স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনে জাদু ছড়ানো জীবন রায়ের গল্প

সমুদ্রের গর্জন কিংবা কিংবা বালুকা রাশি এই দুই-ই বোধহয় সমুদ্রপ্রেমীদের নিকট অনেক কাছের। সমুদ্দুরের ধারে বসে বালু দিয়ে খেলা এবং বালুর সঙ্গে সময় কাটানোর মুহূর্ত কম-বেশি কারো কাছেই মন্দ লাগে না। অনেকের কাছে বালু জীবনের গল্প বলে, তাতে লুকিয়ে থাকে সুখস্মৃতি। তাইতো মার্কিন সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী এবং নিসর্গ লেখক রেচল লুইজ কারসন বলেছেন, বালুর প্রতিটি কণায় নিহিত থাকে পৃথিবীর গল্প। এই পৃথিবীর গল্প বলতেই আজকে শোনাবো একজন স্যান্ড আর্টিস্টের আখ্যান; যিনি বালু দিয়েই ফুটিয়ে তোলেন অজস্র উপাখ্যান।
জীবন রায় এমনই একজন স্যান্ড আর্টিস্ট, যিনি বালুকে ব্যবহার করেই সকলকে শোনান দেশের গল্প, জীবনের গল্প। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের যাত্রাও শুরু হয় জীবন রায়ের হাত ধরে।
ইউটিউব দেখে শখের বশে শেখা স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন দিয়েই যে রাতারাতি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবেন- প্রথমদিকে এমন ভাবনা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি। একসময় শখ পরিবর্তন হলো নেশায়, তারপর পেশায়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রথম ও সফল স্যান্ড আর্টিস্ট হিসেবেও উচ্চারিত হয় জীবন রায়ের নাম।

স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন আসলে কী!
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, স্যান্ড আর্ট কী কিংবা স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনই-বা কী? কীভাবেই বা শুরু হলো এর যাত্রা? স্যান্ড আর্টের আদ্যোপান্ত জানতে হলে চলে যেতে হবে একটু পেছনে। স্যান্ড আর্ট বা বালু শিল্প বলতে শৈল্পিক আকারে বালু দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ভাস্কর্য বা চিত্রকর্মকে বোঝায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান্ড আর্টিস্ট অ্যান্ড্রু ক্লেমেন্সের হাত ধরে বৈশ্বিকভাবে স্যান্ড আর্টের যাত্রা শুরু হয় বলে ধরা হয়।
স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন মূলত স্যান্ড আর্টেরই একটি অংশ। চমকপ্রদ এই শিল্পটির জন্য লাইটবক্সের উপরে বালি প্রয়োগ করা হয় এবং হাতের কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন গল্প দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়। স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬৮ সালে। সে বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী ক্যারোলিন লিফ প্রথম স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন সিনেমা, যার নাম ছিলো 'স্যান্ড অর পিটার অ্যান্ড দ্য ওলফ'। এভাবেই শুরু হয় স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের গল্প এবং তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
বাংলাদেশে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের ছোঁয়া লাগে ২০১২ সালে। আর এই সৌরভময় নতুন আর্টের প্রচলন করেন জীবন রায়।

থিয়েটারের কাজে নতুনত্ব আনতে স্যান্ড আর্টের আগমন!
