Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Monday
December 15, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
MONDAY, DECEMBER 15, 2025
মিহাউ ও বেঙ্গলি সামার স্কুল: ইউরোপে বাংলার মাস্টারমশায়

ফিচার

নওরীন সুলতানা
17 May, 2024, 02:30 pm
Last modified: 24 June, 2024, 03:14 pm

Related News

  • রেললাইন নাশকতার অভিযোগে সর্বশেষ রুশ কনস্যুলেট বন্ধের ঘোষণা পোল্যান্ডের
  • পোর্টল্যান্ডে ট্রাম্পের ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দিলেন মার্কিন বিচারক
  • রাশিয়ার ‘ভুলবশত’ ড্রোন হামলা: আগ্রাসনের আশঙ্কায় পোল্যান্ডে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন হাজারো সাধারণ মানুষ
  • ন্যাটোর ৪ নং অনুচ্ছেদ সক্রিয় করার আহ্বান পোল্যান্ডের, এর অর্থ কী
  • পোল্যান্ডে রাশিয়ান ড্রোন: মস্কো বলছে, দেশটিকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর কোনো পরিকল্পনা নেই 

মিহাউ ও বেঙ্গলি সামার স্কুল: ইউরোপে বাংলার মাস্টারমশায়

বাংলাকে মিহাউ ভালোবেসে আপন করে নিয়েছেন। শুধু আপন করেই ক্ষান্ত হননি, বাংলাকে ইউরোপের সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসেই তিনি শুরু করেন বেঙ্গলি সামার স্কুল।
নওরীন সুলতানা
17 May, 2024, 02:30 pm
Last modified: 24 June, 2024, 03:14 pm

মিহাউ পানাসিউক। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

বাংলা ভাষার এই এক সৌন্দর্য, 
আসছি বলে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায়।

—সুভাষ মুখোপাধ্যায়

'আসছি' বলে এক পৃথিবী শূন্যতা রেখে হারিয়ে যাওয়া বোধহয় বাংলাতেই পারা যায়। এ যেন বাংলা ভাষার এক অদ্ভুত সুন্দর নিজস্বতা। ভাষা প্রাণের সুর, মানুষের সুর, তাই প্রতিটি ভাষা গড়ে ওঠে তার মানুষ, পরিবেশকে ঘিরে। প্রতিটি মানুষ তার আপন ভাষার চাতক। প্রত্যেকের নিজ ভাষা তার কাছে মেঘগলা বৃষ্টিজলের মতো। তার ঠান্ডা আদর ছাড়া মানুষের পিপাসা মেটে না। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব গল্প, ঘ্রাণ, সুর মিশে আছে যেন এর প্রতিটি শব্দে। যেমন স্নেহের গল্পটাই ধরুন না। মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ — স্নেহ উচ্চারণেই যেন বুকের ভেতরে কেমন আলতো আদর ভর করে। এত রঙে রঙিন স্নেহ ইংরেজিতে 'affection'-এ যেন কেমন বিবর্ণ হয়ে যায়। হাজার চোখ এড়িয়ে ভরা জ্যোৎস্নার রাতে নদীপারে প্রেমিকার গালে ফোঁটায় ফোঁটায় জমা ভালোবাসাকে প্রেমিকের আঙুলের ডগায় রেখে দেওয়ার উথাল-পাথাল যে তাড়না, তা যেন সযত্নে ধারণ করে আছে 'অভিসার' শব্দটি। সেই অভিসারকে ইংরেজি বেশভূষায় সাহেবি করতে গিয়ে গীতাঞ্জলির অনুবাদে তা হয়েছে 'Night of love'। আমরা বাংলায় হই প্রেমিক, হই উদাস, হই সহজিয়া।

প্রতিটি ভাষার নিজস্ব ঘ্রাণ, গল্প, সুরের মিশেলে সে ভাষাকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক নিজস্ব আত্মিকতার জগৎ। সে জগতে ভিনভাষার ভিনদেশি কেউ যখন ঠাঁই খুঁজে নেয়, তখন যেন সে ভাষার আত্মিক জগৎ যেন হয়ে ওঠে তারও জগৎ। এমনই এক ভিনদেশির গল্প বলব আজ — মিহাউ পানাসিউক — যিনি নিজে বাংলার স্নেহকে সাদরে গ্রহণ করে গত দশটি বছর ধরে বাংলা ভাষার জগতে প্রবেশ করাচ্ছেন বহু ভিনভাষার মানুষকে।

মিহাউ পানাসিউক ও বেঙ্গলি সামার স্কুল

হুমায়ূন আজাদ তার কতো নদী সরোবর বইটিতে লিখেছিলেন, 'কতোদিন আমি দূরদেশে, তিন বছর ধরে। বাসে চেপে পায়ে হেঁটে তুষার ঠেলে বন্ধুর বাসায় টোকা দিয়েছি শুধু একটু বাংলা বলবো বলে। শুধু একটু বাংলা শুনবো বলে।' বোধকরি, তিনি যদি এমন এক আকুলি-বিকুলি দিনে বাংলার মাস্টারমশাই মিহাউ পানাসিউকের সঙ্গে এক কাপ চায়ে একটুখানি আড্ডা দিতে পারতেন, হয়ত একটু হলেও শান্তি পেতেন। হালকা অবাঙালি উচ্চারণের ছাপেও তার ঝরঝরে বাংলায় চর্যাপদ বা মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে আড্ডাটা দারুণ জমত বৈকি।

অবাঙালি বাংলা বলছেন, বাংলা শেখাচ্ছেন সেটা সুন্দর, হতেও পারে ভালোবেসে শেখাচ্ছেন। কিন্তু এ মাস্টারমশাই আবার বাংলাটা তো জানেনই, সঙ্গে মধ্যযুগের সাহিত্যের নানা দিক, বৈষ্ণব পদাবলি নিয়ে অনর্গল গল্প করতেও জানেন পরম ভালোবাসায়।

বাংলাকে মিহাউ ভালোবেসে আপন করে নিয়েছেন। শুধু আপন করেই ক্ষান্ত হননি, বাংলাকে ইউরোপের সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসেই তিনি শুরু করেন বেঙ্গলি সামার স্কুল। কয়েক বছর আগে ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কথ্য বাংলা শেখানোর বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে বাংলা সামার স্কুল তৈরি করা হয়। এটি সারাবিশ্ব থেকে আগত 'বিগিনার' এবং 'অ্যাডভান্সড' শিক্ষার্থীদের জন্য দুই সপ্তাহের একটি ইন্টেন্সিভ কোর্স। অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাকে ছাত্র হতে হবে না। যেকোনো বয়সের পৃথিবীর যেকোনো ভাষাভাষী যে কেউ এ স্কুলে বাংলা শিখতে আসতে পারেন।

'বেঙ্গলি সামার স্কুল সবার জন্য। আমরা প্রতিবছর তিন–চারজন মিলে বিভিন্ন জায়গায় এ সামার স্কুলের আয়োজন করি। আমাদের সঙ্গে আছেন একজন বাঙালি, ইউনিভার্সিটি অব হেইডেলবার্গের শিক্ষক চৈতী বসু। প্রথমে আমরা শুরু করেছিলাম হাইডেলবার্গে, পরের বছর প্রাগে। এরপর কোভিড আসে। কোভিডের দুই বছর পর ওয়ারশতে আয়োজন করা হয়। এখন নিয়মিত আমাদের কার্যক্রম চলছে। এ বছর হাইডেলবার্গে ১–১৭ আগস্ট ১৭ দিনের বেঙ্গলি সামার স্কুল আয়োজিত হবে,' জানা গেল মিহাউর কাছ থেকে।

২০২৩ সালে ওয়ারশতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ অংশগ্রহণকারীর বয়স ছিল ষোল বছর। কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত পেশাদারও এসেছিলেন বাংলা শিখতে। রোটেটিং স্কুল হওয়ায় প্রতিবছর স্কুল আলাদা জায়গায় হয়। এ বছর এটি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। 'যদিও বাংলা ভাষা বিশ্বে ষষ্ঠতম কথ্য ভাষা, তাও এটি শেখার জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। বেঙ্গলি সামার স্কুল সে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করছে। এ বছর ওয়ারশতে গত বছরের স্কুলের অর্ধেক শিক্ষার্থী কোর্সের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছেন,' বলেন মিহাউ।

বাংলা শিখতে আসেন প্রবাসী বাঙালিদের ছেলেমেয়েরাও। "সবচে' খুশির খবর আমাদের জন্য, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই প্রবাসীদের ছেলেমেয়ে। বাংলাদেশি প্রবাসীর ছেলেমেয়েরা, যাদের বিদেশে জন্ম, বড় হওয়া, ছোটবেলা থেকে এখানে থাকে, অন্য ভাষায় পড়াশোনা। বাবা-মা বাড়িতে বেশি কথা বলে না বাংলায় যাতে তারা পোলিশ ভাষায় বেশি অভ্যস্ত হয়। তারা অনেকেই সামার স্কুলে আসেন," নিজের মাটির ভাষা শিখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়ার ভেতরে আছে একজন মানুষকে তার শেকড়, মাটির ঘ্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার তৃপ্তিই যেন ফুটে ওঠে মিহাউ পানাসিউকের উচ্ছ্বাসে।

বেঙ্গলি সামার স্কুলের কোর্স শেষ করে ডিপ্লোমা নিচ্ছেন এক শিক্ষার্থী। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

বাংলা শিখতে কোন ধরনের জড়তা কাজ করতে পারে, সে নিয়েও ধারণা রাখেন মিহাউ। ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের বাংলা শেখাতে সে অনু্যায়ী তিনি নিজেই বাংলা শেখানোর নিজস্ব পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছেন। ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মান, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, রাশিয়া থেকে বাংলা শিখতে আসেন সবাই বেঙ্গলি সামার স্কুলে।

যদিও অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপ চায় না বেঙ্গলি সামার স্কুল, তবে প্রতিবছর শিক্ষার্থী সংখ্যায় বাড়ছে বলে জানান মিহাউ পানাসিউক। একজন বাঙালি ও দুজন বিদেশি শিক্ষক ক্লাসগুলো নিয়ে থাকেন। সবসময় অবশ্যই একজন নেটিভ শিক্ষক উপস্থিত থাকেন। আগে ক্লাস হতো দুই সপ্তাহ, এখন হয় সতের দিন। এর ভেতরে দুইদিন ছুটি দেওয়া হয়। প্রতিদিন তিনটি করে দুই ঘণ্টার ক্লাস করানো হয়।

'আমরা প্রত্যেকে যার যার নিজস্ব পদ্ধতিতে ক্লাস নিই। আমি নিজে সবসময় বোঝার চেষ্টা করি, শিক্ষার্থী কেন শিখতে চায়, তাদের আগ্রহের জায়গা কোনটা। সেগুলো দিয়েই আমি শেখানোর চেষ্টা করি। আমরা চেষ্টা করি যেন শিখনপদ্ধতি বাস্তবধর্মী হয়। আমরা বই কম ব্যবহার করি, আর বাংলা শেখানোর মতো সেভাবে ভালো বইও তেমন নেই।'

কেবল বাংলা ভাষা শেখানোই নয়, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাংলা ও বাঙালি বিষয়ক আরও নানা আয়োজন করা হয় সামার স্কুলে। যেমন, বাঙালি রান্নার আয়োজন, বাংলা চলচ্চিত্র দেখানো, প্রাগে বা ইউরোপে রবীন্দ্রনাথসংক্রান্ত জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখানো।

এত বছর ধরে বাংলা শেখাতে পেরে কেমন লাগে মিহাউয়ের? তিনি বলেন, 'আমাদের হঠাৎ করে এমন কিছু হয় না যাতে আমরা অনেক অবাক হয়ে যাই, খুশি হয়ে যাই। তবে শেখানোর তিন বা পাঁচ বছর পরে আমরা যখন দেখতে পাই তারা কত শিখেছে, এটা আমাদেরকে আনন্দ দেয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সবসময় বলি, আমরা যখন নতুন ভাষা শিখি, বাংলা হোক বা যেকোনো ভাষা, তখন আমরা অন্য চোখে, অন্য মাত্রায় নিজেদের দেখতে পাই। আমাদের নিজেদের ভেতরে কী আছে, সেটা অন্যভাবে, অন্য ব্যাকারণে অন্য বাক্যে প্রকাশ করতে পারি।'

মাস্টারমশায় মিহাউয়ের বাংলা শেখা

মিহাউ পানাসিউকের নিবাস পোল্যান্ডের ওয়ারশতে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশ'র সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। বাংলা ভাষার ওপর পিএইচডি করে ঐ বিভাগেই গত দশ বছর ধরে বাংলা ভাষার শিক্ষকতা করছেন। বাংলাদেশ ও কলকাতায় যাতায়াত, দোভাষী ও অনুবাদক হিসেবে কাজ ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার মাস্টারমশায়। ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগ বন্ধ হয়ে গেলেও ওয়ারশতে এটি বেশ পুরোনো বিভাগ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকেই বাংলা নিয়ে এ বিভাগে চর্চা হচ্ছে।

প্রথম প্রথম পড়ার সময় যে বাংলা তাকে খুব টেনেছে এমনও নয়। তবে কী এমন হলো, বাংলার প্রতিই পরবর্তীকালে তার স্নেহ, এত ভালোবাসা তৈরি হলো যে, তিনিই এখন বাংলা শেখাচ্ছেন?

সেকেন্ডারি স্কুলের তরুণ মিহাউ, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আর চোখে দিগন্ত পেরোনোর স্বপ্ন। একসময় ভাবতেন অর্থনীতি নিয়ে পড়বেন। কিন্তু স্কুলের শেষদিকে স্থির করেন, অন্য সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে চান। সে থেকেই সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রতি তার ঝোঁক এবং আজ তার বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ।

প্রাগে মিহাউ পানাসিউক। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

'সংস্কৃত ও বাংলা দুটোই আমার প্রধান বিষয় ছিল। কিন্তু, পাঁচ বছর পরে যখন আমি বৃত্তি নিয়ে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই, তখন বাংলার সঙ্গে এত জড়িত হয়ে গিয়েছিলাম যে, অন্য কিছু শিখতে চাইছিলাম না। তারপর আমি বেশি বাংলা নিয়ে কাজ করা শুরু করি। সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি এ তিনটা বিষয়েই আমার পড়াশোনা ছিল। কিন্তু বাংলার প্রতি আমার বেশি আকর্ষণ তৈরি হয়।'

প্রথম প্রেমের মতোই যেন কিছুটা আকস্মিকভাবেই মিহাউর বাংলার প্রতি ভালোবাসা আর আগ্রহ জন্মেছিল। কল্পনার রাজ্যে রবিঠাকুর বা নজরুল পড়ার আগ্রহ থেকে কিন্তু তার বাংলা প্রেম আসেনি। তার আগ্রহ ছিল দর্শনের প্রতি, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি। প্রেমে পড়েছিলেন কলকাতার হাটে-মাঠে-ঘাটে সাধারণ মানুষের বুলিতে বাংলা শুনে শুনে। মূলত বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সহজিয়া বাঙালির জীবনযাপনের তিনি প্রেমে পড়েছিলেন যেন।

'ফিরে এসে তখন আমি ওয়ারশতে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম এনাদের নিয়ে পড়তাম। এরপর হঠাৎ করে একদম আঞ্চলিক ভাষা, উপভাষা এসবের দিকে আগ্রহ কাজ করে। তারপর বাংলাদেশে যাওয়া হয়েছিল, তিন বছর ঢাকাতে ছিলাম দোভাষী হিসেবে। তারপর পিইচডি করেছি বাউল সাহিত্যে দেহতত্ত্ব নিয়ে। এমএ করেছিলাম ঊনবিংশ শতকের বাংলা নাটকের ওপর। আমি দুই বছর ধরে কলকাতায় ছিলাম, তারপর ঢাকাতে; আমার ভাষায় একদম পরিবর্তন আসে। 'কলকাতায় গেলে কলকাতার টান আসে কথায়, বাংলাদেশে এখানকার টান।'

মিহাউ কথা বলছিলেন ঢাকায় থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে। যানজট থেকে শুরু করে ঢাকা শহরের সাধারণ মানুষের জীবন বাস্তবতারই একটু আঁচ যেন তারও লেগেছে। 'প্রথম আমি বাংলাদেশে এসেছিলাম ২০০৩ সালে, একমাসের জন্য। তারপর ২০১৪-এ দ্বিতীয়বার আর এরপর টানা দুইবছর ঢাকায় থাকা হয়। ঢাকা খুব কঠিন ছিল আমার জন্য আসলে; ঢাকা শহরটা এত সহজ না জীবনযাপনের জন্য, যাতায়াতের জন্য কঠিন। তবুও অনেক সুন্দর স্মৃতিও আছে। ঢাকা ছাড়াও মোটামুটি সব বিভাগে আমি গিয়েছি; নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম।'

'প্রচুর শিখেছিলাম রাস্তায়'

মিহাউকে বাংলাটা শিখতে প্রভাবিত করেছিলেন বাংলারই সাধারণ মানুষ, কখনো বা রাস্তায়, কখনো বা হাঁটবাজারে। পানাসিউক বললেন, 'আমি প্রচুর শিখেছিলাম রাস্তায়। বাজারে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা, রাস্তার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি অনেক শিখেছি। যাদবপুরের বন্ধুরা, আমার একজন অধ্যাপক শাশ্বত ভট্টাচার্য, উনিও আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আমি ভুল করলে তিনি সবসময় আমাকে আমার ভুল ধরিয়ে দিতেন। আর ঢাকায় দোভাষী হিসেবে কাজ করায় অনেক কিছু শিখেছি। তবে সাধারণ বাংলাভাষীরা আমাকে সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন।'

কথা বলছিলেন আঞ্চলিক ভাষার সৌন্দর্য নিয়ে। মিহাউ বললেন, 'আমি আঞ্চলিক ভাষাগুলো আলাদা করতে পারি। কিন্তু দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বা কলকাতা না গেলে তখন আবার গুলিয়ে ফেলি। আমি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অনেক কাজ করতাম, আমি সাধারণ বাংলায় কথা বললেও তাদের কথা বুঝতে পারতাম। আমি আঞ্চলিকতার বিষয়টা উপভোগ করি।'

মিহাউর বাংলা সাহিত্যে বিচরণ

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর। 
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।

মানুষকে আধুনিক বাংলা শেখালেও মিহাউকে টানে মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। তাই আধুনিক বাংলা নিয়ে বেশি কাজ থাকলেও তার অ্যাকাডেমিক কাজগুলো মধ্যযুগের ভাষা-সাহিত্যকে ঘিরে। ভালোবাসেন বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, চর্যাপদ। অবসরে পড়েন ব্রজবুলির পদাবলি, মঙ্গলকাব্যের অংশ, মধ্যযুগের প্রেমোপাখ্যান। বর্তমানে কাজ করছেন অন্নদামঙ্গল কাব্য, পাণ্ডুলিপি আর সিলেটের নাগরী ভাষা নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিজের ভালোবাসার জায়গা থেকে মিহাউ বলেন, 'বাংলা ভাষার বইয়ের ভান্ডার অসাধারণ। আমি প্রচুর পড়তে ভালোবাসি। মঙ্গলকাব্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, আলাওল-মধ্যযুগের সাহিত্য, পান্ডুলিপি, পুঁথি নিয়ে আমি কাজ করি। মধ্যযুগের কবিতা আমি অসম্ভব ভালোবাসি। শব্দের ব্যবহার, বাক্যের বিন্যাস খুবই ভালো লাগে। সামনে এক অর্থে কিছু বলছে কিন্তু অন্তর্নিহিত অর্থ হয়তো একদম আলাদা।'

ঢাকায় পিস কনফারেন্সে মিহাউ পানাসিউক। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কথা বলতে গিয়ে আমাদের পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে পানাসিউক বলেন, 'আমার মনে হয় তখনকার বাঙালি আর আজকের বাঙালি একদম অন্যরকম। বাংলা ভাষাও অন্যরকম ছিল, যখন রেঁনেসা শুরু হয়েছে তখন বাংলা ভাষায় কত পরিবর্তন হয়েছিল! টান, শব্দে পরিবর্তন বা শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তন। যেমন আমাদের ভাষায়ও পরিবর্তন এসেছে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে। আগের সাহিত্যে অনেক আদিরসের ব্যবহার ছিল যেটা এখন আর নেই। মধ্যযুগের সাহিত্য আমি সুর করে পড়ার চেষ্টা করি, কারণ তাছাড়া তা প্রাণ পায় না। বাংলা সাহিত্যের পুঁথিপাঠের ঐতিহ্য খুবই আলাদা, আমরা এটা সেভাবে পড়তে পারি না।'

