অতীতের রাজধানী: কেমন ছিল ঢাকার কার্জন হল, মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড, ভুলভুলাইয়া বা দিলখুশা…

বহমান সময়ের স্রোতে কত কিছুই তো হারিয়ে যায়। কিন্তু হারিয়ে গেলেও পুরোনো কিছুর মায়া থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারে?
জানামতে, পুরোনো জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বরাবরের। আবার হারিয়ে যাওয়ার পর সেগুলো হয়ে ওঠে অমূল্য। অতীত, ইতিহাসের সাক্ষ্য কিংবা স্মৃতির গন্ধ খুঁজে পেতে মানুষ আজও আগ্রহী।
তেমনি ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যগুলোও এমনই স্মৃতির এক জলছবি যেন!
ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যের কিছু ছবি আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন যিনি, তিনি ব্রিটিশ নাগরিক ফিলিপ থর্ন্টন। নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন ঢাকার হারিয়ে যাওয়া এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্যের দুর্লভ কিছু ছবি।
থর্ন্টনের সংগৃহীত সেসব ছবি শুধু চমৎকারই নয়, বরং ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপত্যের এক অমূল্য দলিল। ভিক্টোরিয়ান যুগের আর্কিটেকচার থেকে শুরু করে মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন—ঢাকার ঐতিহাসিক সেসব স্থাপত্য আমাদের নিয়ে যায় অতীতে। সময় বদলেছে, পাল্টেছে ঢাকার চেহারাও। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে অনেক স্থাপত্যও। আবার অনেক কিছুই পরিণত হয়েছে কেবল স্মৃতিচিহ্নে।
আজকের লেখা যে-সব স্থাপনা নিয়ে, সেগুলো টিকে আছে এখনো। তবে রূপের যে হেরফের হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু টিকে আছে ভগ্নাংশ হয়ে, কিছু আছে বহাল তবিয়তে।

বড় কাটরা
ঢাকা ছিল মুঘলদের প্রাদেশিক রাজধানী। পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হতো একজন সুবাদারকে। বাংলা তখন সুজলা, সুফলা—ফলে-ফসলে ভরপুর এক অঞ্চল। এক বাংলার আয়ে যা হতো, তা অন্য দুই বা তিন প্রদেশ থেকেও হতো না।
আগ্রা বা দিল্লির তখতে বসা মুঘল বাদশাহ তাই বাংলার সুবাদার নির্বাচন করতেন বড় হিসাব করে। কারণ ভুল লোক বসলেই নয়-ছয় তো বটেই, বিদ্রোহও হতে পারত। টাকার টান কে সামলাতে পারে?
মমতাজপ্রেমী মুঘল বাদশাহ শাহজাহানের বড় ছেলে ছিলেন শাহ সুজা। তার লোভ ছিল কম—অন্তত দেখেশুনে তাই মনে হতো। দাদা জাহাঙ্গীরেরও পেয়ারের ধন ছিলেন সুজা। উপরন্তু, তিনি ছিলেন আজম খানের জামাতা।
আজম খান ছিলেন শাহজাহানের আমলে বাংলার দ্বিতীয় সুবাদার। তাই সব মিলিয়েই বাংলার সুবাদারির উপযুক্ত ধরা হয়েছিল সুজাকে। ১৬৪১ সালে সুজা বাংলা ও বিহারের সুবাদার নিযুক্ত হন এবং ১৬৬১ সাল পর্যন্ত বহাল থাকেন—মোট ২০ বছর।
সুবাদার থাকাকালে সুজা ঢাকায় একটি জবরদস্ত স্থাপনা নির্মাণের হুকুম দেন তার দিওয়ান আবুল কাশিমকে। আবুল কাশিম ছিলেন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। সুজা প্রথমে ভেবেছিলেন নিজেই থাকবেন এখানে। কিন্তু পরে কোনো কারণে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে একে সরাইখানা করার নির্দেশ দেন। সে থেকেই এটি কাটরা বা সরাইখানা।

চকবাজারের দক্ষিণে, বুড়িগঙ্গার পাড়েই বড় কাটরা। এখন আর খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই এ রাজকীয় স্থাপনার।
এটি ছিল আয়তাকার। তিন তলা সমান উচ্চতার সিংহদ্বারটি ছিল দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশপথের দুপাশে দুটি প্রহরীকক্ষ ছিল। প্রবেশপথের পরেই ছিল একটি বড় হলরুম, যার ছাদ ছিল গম্বুজাকৃতি আর তাতে ছিল লতাপাতার কারুকাজ। কাটরার ভেতরে দোতলা ও তিন তলায় ওঠার সিঁড়ি ছিল।
শাহ সুজা মীর আবুল কাশিমকে কাটরা ব্যবহারের দায়িত্ব দেন এ শর্তে যে, এ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণ কাটরায় অবস্থানকারীদের নিকট থেকে কোনো ভাড়া গ্রহণ করবেন না।
ঢাকায় সরাইখানা আরও ছিল, তবে বড় কাটরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
বড় কাটরায় বণিক বা পর্যটকদের জন্য ২২টি কক্ষ ছিল। কাটরার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য নিচে দোকান গড়ে দেওয়া হয়েছিল। সে আমলে ঢাকা বণিকদের পদচারণায় মুখর ছিল। নৌপথে বড় বড় বজরা এসে ভিড়ত। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঢাকা হয়ে সহজ ছিল। তাই সরাইখানা বণিকদের প্রভূত কাম্য ছিল।
কাটরার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার ছিল—এটি ব্যবহৃত হতো শুল্ক আদায় দপ্তর হিসেবেও।

আজ বড় কাটরার অনেকখানিই দখল হয়ে গেছে। ব্যবহৃত হচ্ছে গুদামঘর হিসেবে। হয়তো একদিন এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে স্মৃতি রেখে যাবে বহুদিন—তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ঢাকা মেডিকেল
আজকের যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ভবন, শুরুর দিকে সেটি কলেজের কোনো নিজস্ব ভবনই ছিল না।
১৯০৪ সালে বঙ্গভঙ্গের পর নবগঠিত বাংলা ও আসাম প্রদেশের জন্য একটি সচিবালয় ভবন তৈরির প্রয়োজন দেখা দেয়। ভবনটি নির্মিতও হয়ে যায়—দোতলা একটি ভবন, সামনে প্রশস্ত মাঠ। গাছপালা বলতে তেমন একটা ছিল না।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। ফলে ভবনের মূল কাজও মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ভবনটি বিভিন্ন কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে যায়। এর একাংশে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র, আরেকটি অংশে ছাত্রাবাস, আর অবশিষ্টাংশে কলা অনুষদের শিক্ষা ভবন। এভাবেই ভবনটির ব্যবহার চলছিল।
১৯৩৬ সালের দিকের কথা। পূর্ববঙ্গের মানুষেরা একটি হাসপাতালের প্রয়োজনবোধ করতে শুরু করেন। দাবির যৌক্তিকতা দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে। তারা সচিবালয় ভবনটিকে হাসপাতাল করার দাবিতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন।

এর মধ্যেই প্রক্রিয়া শুরু হলেও সরকারের আনুষ্ঠানিকতা দেরিতে হতে থাকায় বিপত্তি বাধে।
ঠিক তখনই শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় মার্কিন বাহিনী ভবনের কিছু অংশ হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। যুদ্ধ শেষ হলে মার্কিনীরা ফিরে যায়। এরপর ১৯৪৬ সালে ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হিসেবে।
ঢাকার তৎকালীন সিভিল সার্জন মেজর ডব্লিউ জে ভারজিনকে দেওয়া হয় কলেজের প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব।
সেন্ট টমাস চার্চ, জনসন রোড
পুরোনো ঢাকার পুরোনো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখনো অবিকৃত দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট টমাস চার্চ। এখন আর দম নেই চার্চের ঘড়িটিতে, তবে স্মৃতি হিসেবেও এর মূল্য কম নয়। জনসন রোডে চলাচলকারীদের সৌভাগ্য, তারা দেড়শ বছর পুরোনো একটি ঘড়ি দেখতে পান—যদিও সেটি দেখে আর সময় মেলানো যায় না। সারা পৃথিবীতে সে আমলে বিগ বেন কোম্পানির বানানো টিকে থাকা দুটি ঘড়ির মধ্যে এটি একটি। ঘড়িটি দেখা যায় সেন্ট টমাস চার্চের ক্লক টাওয়ারে।
বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে নবাবপুরের দিকে যে রাস্তাটি গেছে, সেটি জনসন রোড। সেন্ট টমাস চার্চ জনসন রোডের পূর্বপাশে, উল্টোদিকে জজ কোর্ট।

১৮১৯ সালে চার্চটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৮২৪ সালে কলকাতার বিশপ হেবার ঢাকা বেড়াতে এসে এটি উদ্বোধন করেন। কথিত আছে, জেলবন্দিরা চার্চটির নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন।
উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান খ্রিস্টধর্ম প্রচারকারী সেন্ট টমাসের নামানুসারে এর নাম রাখা হয়। এটি চার্চ অব বাংলাদেশ নামেও পরিচিত।
চার্চের সদর দরজা পেরুলেই যেন প্রশান্তির জগতে প্রবেশ করা হয়। বাইরের কোলাহল থেকে মুক্তি মেলে নিমিষেই। চার্চের প্রাঙ্গণ সুপরিসর, প্রাচীর ঘিরে আছে বৃক্ষরাজি। ভেতরের পরিবেশ ভাবগম্ভীর, বেশি কারুকাজ নেই গথিক রীতির চার্চটিতে।
দুইশ বছর ধরে প্রায় একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রার্থনাগৃহটি, যদিও ২০০৭ সালে একবার সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
কার্জন হল
তখন ঢাকায় তেমন কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি স্থাপনা ছিল না। অথচ বঙ্গভঙ্গের সময় ঢাকার গুরুত্ব ছিল পাহাড়সম। কারণ বাংলা ভাগ হলে পূর্ব বাংলার রাজধানী হবে ঢাকা। বিষয়টি বুঝতে পেরে ব্রিটিশরাও নড়েচড়ে বসেন। তারা ঢাকায় বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দেন। কার্জন হল সেসব স্থাপনার একটি।
ঢাকা তখনো রাজধানী হয়নি। আজকের ঢাকার যে শহুরে রূপ, সেটিও ছিল না। চেহারা-সুরত ছিল নিতান্তই মফস্বল কোনো এলাকার মতো।

১৯০৯ সালে লন্ডনের দি টাইমস পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় দুই থেকে আড়াই মাইল দূরত্বে একটি রাস্তা ছিল, যা পুরাতন রেসকোর্সের পাশে দিয়ে দক্ষিণ প্রান্তে গিয়েছিল। এ রাস্তায় সরকারি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছিল, যার পশ্চিম প্রান্তে ছিল নতুন সচিবালয় এবং পূর্ব প্রান্তে সরকারি ভবনের মুখোমুখি ছিল ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ—যার অন্তর্গত বিখ্যাত কার্জন হল।
এছাড়া, 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' গ্রন্থে মুনতাসির মামুন এক অজানা লেখকের বর্ণনায় কার্জনের হাল-হাকিকত তুলে ধরেন—
'যেখানে এককালে পেঁচা ডাকত
ছোট-বড় ঝোপঝাড়ে শেয়াল চিৎকার করত
আজ সেখানে গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে
অতুলনীয় এক প্রহরী—কার্জন হল।'
সময়টা ১৯০৪ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব বাংলা সফরে আসেন লর্ড কার্জন। তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু হেন্ডারসন লেথ ফ্রেজার তাকে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে সংবর্ধনা জানান। লর্ড কার্জন ঢাকার নানা স্থান ঘুরে দেখেন। তারপর ১৯ ফেব্রুয়ারি 'কার্জন হল'-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯০৮ সালে শেষ হয় এর নির্মাণকাজ। তবে কার্জন হল মূলত কী হিসেবে নির্মিত হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ববিদ আহমাদ হাসান দানী লিখেছেন, 'কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল টাউন হল হিসেবে।'
তবে এ মত খারিজ করে দেন শরীফ উদ্দীন আহমদ। তিনি তার এক প্রবন্ধে বলেন, 'টাউন হল হিসেবে নয়, বরং কার্জন নির্মিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে। আর এটি নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন ভাওয়ালের রাজকুমার।'
এ তথ্যের সত্যতা মেলে ১৯০৪ সালের 'ঢাকা প্রকাশ'-এর একটি প্রতিবেদন থেকে।
সেখানে লেখা হয়—
'ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এ কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল ডাক্তার রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমণ উপলক্ষ্যে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ এ অঞ্চলে লর্ড কার্জন বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তে 'কার্জন হল' নামে একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।'
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এলেই ঐতিহাসিক কার্জন হলের কথাও আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের জন্য ব্যবহৃত এ ভবন ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন। ইউরোপ ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণে নির্মিত এটি। বলা যায়, ঐতিহাসিক শিল্পের সঙ্গে এ ভবনে মিশ্রিত হয়েছে আধুনিক কারিগরি বিদ্যা।

নর্থব্রুক হল
কার্জনের ন্যায় নর্থব্রুক হলকেও ইউরোপ এবং মুঘল স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণে তৈরি পুরান ঢাকার আরও একটি স্থাপনা হিসেবে বলা যেতে পারে। স্থানীয়দের কাছে এটি 'লালকুঠি' নামে পরিচিত, সম্ভবত লাল ইটের প্রাচীরঘেরা বলেই এমন নাম। সুদৃশ্য এ ভবনটি ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ওয়াইজঘাট এলাকায় অবস্থিত। জানা যায়, এটি মূলত একটি নগর মিলনায়তন হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে আসেন। সেই সফরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই নর্থব্রুক হল নির্মাণ করা হয়। ১৮৭৯ সালের শেষের দিকে ভবনটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ঢাকার স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা গভর্নর জেনারেল নর্থব্রুকের সম্মানে এ ভবনের নাম রাখেন 'নর্থব্রুক হল'।
তখন ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী হলটি নির্মাণের জন্য ১০ হাজার টাকা দান করেন। ১৮৮০ সালের ২৫ মে ঢাকার তৎকালীন কমিশনার আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। সে সময় পদস্থ রাজকর্মচারী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সভা এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম এ ভবনে আয়োজিত হতো।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে ভবনটি দৃষ্টিনন্দন হয়ে ধরা দিত এককালে। নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে অবস্থান করা ভবনের গাঢ় লাল রঙের বিশাল গম্বুজ, সুউচ্চ চূড়া ও নিচু পাঁচিল নদীর সৌন্দর্যের সঙ্গে একাকার হয়ে যেত। ভবনটির পাশ দিয়ে যে সড়কটি ছিল, সেটি পরিচিত ছিল 'নর্থব্রুক হল রোড' নামে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। নদী দখল হতে হতে ছোট হয়েছে, পানির রঙেও এসেছে পরিবর্তন।
বর্তমানে ভবনের চারপাশে নির্মিত হয়েছে সম্মেলন কেন্দ্র ও গণ-মিলনায়তনের মতো নতুন কাঠামো, যা নর্থব্রুক হলের আকর্ষণ অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। জরাজীর্ণ ভবনে পরিণত হওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে এটি মিলনায়তন হিসেবে আর ব্যবহৃত হচ্ছে না।

মিটফোর্ড হাসপাতাল
মিটফোর্ডের স্ত্রী এলিজাবেথ এবং বান্ধবী অ্যাপোলিন যদি বাগড়া না দিতেন, তবে হাসপাতালটি গড়ে উঠত আরও আগে। দেড় লক্ষ টাকার জায়গায় পাওয়া যেত প্রায় আট লক্ষ টাকা।
রবার্ট মিটফোর্ড (১৭৮২-১৮৩৬) ছিলেন ঢাকা জেলার কালেক্টর এবং ঢাকা প্রাদেশিক আপিল ও সার্কিট আদালতের বিচারক। তিনি ইংল্যান্ডের নর্দাম্বারল্যান্ডের অভিজাত মিটফোর্ড পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার পিতা জন মিটফোর্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চীনা বাণিজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।
১৭৯৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবার্ট মিটফোর্ড কোম্পানির রাইটার হিসেবে চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে আসেন। তখনকার দিনে মেধা ও দক্ষতা দিয়ে প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন রাইটাররা। কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও বিহারে চাকরি করার পর ১৮১৬ সালে তিনি ঢাকা জেলার কালেক্টরের পদ গ্রহণ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই একজন যোগ্য কালেক্টর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
চার বছর পর তিনি বিচার বিভাগীয় পদে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেন এবং তার আবেদন গৃহীত হলে বিচারক নিযুক্ত হন। ১৮২৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ত্রিশ বছর চাকরি করে এ পদ থেকেই অবসরে যান। ১৮২৮ সালে দেশে ফেরার পর ১৮৩৬ সালে প্যারিস ভ্রমণে গিয়ে মারা যান।

মিটফোর্ড ঢাকায় কর্মরত থাকা অবস্থায় একবার কলেরা মহামারির আকার নেয়। প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ মানুষ মারা যাচ্ছিল, কিন্তু চিকিৎসা সুবিধা ছিল না বললেই চলে। মানুষের দুর্দশা দেখে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। মৃত্যুর আগে তিনি যে উইল করে যান, তাতে তার বেশিরভাগ সম্পত্তি ঢাকার মানুষের কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
কিন্তু তার স্ত্রী ও বান্ধবী উইলের বিরোধিতা করে মামলা করেন। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন আদালতে এ মামলা চলতে থাকে এবং এতে বহু আত্মীয়স্বজন, ব্রিটিশ সরকার ও ভারত সরকার জড়িয়ে পড়ে। মামলাটি ১৮৫০ সাল পর্যন্ত গড়ায়। পরে লন্ডনের হাইকোর্টের চান্সারি বিভাগ উইলকে বৈধতা দিয়ে রায় দেয় এবং মিটফোর্ডের সম্পদ ও অর্থের অবশিষ্টাংশ ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকার কিছু বেশি। এ অর্থেই ১৮৫৪ সালে হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। আগে এখানে একটি ওলন্দাজ কুঠি ছিল। হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে পৌরসভার ওপর।
১৮৮২ সালে ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহ এবং ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের দানে একটি মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৭ সালে একটি ইউরোপিয়ান ওয়ার্ড এবং ১৮৮৯-৯০ সালে ভাগ্যকুলের রাজা শ্রীনাথ রায় তার মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিন লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি চক্ষু বিভাগ স্থাপন করেন।

১৯১৭ সালে এটি প্রথম শ্রেণির হাসপাতালের মর্যাদা পায়। বুড়িগঙ্গার তীরে ১২.৪ একর জমির ওপর নির্মিত হাসপাতালটি বর্তমানে ১৪টি ব্লকে গঠিত। প্রথমে অধিকাংশ ব্লক একতলা ছিল, যা এখন চারতলা হয়েছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ১,০০০ রোগী সেবা পান।
সুপ্রিম কোর্ট
ঢাকার আরও একটি পুরাতন স্থাপনা হলো সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং। আজকের যে সুপ্রিম কোর্ট, তা ব্রিটিশ আমলে এমন কোনো কোর্টের উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়নি।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হয়। তখন প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ তৎকালীন পুরো রমনা অঞ্চল নতুন প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল ছিল। সে সময় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা ব্যাপক উন্নয়ন লাভ করে। নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে ঢাকার মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
ব্রিটিশরা ঢাকাকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার নানা প্রকল্প হাতে নেয়। নতুন প্রদেশকে কেন্দ্র করে শহরে বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনা গড়ে উঠতে থাকে।

১৯০৫ সালের কথা। যোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলার নতুন প্রদেশের প্রথম গভর্নর হিসেবে (১৯০৫-১৯০৬) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন রাজধানী হিসেবে ঢাকা নতুনভাবে গড়ে উঠতে শুরু করে। প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবন হিসেবে একটি ভবন নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয়। ভবনটি তৈরি হলেও তা কখনও গভর্নরের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।
দীর্ঘদিন ফাঁকা পড়ে থাকার পর ভবনটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। একসময় এখানে ঢাকা কলেজ পরিচালিত হয়। পরে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট সভা (বর্তমানে সিনেট) আয়োজনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রদেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেনস্ অ্যাক্ট, ১৯৪৭--এর অধীনে একটি পৃথক হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বা ঢাকা হাইকোর্ট নামে পরিচিতি লাভ করে।
সে সময় এ হাইকোর্ট তৎকালীন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের গভর্নরের জন্য নির্মিত বাসভবনে স্থাপিত হয়। হাইকোর্ট স্থাপিত হওয়ার পর ভবনটি হাইকোর্ট বিল্ডিং হিসেবে পরিচিতি পায়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের সময়কালে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন নামে খ্যাত হয়।