জীবন রায়ের আঁকাআঁকির প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিলো ছোটবেলাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু করেন থিয়েটার। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার পাশাপাশি চালিয়ে যেতেন অভিনয়ের কাজ। গৎবাঁধা থিয়েটারের কাজে নতুনত্ব আনার তাগিদ অনুভব করায় খুঁজতে থাকেন নতুন কিছু। এমনই একসময় ইউটিউবে স্যান্ড আর্টের সন্ধান পান।
আঁকাআঁকি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকায় ঠিক করলেন স্যান্ড আর্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। তবে শুধু অংশ নেবেন ভাবলেই তো হবে না, স্যান্ড আর্টের খুঁটিনাটিও শিখতে হবে ভালোভাবে। বন্ধুর সহযোগিতায় প্রথমে লাইট দিয়ে বক্স বানালেন।
কিন্তু চর্চা করতে গিয়ে মূল সমস্যায় পড়লেন বালু নিয়ে। সব রকমের বালু নিয়ে স্যান্ড আর্ট হয় না। স্যান্ড আর্টের জন্য প্রয়োজন হয়- পাউডারের ন্যায় ঝরঝরে বালু। নির্মাণাধীন ভবনের বালু দিয়ে কাজ শুরু করতে গিয়ে যখন ব্যর্থ হয়েছিলেন, তখনই বালু সমস্যা মেটাতে প্রসন্ন হন স্বয়ং বিধাতা। ময়মনসিংহ শহরে প্রয়োজনীয় কাজে গিয়ে রাস্তার পাশে পেয়ে যান প্রয়োজনীয় বালু। সেই বালু দিয়েই ২০১২ সালে শুরু হয় বাংলাদেশে প্রথম স্যান্ড আর্টের যাত্রা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যখন প্রথম স্যান্ড আর্টের প্রকাশ ঘটান, তখন অনেকের কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য ছিলো। অনেকে ভেবেই বসেছিলেন ইউটিউব থেকে ক্লিপ নিয়েই বুঝি এমন চমৎকার কাজ দেখাচ্ছেন তিনি। ফলাফলস্বরূপ, ইউটিউবের ফুটেজ দিয়ে স্যান্ড আর্টের নামে বোকা বানাচ্ছেন- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
শিল্পের এমনধারার অপমান এবার আর জীবন রায় নিতে পারলেন না; মনে জেদ চেপে বসে। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে আবার তিনি স্যান্ড আর্ট প্রদর্শন করেন। কিন্তু এবার যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারেন তাই লাইভ অনুষ্ঠানে স্যান্ড আর্টের মাধ্যমে দর্শকদের নাম লেখেন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ যখন সেদিন অনুষ্ঠানটি দেখেন, তারপর আর এই শিল্পের সততা নিয়ে কারো মনেই প্রশ্ন রইলো না। এরপরেই তর তর করে এগিয়ে যেতে থাকে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের পথ।

সিনেমাতেও নিয়ে আসেন স্যান্ড আর্ট!
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার পর জীবন রায়ের স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের কাজও কিছুটা ধিমিয়ে পড়ে। আশপাশের মানুষ উদ্বুদ্ধ করলেও বালু নিয়ে বিড়ম্বনা এবং অন্যান্য সমস্যার জন্য স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন চলমান থাকবে কীনা তা নিয়ে নিজেও অনিশ্চয়তায় ছিলেন।
তবে এবার আর পিছিয়ে যেতে হয়নি। ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আইসক্রিম সিনেমায় স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন দিয়ে পুনরায় সবার নজরে চলে আসেন। জীবন জানান, '২০১৫ সালে পরিচালক রেদওয়ান রনি ভাই ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করেছিলেন। সেখানে তিনি একজন স্যান্ড আর্টিস্ট খুঁজছিলেন "আইসক্রিম" সিনেমার জন্য। যদিও আমি তখন বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে উনাকে রিচ করবো।' পরবর্তী সময়ে একজন বন্ধুর মারফতে রেদওয়ান রনি পর্যন্ত পৌঁছে যান। আর সেভাবেই প্রথম সিনেমার মাধ্যমে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পান।
পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'রাত জাগা ফুল' চলচ্চিত্রেও পুনরায় স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের দক্ষতা দেখান।
স্যান্ড আর্টের কারসাজি প্রদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রীর সামনেও!
