আইসিজের রায়ে প্রাথমিক বিজয় দেখছে রোহিঙ্গারা

রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তীকালীন আদেশকে প্রাথমিক বিজয় হিসেবে দেখছে রোহিঙ্গারা।
আদেশে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় চারটি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে আইসিজে। এ নির্দেশকে রোহিঙ্গা জাতিসত্তার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি বলে দাবি করেছে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি এনজিও ফোরাম (সিসিএনএফ) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা।
এটি নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরে পেতে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের হেগে আইসিজের প্রধান বিচারপতি আবদুলকাওয়ি আহমেদ ইউসুফ গণহত্যা কনভেনশনের আলোকে করা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বলা হয়, রাখাইনে গণহত্যায় দায়ী সেনাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। গণহত্যার আলামত নষ্ট করা যাবে না।
এ ছাড়া আদেশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি জানিয়ে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে মিয়ানমারকে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডাবল ‘ও’ জোনের মাঝি মাওলানা নুরুল আবছার বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগ (রাখাইন) যুবকরা রোহিঙ্গাদের ওপর বিচার-বর্হিভূত গণহত্যা চালিয়েছে। তারা অসংখ্য মুসলিম নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করেছে। ধর্ষণ করা হয়েছে অসংখ্য নারীকে; পুড়িয়েও হত্যা করা হয়েছে অনেককে।
‘‘আমরা ২০১৭ সালের পর থেকেই বিশ্ব দরবারে এ হত্যার বিচার দাবি করে এসেছি। গাম্বিয়ার সাহসী পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক আদালত রোহিঙ্গা জাতির আশার প্রতিফলন ঘটিয়েছে,’’বলেন নুরুল আবছার।
বালুখালী তানজিমার খোলা ক্যাম্পের বাসিন্দা সালামত খান বলেন, গণহত্যা বন্ধসহ মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে আদেশে স্পষ্ট বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, আদেশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি দেখলেই রোহিঙ্গারা নিজভূমিতে দ্রুত ফেরার উদ্যোগ নিতে পারে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের আচরণে হতাশ রোহিঙ্গারা আইসিজের আদেশে নতুন উদ্দীপনা খুঁজে পেয়েছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় যে চারটি নির্দেশনা দিয়েছে আইসিজে, মিয়ানমার তা পালন করলে ২০২০ সালের মধ্যে এ জনগোষ্ঠীর সবাই অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফেরত যেতে সক্ষম হবে।
ক্যাম্পের আরেক নেতা জাফর আনোয়ার বলেন, ‘‘আইসিজের আদেশে রোহিঙ্গা ছাড়াও পুরো বিশ্বের নির্যাতিত জনগোষ্ঠী আলোর মুখ দেখেছে।
“বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে রোহিঙ্গারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আজীবন ঋণী থাকবে।’’
টেকনাফের জাদিমুরা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মো. ইদ্রিস বলেন, ২৩ জানুয়ারির রায়কে ঘিরে রোহিঙ্গারা যাতে কোনো প্রকার মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ না করে সে ব্যাপারে ক্যাম্প কমিটির পক্ষে বলে দেওয়া হয়। ফলে রোহিঙ্গারা শুধু সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন, টিভি চ্যানেলের খবর দেখেছে।
তিনি বলেন, আইসিজের আদেশের পর টেকনাফ-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি মসজিদে নামাজের পর মোনাজাতে বাংলাদেশ ও গাম্বিয়া সরকার এবং রোহিঙ্গাদের ইস্যুতে সহযোগিতাকারী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের প্রতি শুকরিয়া জানানো হয়েছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন হলে রোহিঙ্গারা দ্রুত ফিরে যেতে পারবে। এতে দ্রুত ভোগান্তিমুক্ত হবে এ অঞ্চল।
আইসিজের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় সিসিএনএফের কো-চেয়ার আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক আদেশ। নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরে পেতে এটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করবে। এ আদেশের ফলে রোহিঙ্গা জাতিসত্তার স্বীকৃতির পাশাপাশি গণহত্যার বিষয়টিও স্বীকৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, “আদেশ বাস্তবায়ন হলে রোহিঙ্গারা সম্মানজনক অবস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে স্বদেশে ফিরে গিয়ে বসবাস করতে পারবে, যেটির জন্য অতীত সময়ে আমরা বারবার তাগাদা দিয়ে এসেছি।”
মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চলছে অভিযোগ করে গত বছরের নভেম্বরে আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া।
মামলায় বলা হয়, মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদ লঙ্ঘন করেছে।
মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে অপরাধ দমনের অজুহাতে অভিযানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালায় সেনারা।
ওই সময় থেকে প্রাণ রক্ষায় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এমন বাস্তবতায় গাম্বিয়া আরও ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিতে আইসিজের কাছে আবেদন করে।
নেদারল্যান্ডসের হেগের পিস প্যালেসে গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর ওই মামলার শুনানি হয়। তাতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু।
অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রতিনিধি ছিলেন দেশটির কার্যত নেতা অং সান সু চি।
গাম্বিয়া ও মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ।