নয়, মৎস্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে রাজস্ব আদায়েও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এই হ্রদটি। কাপ্তাই হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের বংশবৃদ্ধি, হ্রদে অবমুক্ত করা পোনা মাছের সুষম বৃদ্ধি, মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিতকরাসহ হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিবছরের পহেলা মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বছরের আগস্ট থেকে শুরু হয় নতুন মৌসুম। আগস্ট থেকে পরবর্তী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই নয় মাসকে মৌসুম ধরা হয়। সরকারি হিসেবে, কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে পুরো জেলার প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার জেলে। মাছ ধরা বন্ধকালীন সময়ে এই জেলেদের প্রতিমাসে ২০ কেজি করে ভিজিএফ সহায়তা প্রদান করে সরকার।