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ পুলিশ ওম্যান এওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ হলেও ঘটে যায় বিপর্যয়। বিপুল প্রস্তুতি সমেত সম্মানজনক সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারলেও শেষ অব্ধি সময়ের অভাবে তার কাজ দর্শকদের দেখানোর সুযোগ সে যাত্রায় হয়নি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য বাংলাদেশ পুলিশের জন্য তিনি একাধিক স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের কাজ করেছেন। কিন্তু প্রথমবারেই বাধা মনে বেজায় দুঃখের জন্ম দিয়েছিলো।
২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন দেখানোর সুযোগ পান জীবন রায়। জীবন রায়ের কাছে এই অভিজ্ঞতা ছিলো স্বপ্নের মতো। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নামক একটি স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন ঢাকা চেম্বার অফ কমার্সের একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রদর্শন করার অভিজ্ঞতা হয় জীবন রায়ের। প্রধানমন্ত্রী থেকে পাওয়া প্রশংসা সামনে চলার পথ আরও সুগম হয়ে দেয়।
২০১৬ সালে যে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনটি বাংলাদেশ পুলিশ ওম্যান এওয়ার্ডে দেখানোর কথা ছিল, সেটি পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্টুডিওতে শ্যুট করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। পেশাগতভাবে এভাবেই শুরু হয়েছিলো জীবন রায়ের যাত্রা। এরপর থেকেই বিভিন্ন মিডিয়া এজেন্সির সাথে কাজ করা শুরু করেন।

কাজের প্রসার বাড়াতে এ যাত্রায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে কাজ শুরু করার ছক কষলেন জীবন রায়। তিনি বলেন, 'আমাদের এখানে বিদেশ থেকে কোনো শিল্পী আসলে খুব সম্মান পায় অথচ আমরা আমাদের শিল্পীদের মূল্যায়ন করতে চাই না। তখন দেশীয় এজেন্সিগুলোতে দেখা যেত, বিদেশী কোনো শিল্পী আসলে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হতো আর আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় কাজ করে দিতে বলতো।'
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে মাইক্রোসফটের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের শো করেন। এই অনুষ্ঠানের সাফল্য তার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ আরও মসৃণ করে দেয়। ফলস্বরূপ, তিনি দেশীয় বিভিন্ন এজেন্সির নেক-নজরে পড়ে যান এবং ২০১৬ সাল থেকে দেশের স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের বিভিন্ন কাজ তিনি নিজেই সামলাতে শুরু করেন।
স্বাধীনচেতা মননের জীবন রায় নিজেকে সবসময় 'রুল ব্রেকার' হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন। যার কারণে নিজের পছন্দের শিল্পকেই পেশা হিসেবে প্রথম পছন্দে রেখেছেন।
স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের কলা-কৌশল!
জীবন রায়ের স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন শেখার শিক্ষক ছিলো ইউটিউব। দিনের পর দিন বিভিন্ন দেশের স্যান্ড আর্ট শিল্পীদের কাজই ছিলো শেখার প্রধান উপাদান। যেহেতু হাতে কলমে শেখানোর কেউ ছিলো না, তাই বালুকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যবহার করার জন্য পরিশ্রমের বিকল্প কিছুই ছিলো না।
স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের কাজ মূলত করতে হয় আঙুল ও নখ দিয়ে। তবে অনেকসময় কাঠি ব্যবহার করেও এই কাজ করা যায়। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আধেয় হচ্ছে বালু। বালু ছাড়াও স্যান্ড আর্টের জন্য প্রয়োজন হয় প্রফেশনাল সেটআপের। চায়না, আমেরিকাতে এসব সেটআপ পাওয়া যায়; যা বাংলাদেশে পাওয়া সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ। সাধারণত স্যান্ড আর্ট করার জন্য প্রয়োজন হয়- লাইটবক্স, ক্যামেরা হোল্ডার স্ট্যান্ড ও ঝরঝরে বালু।
লাইটবক্সের জন্য কাঁচের নিচের রাখা হয় লাইট। এর উপরে বালু ব্যবহার করে শিল্পীরা বিভিন্ন গল্প বলে যান। অনেকে অবশ্য রঙিন বালু ব্যবহার করে। লাল, সবুজ, নীল নানা রঙের বালু দিয়ে দেখায় নানাবিধ আখ্যান। রঙিন বালু দিয়ে কাজ করতে হলে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়; ব্যবহার করতে হয় সাদা রঙের আলো। তাতেই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে সবকিছু। তবে বাহারি রঙের রঙিন বালুর মূল্য সাধারণ বালুর তুলনায় অনেক বেশি।

দুর্মূল্যের বাজারে স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের সেট-আপ কেনা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ছিলো। তাই এর জন্য প্রফেশনাল লাইটবক্সের সেটাপ জীবন নিজেই কাঠ দিয়ে বানিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি ক্যামেরা রাখার জন্য হোল্ডারও তৈরি করেছেন নিজে।
বালু সংগ্রহের কাজ এখনো বন্ধুদের দিয়ে করান। যেসব বন্ধুরা দেশের বাইরে যায় তাদেরকে বালু দিয়েই নিয়ে আসেন। জীবন রায় বলেন, 'আমাদের এখানে বালুতে পলি অনেক বেশি হওয়ায় বালু দ্রুত জমে যায়। আমাদের সি বিচের বালুতেও পলি আছে। মরুভূমির বালু স্যান্ড আর্ট করার জন্য আদর্শ বালু। বন্ধুরা মরক্কো, মালদ্বীপ এসব জায়গা থেকেই বালু নিয়ে আসে।'
স্যান্ড আর্ট ছাড়াও পারেন লাইট আর্ট!