জানালেন মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে রিডিং সেশনের কথা। যখন তারা বেশি মধ্যযুগের কাব্য পড়েন, তখন তাদের একটা আন্তর্জাতিক গ্রুপ হয়। দুই-তিন বছর পরপর তারা নানা দেশ থেকে এক জায়গায় হয়ে একসঙ্গে মধ্যযুগের কাব্য পড়েন। তখন দেশিদের থেকেও বিদেশিরা ভালোভাবে মধ্যযুগের কাব্য পড়তে পারেন। পুরোনো ভাষা, সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার কারণে এ দক্ষতা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।

ভালোবেসেছেন জীবনানন্দকে

দেখেছি যা হ'লো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।

—সুচেতনা, জীবনানন্দ দাশ

বাংলা সাহিত্যে মিহাউয়ের সবচেয়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। ভালোবাসা জানিয়ে পানাসিউক বলেন, "জীবনানন্দ আমার প্রিয় কবি। নির্দিষ্ট করে কোনো প্রিয় কবিতা না থাকলেও অবশ্যই ভালোবাসি 'বনলতা সেন', অসাধারণ লাগে 'সুচেতনা' কবিতা। আমার মনে হয়, জীবনানন্দ যেভাবে শব্দ ব্যবহার করেন, অন্য কেউ হয়তো পারেন না। প্রথম লাইন থেকেই আমি বুঝতে পারব এটা জীবনানন্দের কবিতা। তার যে কল্পনার জগৎ, শব্দভান্ডার তা অসাধারণ।'

পানাসিউক জানালেন বাংলা ধ্রুপদি ও আধুনিক সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগের কথাও। তার প্রথম পড়া বাংলা ভাষার বই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস কবি। ভালোবাসেন মানিকের পদ্মানদীর মাঝি, অনুভব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাসসহ পড়েছেন নানাকিছু। তার কাছে বর্তমানে পোল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি রয়েছে। বইমেলায় এসেছেন অনেকবার, এছাড়াও প্রতিবছর বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে সে বছরের বাংলা বইগুলো তিনি সংগ্রহে রাখেন। মিহাউ পানাসিউক বললেন, 'বাংলা বই আমার কাছে সবসময় থাকে; শেখার জন্য, আনন্দের জন্য, গবেষণার জন্য।'

ফিরবেন কখনো খোয়াবনামার কাছে

একটু খটমটে ভাষার বই দেখলেই তো অনেক পাঠক পালিয়ে বাঁচেন, সেক্ষেত্রে মিহাউ পানাসিউক জানালেন সে বইয়ের কাছে ফেরার কথা। 'অনেক তাড়াতাড়িই আমি বাংলা বই পড়তে পারি। অভিধান সেভাবে ব্যবহার করতে হয় না আমার। যদি কোনো বইয়ের ভাষা আমার কঠিন মনে হয়, তাহলে আমি সেই বইটা একটু রাখি। এক-দুই বছর পর সে বইয়ের কাছে ফিরে আসি। যেমন, আমার খুব ইচ্ছে আছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই পড়ার। সবাই আমাকে বলে খোয়াবনামার কথা। আমার খুব ইচ্ছে করে পড়তে, কিন্তু ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে বিদেশিদের জন্য খোয়াবনামা খুবই জটিল বই। এখন রেখে দিলাম, কিন্তু আমি শিখছি যেন কোনোদিন খোয়াবনামা পড়তে পারি।'

পাণ্ডুলিপি ও অনুবাদ: আক্ষেপের জায়গা

বাংলা সাহিত্য নিয়ে নিজের আগ্রহের কথা জানানোর পাশাপাশি জানালেন কিছু আক্ষেপের কথা। বললেন বাংলা সাহিত্যের পাণ্ডুলিপির বেহাল দশার কথা। 'মানুষ এতই এগিয়ে যেতে চায় যে, পেছনে যা আছে তা ভুলে যায়। বাংলা সাহিত্যের রয়েছে এক অনাবিষ্কৃত জগৎ। শুধু বাংলা সাহিত্যের গবেষক হিসেবেই নয়, বাংলা সাহিত্যকে ভালোবাসে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি খুবই চিন্তিত যে, পুরানো গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপিতে প্রবেশাধিকারের অভাব এবং অনলাইনে সেগুলো অ্যাক্সেস করতে না পারা বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলি খুব খারাপ অবস্থায় রাখা হয় এবং সেগুলোতে কোনও প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না, বেশিরভাগই সে জায়গার কর্মীদের ইচ্ছার অভাবের কারণে।'

বাংলাদেশ ও কলকাতায় যাতায়াত, দোভাষী ও অনুবাদক হিসেবে কাজ ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় মিহাউ পানাসিউক হয়ে উঠেছেন বাংলার মাস্টারমশায়। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

মিহাউ জানান, কখনও কখনও সংগ্রহশালার কর্মীদের অদক্ষতার কারণে, ভালো প্রশিক্ষণের অভাবে কী রকম টেক্সট রাখা হয়েছে তারা তা ভালো করে বলতে পারেন না। ক্যাটালগগুলোতে ভুল রয়েছে। তবে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা হলো এসব মহাফেজখানা এবং সেগুলোতে থাকা বইপত্রে প্রবেশাধিকার না থাকা বা না দেওয়া।