ভারত বিভক্তির পর পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডে গভর্নর হাউসে স্থাপিত ঢাকা হাইকোর্টই ছিল প্রথম হাইকোর্ট। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সালেহ মুহাম্মদ আকরাম (১৮৮৮-১৯৬৮)।
ভুলভুলাইয়া, দিলখুশা
ঢাকায় ভুলভুলাইয়া ছিল, এটি শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন। লখনউয়ের ভুলভুলাইয়া যেমন খ্যাতি পেয়েছিল, ঢাকারটি ততটা পরিচিতি লাভ করেনি, ফলে এটি অনেকের অজানা থেকে গেছে।
উনিশ শতকের শেষভাগেও দিলখুশা ছিল বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর। জনবিরল হওয়ায় দক্ষিনী সুলতানি আমলে হজরত শাহজালাল এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন। মুঘল আমলে সুবাদার মির জুমলার অধীনে মির্জা মুকিম এ এলাকার (তখনকার নওয়ারা মহল) তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
তিনি পুরানা পল্টন ময়দানের দক্ষিণে বাস করতেন। তার বাড়ির ভেতরে ও বাইরে দুটি উঁচু ঢিবি ছিল, যার একটি এখনো বঙ্গভবনের ভেতরে রয়েছে।
১৮৬৬ সালে নওয়াব আব্দুল গনি ইএফ স্মিথ নামের এক ইংরেজের কাছ থেকে খোলা জায়গাটির বড় অংশ কিনে নেন। পরে তিনি পুত্র আহসানউল্লাহর জন্য একটি সুদৃশ্য ও জাঁকালো বাগানবাড়ি নির্মাণ করান, যার নাম দেন দিলখুশা। ফারসি এ শব্দের অর্থ 'হৃদয়ে আনন্দ দানকারী'।

ইরানের বিভিন্ন শহরে এমন নামের ঐতিহাসিক বাগান রয়েছে, যার মধ্যে সিরাজ শহরের বাগানটি উল্লেখযোগ্য। ১৮৮৮ সাল থেকে আহসানউল্লাহ তিন বছর এ বাড়িতে বসবাস করেন, কারণ একটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ বাগানবাড়িতে এ অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
১৮৮৫ সালে সংস্কৃত ভাষার মান পরীক্ষা করতে একজন ইতালিয়ান পণ্ডিত এদেশে আসেন। তার সম্মানে স্থানীয় পণ্ডিতদের সমবেত করে এখানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১৮৮৮ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার স্টুয়ার্ট বেইলিকে দিলখুশায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯০২ সালে ছোটলাট উডবার্ন ঢাকা সফরে এসে দিলখুশায় খাজা সলিমুল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করেন। ১৯০৬ সালে ছোটলাট ফুলারের স্ত্রী দিলখুশা বাগানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মানে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন।
১৮৭৩ সালে আহসানউল্লাহ বাড়ির দক্ষিণ পাশে একটি বড় পুকুর খনন করান, যার নাম দেওয়া হয় ডানা দিঘি। পুকুরের ইট বাঁধানো ঘাটে আরামের জন্য একটি হাওয়াখানা নির্মাণ করা হয়।

দিলখুশা বাগানে একটি সর্পিলাকার হ্রদ, কয়েক ধরনের ঝর্ণা, বর্গাকার পুকুর এবং নানা রকম ফুল ও ফলের গাছ ছিল। বাগানের কেন্দ্রস্থলে এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা ছিল ভুলভুলাইয়া। তবে ভুলভুলাইয়ার উচ্চতা ও অন্যান্য বিশদ বিবরণ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।
দিলখুশায় একটি ড্রইংরুম ছিল, যার নাম ছিল বারো দুয়ারি। এটি সব দিক থেকে খোলা ছিল। প্রবেশমুখের পাশে একটি কৃত্রিম হ্রদ ছিল, যেখানে কুমির রাখা হতো। পাশের খেলার মাঠে শীতকালে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো।
বর্তমানে ভুলভুলাইয়া এবং দিলখুশা বাগানবাড়ির কিছুই অবশিষ্ট নেই।
ঢাকার এসব জরাজীর্ণ স্থাপত্য হয়তো দেখলে বিশেষ কিছু মনে হবে না, তবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আকাশচুম্বী। থর্ন্টনের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ মানুষের জানার আগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথাও মনে করিয়ে দেয়—এ কথা বললে হয়তো ভুল হবে না।