স্যান্ড আর্ট করা ছাড়াও জীবন রায়ের আরো একটি গুণ রয়েছে; যেটি হচ্ছে লাইট আর্ট। লাইট আর্ট মূলত আলো দিয়ে করা হয়। কাপড়ের উপরে বিশেষ ধরণের আলো ব্যবহার করে গল্প বলা হয় লাইট আর্টের মাধ্যমে।
ইসরায়েলের স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন শিল্পী ইলিয়ানা ইয়াহাবের কাজ দেখে প্রথম স্যান্ড আর্টের প্রতি আগ্রহ জন্মায় জীবন রায়ের। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইলিয়ানা ইয়াহাবের হাত নাড়িয়ে গল্প বলে ফেলার গুণ আকৃষ্ট করে তাকে। তাকে দেখেই স্যান্ড আর্টের জগতে আসেন জীবন রায়। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে ব্রিটেইন'স গট ট্যালেন্টের তৃতীয় স্থানাধিকারী ইউক্রেনীয় শিল্পী কেসেনিয়া সেমিনোভা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন তার।
ভারতের পদ্মশ্রী পাওয়া স্যান্ড আর্টিস্ট সুদর্শন পট্টনায়েকের কাছে কাজ শেখার অভিজ্ঞতাও হয়েছিলো জীবন রায়ের।
গল্প বলতে পারার ক্ষমতা তার জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার বলে মনে করেন জীবন রায়। তাই দর্শককেও স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের সর্বদা ভালো ভালো গল্প উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি।
স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনের মাধ্যমে বলা গল্পগুলোর পেছনে কোনো সামাজিক বার্তা লুকানো থাকে কীনা জানতে চাইলে জীবন বলেন, 'আমি সবসময় চেষ্টা করি সামাজিক বার্তা রাখার। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোভিড নিয়ে একটি কাজ করেছিলাম। "কোভিড ওয়ারিয়রস" ছিলো স্যান্ড আর্টটির নাম। গল্পটাই ছিলো পুলিশ ও ডাক্তারদের জন্য; কোভিডের সময় তাদের কন্ট্রিবিউশন অনেক বেশি ছিলো। এরকম গল্প বলার চেষ্টা সবসময় করি।'
স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশনকে কেন্দ্র করে নানারকমের কর্পোরেট এওয়ার্ড, এজেন্সি এওয়ার্ড এসেছে জীবন রায়ের ঝুলিতে। ১৫ই আগস্টের কাজের জন্য, মোজোর ২৬শে মার্চকে কেন্দ্র করা কাজের জন্য বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়েছেন।
করতে চান অনেক কিছু
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে কক্সবাজারে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৬টি দেশ নিয়ে 'বিচ ফেস্টিভ্যাল' করার পরিকল্পনা ছিলো জীবন রায়ের। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, সংসদ ভবন, মসজিদ, মন্দির সহ ৪১টি স্যান্ড আর্টের বিভিন্ন নিদর্শন দেখানোর ইচ্ছা ছিলো এই উৎসবে। সেভাবেই কাজের তোড়জোর চলছিলো। কিন্তু বাদ সাধে করোনা মহামারী। সে যাত্রায় এই উৎসবটি না হলেও অদূর ভবিষ্যতে আবার নামানোর ইচ্ছে রয়েছে তার।
মুজিববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৫ আগস্ট সব দিবসকে কেন্দ্র কাজ করেছেন জীবন রায়। এছাড়াও বাংলাদেশ পুলিশের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে তাদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য কাজ করেছেন তিনি। তাছাড়া বিভিন্ন মিডিয়া এজেন্সির সাথে করতে থাকা কাজ তো লেগেই আছে। বিজ্ঞাপনের জগতে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে জীবন রায়ের। প্রাণ চিনিগুঁড়া চালের বিজ্ঞাপনে তিনি বালুর জায়গায় চাল ব্যবহার করে আর্ট করেছেন বলেও জানান।
ছবি আঁকতে ভালো লাগায় জীবন রায়ের ছোটবেলা থেকেই জীবনের ইচ্ছে ছিলো চারুকলায় পড়ার। কিন্তু পরিবারের আপত্তি থাকায় আর সেখানে পড়া হয়ে ওঠেনি। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার কারণে বাবার চিন্তা ছিলো ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে। তাই অকালে বাবাকে হারিয়ে নিজের প্রতিভা না দেখাতে পারার খেদ মনে রয়ে গেছে জীবনের। স্যান্ড আর্ট অ্যানিমেশন করার ক্ষেত্রে জীবনের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলো তার জ্যেষ্ঠ।

তৈরি করতে চান 'ক্রিয়েটিভ স্কুল'
নতুন প্রজন্মকে স্যান্ড আর্ট শেখানোর চেষ্টা জীবন রায় করছেন। বাংলাদেশে তার কিছু শিক্ষার্থীও রয়েছে। তবে জীবন রায়ের ইচ্ছা একটি ক্রিয়েটিভ স্কুলের মাধ্যমে সবাইকে হাতেধরে শেখানোর। ক্রিয়েটিভ স্কুলের উদাহরণ দিতে গিয়ে জীবন রায় বারংবার উচ্চারণ করেছেন ইন্ডিয়া ও চায়নার কথা।
তিনি বলেন, 'ইন্ডিয়াতে বাচ্চাদের ড্রয়িং শেখানো হয় মাটি-বালুর মাধ্যমে। তাদেরকে বলে দেওয়া হয়- বানাও দেখি, কী বানাতে পারো। বাচ্চারা মাটি বালু ঘাটাঘাটি করতে ভালোবাসে। আমাদের এখানে প্রসেসটা যদি এরকম হয় তাহলে দারুণ একটা জেনারেশন পরিবর্তন করা পসিবল।'
বাংলাদেশে কেন এখনো স্যান্ড আর্ট বড় শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, জানতে চাইলে জীবন বলেন, 'আমরা স্যান্ড আর্টকে এখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না, আমরা এর ভ্যালু বুঝতে পারি না। স্যান্ড আর্টের সেটাপ যদি আমরা কোথাও নিয়ে যাই, এর একটি খরচ রয়েছে। স্যান্ড আর্টের আলাদা মূল্য থাকা সত্ত্বেও কেউ ভাবে না এর একটি খরচ থাকতে পারে। যথাযথ মূল্যায়ন নেই বলেই এখনো ছড়িয়ে পড়ছে না বলে আমি মনে করি।'
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সহাস্যে জীবন রায় জানান, 'ভবিষ্যতে ক্রিয়েটিভ স্কুল দিতে চাই এটাই প্রধান লক্ষ্য। চোখ বন্ধ করে দারুণ দারুণ গল্প বলতে চাই। স্যান্ড আর্ট দিয়ে সিনেমা বানাতে চাই। অনেক বড় বড় শো'তে যেতে চাই। সবশেষে অনেক টাকা উপার্জন করতে চাই, হা হা!'
বর্তমানে জীবন রায়ের দলে মোট ৬ জন কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে 'স্যান্ড ক্রিয়েশন্স বাই জীবন রায়' নামে একটি পেজ আছে। ৪৩ হাজার ফলোয়ার সমৃদ্ধ পেজটিতে জীবন রায়ের সব রকমের কাজ খুঁজে পাওয়া যাবে। স্যান্ড আর্টের পাশাপাশি জীবন রায় একজন অভিনেতাও বটে। স্যান্ড আর্ট, থিয়েটারের এসবের বাইরে 'অর্গানিক এগ্রো' নামে একটি ফার্মও জীবন রায়ের রয়েছে।