কেউ বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য সংরক্ষণে আগ্রহী হলে মিহাউ নিজেও সে ব্যাপারে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করা বা পাণ্ডুলিপির সমালোচনামূলক সংস্করণে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের বেহাল দশার পাশাপাশি কথা বললেন বাংলা সাহিত্য অনুবাদের ব্যাপারেও। তিনি নিজেও একজন অনুবাদক, বর্তমানে লীসা গাজী নামক একজন লেখকের লেখা বই রৌরব বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করছেন। পোলিশ ভাষার লেখক ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার একটি বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন পাতাহীন বৃক্ষ অথবা কালো গাছ-কঙ্কাল নামে। আমাদের সাহিত্যে অনুবাদ কতটা দরকারি, সে ব্যাপারে বললেন, 'বাংলা ভাষার এত সমৃদ্ধ সাহিত্যজগৎ, কিন্তু অনুবাদের অভাবে বিশ্ববাসীর কাছে এগুলো পৌঁছানো যাচ্ছে না। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে আরও তুলে ধরতে অনুবাদ খুবই প্রয়োজনীয়।'

পোলিশ বনাম বাংলা: অন্তমিল হয় কী?

ইউরোপের সিন্ধুপারের সুদূরে থাকা এক বিদেশিনী ভাষা পোলিশের একটা যোগসূত্র আছে। বাংলা আর পোলিশ দুই ভাষাই এসেছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার থেকে। ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষারই উপশাখা পশ্চিম স্লাভীয় ভাষাসমূহের একটি পোলিশ ভাষা। সেই আত্মীয়তার দরূন বাংলা ও পোলিশের কোনো সাদৃশ্য আছে কি না জানতে চাই মিহাউ পানাসিউকের কাছে।

'দুটোই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের হওয়ার কারণে উচ্চারণে পোলিশ ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার ধ্বনিতে একটু মিল আছে। পোলিশ ভাষায় 'শ'-এর নানারকম উচ্চারণ আছে, আমরা খুব ব্যবহার করি। এটা আমাদের সঙ্গে খুব মিল। সবাই বলে বাংলা খুব মিষ্টি ভাষা, আমরাও বলতে পারি পোলিশ খুব মিষ্টি ভাষা কারণ এই উচ্চারণের মিল।'

ইংরেজিতে যারা কথা বলেন তাদের বাংলা শিখতে যে কাঠখড় পোড়াতে হয়, পোলিশদের জন্য তা নয়। বাংলায় এত প্রতিশব্দ, সমার্থক শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ আছে! জমিদারি বাংলায় কথা বলা যায়, গ্রামবাংলার ভাষায় কথা বলা যায়, আবার আঞ্চলিক ভাষায়ও বলা যায়। কিন্তু পোলিশে এত পার্থক্য নেই, সবাই একইভাবে কথা বলেন।

একজন পোলিশ হিসেবে তাহলে বাংলা শেখাটা কেমন কঠিন বলে মনে করেন মিহাউ? বললেন, 'যদি নেটিভ কেউ না থাকে, তাহলে বাংলা বলা খুব কঠিন। আসলে শেখার জন্য বাংলা এত কঠিন না। উচ্চারণের দিক থেকে আমার পক্ষে বাংলা ইংরেজির চেয়ে অনেক সহজ। কারণ একই বর্ণের অনেক উচ্চারণ ইংরেজিতে। বাংলায় উচ্চারণে নির্দিষ্ট স্বর, নিয়ম আছে। অভ্যাস করতে করতে পারা যায়। বাংলায় কথা বলা বেশি কঠিন কিন্তু বই পড়া যথেষ্ট সহজ আমাদের জন্য।'

তবে কী এমন আছে বাংলা ভাষায়, যা ভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছে শেখার জন্য বাংলাকে কঠিন করে তোলে? জানা গেল, বাংলা ভাষায় বাক্যগঠনে একটুখানি জিলাপির আড়াই প্যাঁচ দিয়েছে এর বাক্যের গঠনবিন্যাস।

একটু গন্ডগোল লাগল যে! বাঙালি বোল প্যাঁচ করে ধাঁধার থেকেও জটিল করে কথা বলে নাকি? উত্তর দিলেন মিহাউ, 'বাংলা ভাষায় ক্রিয়া একদম শেষের দিকে। আমরা ইংরেজির মতো ক্রিয়া একদম শুরুতে রাখি। আমরা যখন বাংলায় কথা বলতে চাই তখন একদম মন অন্যরকম কাজ করে।'

বর্তমানে মিহাউ পানাসিউক কাজ করছেন অন্নদামঙ্গল কাব্য, পাণ্ডুলিপি আর সিলেটের নাগরী ভাষা নিয়ে। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার লালসালু উপন্যাসে বলেছিলেন, 'শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি'। আজকের সমাজবাস্তবতায় বেঁচে থাকলে তিনি শস্যের চেয়ে সংগঠন বেশি বললেও তেমন অবাক হতাম না। বাংলাদেশে রয়েছে নানা সংগঠন আর তার নানারকম পদ। সভাপতি, সহ-সভাপতি, সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক; মোট কথা পদের কোনো সীমা নেই। দাপ্তরিক কাগজপত্রও থাকে নানারকম ভুলে ভরা। আর এসব সামলাতে বেগ পেতে হয় দোভাষী মিহাউকে। বললেন, 'এত এত পদ, আর আমাদের পোল্যান্ডে এত পদ-পদবিই নেই। সেক্ষেত্রে আমরা অনুবাদ কীভাবে করব?'

