যে কারণে ছাত্রীদের বাড়িতে ছুটে চলা

বাল্যবিবাহকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে এবং নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে অবিরাম পথ চলছেন দিনাজপুর ঈদগাহবস্তি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান। বিদ্যালয় বন্ধ, ছুটি কিংবা বিশেষ দিন বিবেচনা না করেই রুটিনমাফিক প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাড়ি-বাড়ি ছুটে যান তিনি। শোনেন তাদের পরিবারের কথা, সমস্যার কথা। চেষ্টা করে সাধ্যমতো সেসব সমাধানের।
আবার অভিভাবকদের বোঝান, যেন কোনো মেয়ের বাল্যবিবাহ না হয়। বাল্যবিবাহের কুফলগুলো বোঝান; আরও বোঝান, বর্তমানে নারীদের জন্য শিক্ষা কতটা প্রয়োজনীয়।
করোনার এই সময়ও থেমে নেই তার পথচলা।
দিনাজপুর জেলা শহরের ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। তাই তাদের অভাব-অভিযোগ কিংবা পারিবারিক সমস্যা প্রায় লেগেই থাকে। কিন্তু যেন অভাব কিংবা পারিবারিক সমস্যায় কোনো শিক্ষার্থী ঝরে না পড়ে, সেজন্য নিয়ম করে শিক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি ছুটে যান তিনি।
শুধু বাল্যবিবাহ বন্ধ কিংবা নারী শিক্ষা প্রসারেই নয়, শিক্ষার্থীর সুস্থ্য মনন বিকাশে খেলাধুলার দিকেও ধাবিত করতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নারী ফুটবল দল গঠন করেছেন। দলটি জেলা টুর্নামেন্টে বরাবরই চ্যাম্পিয়ন। মাঝপথে কোনো শিক্ষার্থীর লেখাপড়া যেন বন্ধ না হয়, সেজন্য প্রসারিত করেছেন সাহায্যের হাতও।

ফজলুর রহমান বলেন, 'প্রায় ১০ বছর আগে আমার বিদ্যালয়ের ২ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়। বিষয়টিতে আমি তখন খুব বেশি মনোযোগ দেইনি। কিন্তু এক সময় খোঁজ নিয়ে জানলাম, এক ছাত্রীর স্বামী মারা গেছেন। আরেক ছাত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। খবরটা জানার পর নিজেকে অপরাধী মনে হলো। আর সেই অপরাধবোধ থেকেই আমি প্রতিটি ছাত্রীর বাড়িতে যাই, যেন কারও বাল্যবিবাহ না হয়। তাদের অভিভাবকদের বাল্যবিবাহের কুফল সমন্ধে বোঝাই। আরও বোঝাই, একজন ছাত্রীর জীবনে পড়ালেখা কতটা জরুরি।'
'আমার মনে হয়, একদিন প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমার মতো বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেবেন। আর সেদিনই হবে আমার এই পথচলার স্বার্থকতা,' বলেন তিনি।

