নেপাল-কৌশলেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য প্রচারের লড়াইয়ে নেমেছে ভারতীয় গণমাধ্যম

২০২০ সালে একটি বিতর্কিত অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে ভারত ও নেপালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা তীব্র হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি দৃঢ় অবস্থান নেন। তিনি দেশটির নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেন, যেখানে বিতর্কিত অঞ্চলটিকে নেপালের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। অলি এই মানচিত্র সংসদে অনুমোদন করান।
ভারত এ ঘটনাকে সহজভাবে মেনে নেয়নি।
তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল এমএম নারাভানে দাবি করেন, নেপালকে রাস্তা নির্মাণের বিরোধিতা করতে উসকানি দিয়েছে চীন। একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যম নেপালের বিরুদ্ধে কঠোর প্রচারণা শুরু করে।
রিপাবলিক টিভি-র উপস্থাপক অর্ণব গোস্বামী একটি অনুষ্ঠানে তার উচ্চস্বরে কথা বলার ভঙ্গিতে প্রশ্ন তোলেন, "নেপালে কী হচ্ছে? চীনারা কি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে?"
ভারতীয় গণমাধ্যম নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির বিরুদ্ধে চীনা রাষ্ট্রদূত হৌ ইয়ানছির সঙ্গে একটি "মধুর সম্পর্ক" তৈরির গল্প প্রচার করে। জি হিন্দুস্তান তাদের ইউটিউব চ্যানেলের একটি প্রতিবেদনে [পরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে] দাবি করে, অলি তার "হৃদয় হারিয়ে ফেলেছেন" এবং "চীনা ফাঁদে পড়ে ভারত-নেপাল সম্পর্ক নিয়ে দর-কষাকষি করতে বাধ্য হয়েছেন"।
পরবর্তীতে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট তাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, জি হিন্দুস্তানের প্রতিবেদন হৌ ইয়ানছিকে "চীনা গুপ্তচর" এবং "বিষকন্যা" হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের এ ধরনের বিতর্কিত প্রচারণার মধ্যে "হানিট্র্যাপ"-এর গল্প তুলে ধরে অলির দৃঢ় অবস্থানকে অবমূল্যায়নের প্রচেষ্টা স্পষ্ট ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, নেপাল কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়।
দিল্লির প্রতি বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের পতনের পর বাংলাদেশ এখন ভারতীয় গণমাধ্যমের নতুন লক্ষ্য। ভারতীয় টিভি সংবাদ উপস্থাপকরা বাংলাদেশকে নিয়ে যে আক্রমণ চালাচ্ছেন, তা নেপালের বিরুদ্ধে তাদের আগের আক্রমণের তুলনায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক।
পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনার সময় কিছু ভারতীয় সাংবাদিক সামরিক পোশাক পরেছিলেন। তেমনটা এবার হয়ত পরেননি, তবে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে হাস্যকরভাবে আক্রমণাত্মক বক্তব্য রেখেছেন; ক্যামেরার সামনে লাফিয়েছেন, দৌড়ে চলে গেছেন।
কেউ কেউ পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পেঁয়াজকে অস্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর সাথে যোগ হয়েছে, একের পর এক মিথ্যা প্রতিবেদন। পুরো ভারতীয় মিডিয়ায় এমন মিথ্যা প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার ৬ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ৪৯টি ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা খবর প্রচার করেছে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর ছড়ানোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বিজেপি-র 'মুখপত্র' রিপাবলিক বাংলা। টিভি চ্যানেলটি পাঁচটি মিথ্যা খবর প্রচার করেছে। এছাড়াও হিন্দুস্তান টাইমস এবং লাইভ মিন্ট তিনটি মিথ্যা খবর প্রকাশ করেছে এই সময়ের মধ্যে। তালিকায় আরও রয়েছে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডাব্লিউআইওএন, সিএনএন-নিউজ ১৮ ইত্যাদি।
আবার, ইন্ডিয়া টুডে বিভিন্ন 'সূত্র'-এর বরাত দিয়ে রিপোর্ট করেছে, বাংলাদেশ সীমান্তে তুর্কি ড্রোন মোতায়েন করেছে এবং ভারত উচ্চ সতর্কতার মধ্যে রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস এই সংবাদকে মিথ্যা এবং সাজানো হিসেবে খারিজ করেছে।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের বক্তব্যকে উল্লেখ করে সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস জানায়, "বাংলাদেশ তার রুটিন কার্যক্রম ছাড়া দেশের কোথাও কোনো ড্রোন মোতায়েন করেনি।"
ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে যে-সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের মতে সেগুলো শিল্প পর্যায়ের তথ্য বিকৃতি এবং ভুল তথ্য দিয়ে ভরা।