বাংলা নাহয় শিখলেন কেউ বেঙ্গলি সামার স্কুলে, কিন্তু কথা কইবেন কোথায়, প্রয়োগ করবেন কোথায় এ নিয়ে যেন অনেক কিন্তু কিন্তু থেকে যায়। এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে পানাসিউক বলেন, 'আসলে বাংলা নিয়ে কাজ করা খুব সহজ না। কারণ খুব ছোট গ্রুপের মধ্যে বেশি কাজের জায়গা নেই। পিইচডি শেষের পর সেভাবে কাজ পাওয়া যায় না। ইউরোপে সেভাবে বাংলা বিভাগ নেই, নতুন যারা আসেন, অনেক বাধা পান। দোভাষী হিসেবেও তেমন কাজ করা যায় না।'

সবকিছু কি অনুবাদের বাঁধ মানে? কিছু অনুভুতি যেন সে ভাষার মানুষের অস্তিত্বের গহীনে এত তীব্রভাবে দাগ কেটে থাকে যে, অন্য কোনো ভাষার অনুবাদই তার অর্থকে ধারণ করতে পারে না। কেমন যেন অনাত্মীয় মনে হয়। এমন কোনো শব্দের কথা বলতে গিয়ে মিহাউ পানাসিউক জানালেন তার খুব প্রিয় একটি বাংলা শব্দের কথা, অভিমান। সত্যিই তো। বুকের ভেতরে বোবা মেঘের ভিড় হয়েছে; না আছে বৃষ্টি, না আছে গর্জন। শুধু বোঝা যায়, বুকটা বড্ড ভারি হয়ে আছে সে অভিমানের মেঘ আগলে। এমন এক অনুভূতিকে অনুভব করা যায় যেন কেবল বাংলাতেই।

মিহাউ বলেন, 'অন্য ভাষার এটা সবচেয়ে সুন্দর জিনিস যে শব্দ আমরা আসলে কীভাবে অনুবাদ করতে পারি। সবসময় প্রতিটা ভাষার একটা আলাদা অনুভূতি থাকে যেটা নিজের ভাষায় হয়তো অনুভব করা যেত না। যেটা আমার ভাষায় আমি বলতে পারি না, বোঝাতে পারি না, অনেক সময় অন্য ভাষায় আমি তা প্রকাশ করতে পারি।'

বাংলায় দিনলিপি ও যত্নে পাওয়া ভালোবাসা

কলকাতা বদলেছে, ঢাকা বদলেছে, বদলেছেন মিহাউও। পরিবর্তিত সেসব দিনের অভিজ্ঞতাও হয়েছে মিশ্র। কিন্তু যা ধ্রুবক থেকেছে তা হলো, বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে মিহাউ পানাসিউকের আন্তরিক আত্মিক সম্পর্ক। এ আত্মিক সম্পর্কে গড়তে সাহায্য করেছে তার ভাষা। মিহাউ কিছুটা হাসতে হাসতে বললেন, 'আমি মজা করে সবসময় বলি আমার বন্ধুকে, আমার টাকা আসলে কেন লাগবে? আমি যখন কলকাতায় বা ঢাকায় যাই, আমি শুধু বাংলায় কিছু বাক্য বলব, আমাকে লোকে নেমন্তন্ন করবে খাবারের জন্য, বাড়িতে থাকতে দেবে। এরকম ভালোবাসা আমি আসলে কোনো দেশে পাব না। শুধু ভাষার কারণে, এ এক অসাধারণ জিনিস।'

প্রথমবারের কলকাতা থাকার সময়ের এক মিষ্টি অভিজ্ঞতার কথা বললেন তিনি। সেবার একটা দোকানে গিয়ে জল কিনতে গিয়ে বলেছিলেন 'একটা মিনারেল ওয়াটার'। ওই একটা বাংলা শব্দ শুনেই দোকানি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। "উনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি বাংলা শিখেছেন!' আমরা একটা বাংলা শব্দ বললেই তারা এতটা খুশি হন; পুরোদমে বাংলা বলতে পারলে অনেক ভালোবাসা পাওয়া যায়।"

বাংলা সাহিত্যের পাণ্ডুলিপির বেহাল দশা নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে মিহাউর। ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত

অকৃত্রিম এসব ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মিহাউ পানাসিউক বললেন, 'আমি এটা সবসময় বলি, আমি ঢাকা বা কলকাতায় যখন যাই, আমি একদম রাতে যদি রাস্তা দিয়ে যাই, আমার কিছু কেউ করবে না। আমি যদি এটা আমার নিজের শহরে করি, আমার সমস্যা হতেই পারে। বাংলাদেশে বা ভারতে কেবল ভাষার কারণে আমার কখনো সেভাবে সমস্যা হয়নি। এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার যেটা আমরা ইউরোপে দেখতে পারব না।'

বাংলা, বাংলাদেশ, বাংলাদেশিদের প্রতি তার রয়েছে আলাদাই টান। ভালোবাসেন বাংলাদেশিদের বন্ধুত্ব, এখানকার মানুষের গান-বাজনা তার আপন লাগে। বাংলাদেশের মানুষের ভেতরের কৌতূহল ও কল্পনার সংমিশ্রণ তার প্রিয়। এখানে এলে বারবার হারিয়ে যেতে চান বান্দরবান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের মায়ায়।

