মন ভালো নেই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবাদের

আজ বাবা দিবস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে মন ভালো নেই সাতক্ষীরার বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবাদের। তাদের সন্তানরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। কেউ বড় চাকরিও করেন। তবে তারা কেউই বাবার খবর রাখেন না।
সাতক্ষীরা শহরের উত্তরকাটিয়া এলাকায় বেসরকারি সংস্থা 'আরা' পরিচালিত একটি বৃদ্ধাশ্রম 'প্রবীন আবাসন কেন্দ্র'। এখানে বসবাস করছেন ১৮ জন বৃদ্ধ। তাদেরও রয়েছে পরিবার, ছেলে-মেয়ে।
বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার সোনাকান্ত গজালিয়া গ্রামের মৃত শেখ রহমত আলীর ছেলে জাবেদ আলী (৬০)। তিনি এখন এই বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা। গত চার বছর ধরে এ বৃদ্ধাশ্রমেই বসতি দুই ছেলে ও এক মেয়ের এই বাবার। ছেলেরা ঢাকাতে থাকেন। মেয়েটি থাকেন তার স্বামীর সঙ্গে। কষ্টের যেন শেষ নেই এই বাবার।

জাবেদ আলী বলেন, 'চার বছর ধরে এখানেই আছি। ছেলে-মেয়েরা কেউ খোঁজ খবর নেয় না। ছেলেরা ঢাকাতে থাকে। তাদের অভাব নেই। তবে তাদের বাড়িতে আমার জায়গা হয়নি।'
'বউমা বলেছিল, আপনি বেশি বোঝেন! এই বাড়িতে এত বেশি কথা বলা যাবে না। এখনকার বৌয়েরা বয়স্ক শ্বশুরদের বোঝা মনে করে; দেখতে পারে না। এভাবেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজনের মারফত এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে পড়ি চার বছর আগে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'ছেলে-মেয়েরা জানে আমি এখানে রয়েছি। তবে কেউ কখনো দেখতে আসেনি। বাবা দিবস প্রতিবছরই আসে। তবে বাবার খবর সন্তানরা রাখে না।'
শহরের পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার মৃত আলেক গাজীর ছেলে আলী হোসেন (৬২)। এক বছর ধরে রয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। তিন ছেলে ও এক মেয়ে এই বাবার। সন্তানরা কেউ তার খোঁজ রাখেন না। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর বাসিন্দা হয়েছেন এই বৃদ্ধাশ্রমের।
আলী হোসেন জানান, 'স্ত্রী বাড়িতে থাকে। তাকেও দেখতে মন চায়। তবে দেখতে পারি না। সন্তানরা কেউ দেখতে পারে না আমাকে। বয়স হয়ে গেছে, এখন আমি খারাপ মানুষ হয়ে গেছি!'
জেলার দেবহাটা উপজেলার অস্কারপুর গ্রামের বিলাত আলীর ছেলে জামাত আলী (৬২)। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। সন্তানরা কেউই খবর রাখে না তার। সন্তানদের জন্য মনটা খারাপ বলে জানান এই বাবা।
১৮ জনের এই বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন শহরের পলাশপোল এসপি বাংলোর পেছনের বাসিন্দা এক সময়ের চাকরিজীবী নজরুল ইসলামও (৬৫)। তিনি এখন বৃদ্ধাশ্রমটির ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। গত পাঁচ বছর রয়েছেন এখানেই।
নজরুল ইসলাম বলেন, 'আগে একটি এনজিওতে চাকরি করতাম। এরপর ১৫ বছর ওষুধের ব্যবসা করেছি। দুই মেয়ে এক ছেলে আমার। ছেলে আকিজ গ্রুপে, মানবসম্পদ বিভাগে চাকরি করে। একটা মেয়ে স্বামীর সঙ্গে ঢাকাতে থাকে। সেখানে এলএলবি শেষ করে বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিচ্ছে। আরেকটি মেয়ে রয়েছে বাড়িতেই।'
তিনি বলেন, 'ছেলে-মেয়েরা কেউ খুব বেশি খবর নেয় না। আমি এখানে মানবিক কাজ করি, তারা তা চায় না। তাদের মধ্যে এ মানবতা আসে না!'
'কখনো দেখতেও আসেনি; আমি কেমন আছি- জানতেও চায় না। ছেলে-মেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে। বড় চাকরি করে। বাবার খোঁজ নেওয়ার দরকার পড়ে না তাদের,' বলেন তিনি।
বৃদ্ধাশ্রমের জন্য একটি দাবি জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, "সাতক্ষীরায় সরকারিভাবে কোনো বৃদ্ধাশ্রম নেই। বেসরকারি সংস্থা 'আরা' এটি চালাচ্ছে। এ ছাড়া মানবিক কিছু মানুষ বিভিন্ন সময় সহযোগিতা দেয়। সেগুলো দিয়েই এখানকার বাসিন্দাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। জায়গাটি ভাড়া নেওয়া। সরকারি একটি জায়গায় যদি বৃদ্ধাশ্রমটি স্থায়ীভাবে করা হয়, তবে এমন অনেক অসহায় বাবা শেষ জীবনে একটু ভালোভাবে কাটাতে পারবেন।"
সাতক্ষীরা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক দেবাশীষ সরদার বলেন, 'বৃদ্ধাশ্রমটি রয়েছে, জানি। সেখানে খোঁজ খবর নেওয়া ছাড়া আমাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করার কোনো সুযোগ থাকে না। তাদের দাবির বিষয়টি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে উপস্থাপন করা হবে।'