এই অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলা একটি বাস্তব সমস্যা। তবে ভারতেও মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলার ইতিহাস গুরুতর। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও, মন্দির ও সম্পত্তির ওপর হামলার যে ঘটনা ঘটে তা ভারতের তুলনায় অনেক কম।
তবে, "কী হলো?" এ ধরনের যুক্তি বাদ দিয়ে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে উত্থান এবং রাজনৈতিক সহিংসতাকে একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে, যাতে তারা দেশটিকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করতে পারে। এর মাধ্যমে তারা তাদের সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছে এবং ভারতীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আরও দমন-পীড়নকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে তারা বিজেপির সমর্থন বাড়াচ্ছে।
তারা কীভাবে এটি করছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর একটি ভারতীয় অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। ভিডিওতে ভারতের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানুষ পদদলিত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা দেখা গেলেও সেটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হিন্দু নারী ও শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। এই ভিডিওটি হাজার হাজার মানুষ দেখেছে এবং শেয়ার করেছে।
এআই দিয়ে তৈরি করা কনটেন্ট এবং মন্দিরে ভাঙচুরের ভুল ভিডিওসহ ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপনের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচারণা চালিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো এসব প্রোপাগান্ডার সত্যতা যাচাই না করে, ভারতীয় গণমাধ্যম এই ধরনের মিথ্যাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আক্রমণ করছে।
ভারতের বাংলা সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ বিরুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিকর মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ এবিপি আনন্দ দাবি করেছে, "বাংলাদেশে হিন্দুদের দেখলেই আক্রমণ করা হয়।" আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হলে বিপদ হতে পারে। তাই বাংলাদেশে হিন্দু নারীরা সিঁদুর পড়ে বাইরে যেতে পারেন না।"
রিপাবলিক বাংলা চ্যানেলের উপস্থাপক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ প্রতিদিনের বাংলাদেশ বিরোধী মিথ্যাচারের পাশাপাশি, কীভাবে ভারত বাংলাদেশের কিছু অংশকে উপনিবেশিত করতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা ছড়াচ্ছেন।
রিউমার স্ক্যানার বেশ কিছু মিথ্যাচারের তালিকা প্রকাশ করেছে, যেমন– নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণ-এর আইনজীবী হিসেবে ভুল তথ্য প্রচার করা, ভারতের এক মূর্তি বিসর্জনের ভিডিওকে বাংলাদেশে মুসলিমদের আক্রমণে হিন্দু মূর্তি ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করা এবং শ্যামলি পরিবহনের একটি বাসে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মিথ্যা দাবি করা।
কয়েক সপ্তাহ আগে, ভারতীয় বিশ্লেষক যোগেন্দ্র যাদব নেপালের হিমাল খবরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে ভারতীয় মিডিয়া নেপালে-চীনের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতি সন্দেহ তৈরি করেছে। তিনি "নেপাল-ভারতের সম্পর্ককে শুধু ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তিতে দেখার" গুরুত্ব তুলে ধরেন।
সম্প্রতি আমরা নেপালের সাংবাদিক জগদীশোর পান্ডে-এর সাথে নেপাল এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা নিয়ে কথা বলেছিলাম।
পান্ডে বলেন, "[ভারতীয় মিডিয়া] নেপাল সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার করে এবং নেপালের মানুষ মনে করে, ভারত সব সময় ভুল খবর ছড়ায়। পররাষ্ট্র নীতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে, ভারতীয় গণমাধ্যম তাদের সরকার থেকেও বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। তাদের প্রতিবেদন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকেও বেশি পক্ষপাতদুষ্ট।"
তিনি আরও বলেন, "ভারত একটি বড় দেশ এবং এর একটি বড় বাজার রয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম সহজেই মিডিয়া সাক্ষরতার অভাব থাকা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিরক্ত করা উচিত নয়, কারণ তাদের প্রতিবেদন সামাজিক সম্প্রীতি, মানুষের মধ্যে সম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে।"
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়