শিক্ষকতার টান
ফজলুর রহমান বলেন, 'আমি মনে করি শিক্ষকতা মহান পেশা এবং শিক্ষকতার উপরে অন্য কোনো পেশা নেই। আগে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতাম। এই পেশাকে আমি ভালবাসি বলেই সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতায় এসেছি।'
'বিশেষ করে সমাজে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা যে অধিকার এবং এই শিশুগুলোকে শিক্ষা দিতে হবে- এটি আমাকে অনুপ্রাণিত করে। হতদরিদ্র শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে আমাকে অনুপ্রাণিত করে,' যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, '১৯৯৪ সালে পার্বতীপুর উপজেলার ইন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতায় প্রবেশ করি। এরপর যেহেতু জেলা শহরে থাকি, এজন্য ২০০৬ সালে ঈদগাহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আবেদন করি এবং পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যোগদান করি।'
'আমি বুঝি, শিক্ষকতা পেশায় নিজের একটি দায়বদ্ধতা থেকে সমাজকে অনেক কিছু দেওয়া যায়,' বলেন তিনি।
ব্যক্তিজীবন
ব্যক্তিজীবনে ফজলুর রহমান ২ কন্যার জনক। এদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সী ফাহিমা রহমান গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিকেল বিষয়ে অনার্স পড়াশোনা করছেন। অন্যদিকে, ছোট মেয়ে ফাইজা রহমানের বয়স ১০ বছর। সে দিনাজপুর ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
'তারা নিজেরা কোন পেশায় যাবে, যেটা তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। তবে বড় মেয়ে আমাকে বলেছে, সেও শিক্ষকতা করবে,' জানান ফজলুর রহমান।
তিনি বলেন, 'শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখালেই শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষককে শিক্ষক হতে হয়। যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে আজীবন বেঁচে থাকতে পাারেন, তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। তবে শিক্ষক হওয়ার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ইচ্ছাশক্তি, পাঠদানে যোগ্যতা এবং মেধা থাকলে যে কেউ শিক্ষক হতে পারেন। তবে শিক্ষকতা পেশা কোনো চাকরি নয়; এটা একটা ব্রত।'

কোচিং ভাবনা
'কোচিং করানোকে আমি ভালো চোখে দেখি না। কারণ ক্লাসে একটি শিশু যদি শিক্ষকের ক্লাস মনোযোগ সহকারে করে, তাহলে তার কোচিংয়ের প্রয়োজন হয় না। এখানে শিক্ষককেও তার ক্লাসে মনোযোগ সহকারে শিক্ষাপ্রদান করতে হবে। তাহলে কোনো শিশু আর কোচিং সেন্টারে যাবে না,' বলেন ফজলুর রহমান।
আরও বলেন, 'কোচিং এক প্রকারের বাণিজ্য। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।'
তার প্রসঙ্গে দিনাজপুর সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক মোসাদ্দেক হুসেন বলেন, 'একজন শিক্ষকের কাজ অনেক। আমরা শুধু মনে করি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। কিন্তু ফজলুর স্যার আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন শিক্ষকের দায়িত্ব আরও আছে। ওই স্যারের বাড়ি আমার এলাকাতেই। আমি কখনোই তাকে বাজার কিংবা অন্য কোনো স্থানে অযথা সময় অপচয় করতে দেখিনি। তাকে দেখেছি শিক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি ঘুরতে।'
একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন কুমার রায় বলেন, 'শিক্ষক ফজলুর রহমান স্যারের দেখানো পথেই এখন আমরা হাঁটছি। কিছুটা হলেও মনোযোগ দিয়েছি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং নারী শিক্ষা প্রসারে। আমার মনে হয়, প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এভাবে একদিন এগিয়ে আসবেন এবং বাল্যবিবাহমুক্ত একটি সমাজ গড়ে উঠবে- যেখানে সকল ভেদাভেদ ভুলে নারী-পুরুষ সমানতালে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নেতৃত্ব দেবে।'

দিনাজপুর শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক লোকমান হাকিম বলেন, 'শিক্ষক ফজলুর রহমান আমাদের গর্ব। তিনি যে কাজ শুরু করেছেন, গত ১০ বছর ধরে সেটি এখন অনুকরণীয়। তার এই কাজের জন্য অনেকেই বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। একজন শিক্ষক সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেখানো ও যাবতীয় কাজ শেষে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেন। কিন্তু ফজলুর রহমান স্যার বিশ্রামের সেই সময়টুকু ব্যয় করেন শিক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বাল্যবিবাহ রুখতে ও নারী শিক্ষা প্রসারে।'
বিদ্যালয়ের ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর বাড়িতে নিয়ম করে প্রতিদিন গিয়ে শিক্ষার হালচাল এবং নারী শিক্ষাকে প্রসারিত করতে এমন মহতী উদ্যোগের স্বীকৃতি স্বরূপ নরওয়ের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়েছেন ফজলুর রহমান।