নিজেকে ভোজনরসিক হিসেবে মানেন মিহাউ। নামের সঙ্গে নিজেই জুড়ে নিয়েছেন তকমাটা। বললেন, নিজেই রান্না করেন, বাংলা রান্নায়ও আনেন পরিতৃপ্তি। খেতে ভালোবাসেন খুব সহজ সাধারণের খাবার। মাছ খেতে খুব ভালোবাসেন, তবে সেটা ইলিশ মাছ নয় (বাঙালি সমাজের কাছে সে ব্যাপারে মাফও চেয়ে নিয়েছেন)। প্রিয় খাবার কখনো বৃষ্টিদিনে মাছ ভাজা-বেগুন ভাজা-খিচুরির ত্রয়ী। তেতো খাবারেও একদম আপত্তি নেই, সে করলা ভাজা হোক বা নিমপাতা দিয়ে বেগুন ভাজা। মিষ্টিতে প্রিয় রসমালাই, গুঁড়ের সন্দেশ, ফিরনি।

এতবছর ধরে বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে এত দূরের একটি জাতি, একটি দেশের সঙ্গে যেন আত্মিকভাবেই মিশে গিয়েছেন মিহাউ পানাসিউক। 'আমার মনে হয় একটা টান অনুভব করি আমি। আমাকে বাংলা ভাষা যা দিয়েছে, যা দিচ্ছে বা দেয় সবসময়; এই টানটা। আমি বাংলা, বাঙালি সমাজ বুঝতে পারি ভাষার মাধ্যমে। অনেক বছর ধরে এই বোঝাপড়াটা চলছে, প্রতিদিন চলছে। আমার দেশের ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, আমার পরিবার বা পূর্বপুরুষদেরও ছিল না। আমি যে সম্পৃক্ততা তৈরি করেছি তা শুধুই ভাষার মাধ্যমে, এটা খুবই আলাদা।'

বাংলা ভাষাকে আত্মিকভাবে ধারণ করে বাংলার বুলি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া মিহাউ পানাসিউকেরা যেন ভিনদেশের হয়েও এ মাটির ঘ্রাণের অনেকটা আপন।

Related Topics

টপ নিউজ

বাংলা ভাষা / বেঙ্গলি সামার স্কুল / বাংলা / ভাষা শিক্ষা / ইউরোপে বাংলা / পোল্যান্ড

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • ছবি: টিবিএস
    আমাকে শোরুমে নিলে সব সত্যি বের হবে: হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক
  • ছবি: সংগৃহীত
    বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর ৫৭,৫৭৬ কোটি টাকা লোকসান দেখাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
  • ঢাকার বাসগুলোর ‘যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি’ বন্ধে ৬৭১ কোটি টাকার পরিবহন তহবিল; নামবে ৪০০ বৈদ্যুতিক বাস
    ঢাকার বাসগুলোর ‘যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি’ বন্ধে ৬৭১ কোটি টাকার পরিবহন তহবিল; নামবে ৪০০ বৈদ্যুতিক বাস
  • ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট
    ‘মামলা’ এড়াতে ট্রাফিক কর্মীকে কয়েকশো মিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে পালালেন সিএনজি চালক
  • ছবি: ডিএমপি
    ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা: মূল সন্দেহভাজন ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবী আটক
  • বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
    একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ: জামায়াত সেক্রেটারি

Related News

  • রেললাইন নাশকতার অভিযোগে সর্বশেষ রুশ কনস্যুলেট বন্ধের ঘোষণা পোল্যান্ডের
  • পোর্টল্যান্ডে ট্রাম্পের ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দিলেন মার্কিন বিচারক
  • রাশিয়ার ‘ভুলবশত’ ড্রোন হামলা: আগ্রাসনের আশঙ্কায় পোল্যান্ডে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন হাজারো সাধারণ মানুষ
  • ন্যাটোর ৪ নং অনুচ্ছেদ সক্রিয় করার আহ্বান পোল্যান্ডের, এর অর্থ কী
  • পোল্যান্ডে রাশিয়ান ড্রোন: মস্কো বলছে, দেশটিকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর কোনো পরিকল্পনা নেই 

Most Read

1
ছবি: টিবিএস
বাংলাদেশ

আমাকে শোরুমে নিলে সব সত্যি বের হবে: হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক

2
ছবি: সংগৃহীত
অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পর ৫৭,৫৭৬ কোটি টাকা লোকসান দেখাল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

3
ঢাকার বাসগুলোর ‘যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি’ বন্ধে ৬৭১ কোটি টাকার পরিবহন তহবিল; নামবে ৪০০ বৈদ্যুতিক বাস
বাংলাদেশ

ঢাকার বাসগুলোর ‘যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি’ বন্ধে ৬৭১ কোটি টাকার পরিবহন তহবিল; নামবে ৪০০ বৈদ্যুতিক বাস

4
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট
বাংলাদেশ

‘মামলা’ এড়াতে ট্রাফিক কর্মীকে কয়েকশো মিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে পালালেন সিএনজি চালক

5
ছবি: ডিএমপি
বাংলাদেশ

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা: মূল সন্দেহভাজন ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবী আটক

6
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ

একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ: জামায়াত সেক্রেটারি

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net