টানা ৩২ দিন ধরে অসহায়দের খাবারের ব্যবস্থা করছেন যে তরুণ

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১৬ মার্চ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। এরমধ্যে ২০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল খালি করতে শিক্ষার্থীদের নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনের নির্দেশের মধ্যে হাজারো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়ে নিজেদের আপন ঠিকানায় ফিরে গেলেও যান নি কেউ কেউ। দেশের কঠিন দুঃসময়ে মানুষের জন্য 'কিছু করবেন' এমন তাড়না থেকেই ক্যাম্পাসের আশেপাশে থেকে যান তারা। তাদেরই একজন ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সৈকত টানা ৩২ দিন ধরে ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকার ভাসমান লোকজন ও পথশিশুদের দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন।

তিনি জানান, প্রথমদিকে দৈনিক ১০০ পরিবারকে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, তেল প্যাকেট করে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে তার এই উদ্যোগ শুরু হলেও বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আশপাশের ১ হাজার ৪০০ অসহায় মানুষের দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করছেন প্রতিদিন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে সৈকত বলেন, "লকডাউনের পর মানুষের অভাব আর কষ্ট দেখে খুব খারাপ লাগছিলো। তাই ছুটিতে আর গ্রামে যাইনি। নিজের মাস খরচার টাকা থেকে চাল, আলু, পেঁয়াজ কিনে টিএসসিতে তা প্যাকেট করে গত ২৪ মার্চ ৫০টি অসহায় পরিবারকে আমি খাবার কিনে দেই। তখন আমি খাবার বিতরণের ছবি ফেসবুকে দিয়ে বলেছিলাম, এরকম শো-অফ আমি করবো, আপনারাও করুন। ওইদিনই আমার পাশে এসে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় আমার এক বন্ধু এবং টিএসসির একজন স্টাফ মামা। ওই টাকা দিয়ে দুই বন্ধু মিলে পরদিন ১০০ পরিবারকে প্যাকেট করা খাবার পৌঁছে দেই।"

"কিন্তু প্রতিদিন ১০০ লোককে খাবার দিতে আমার টাকার প্রয়োজন। তখন আমি আমার শিক্ষক এবং সিনিয়রদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যেকারণে আমরা খাবারের পরিমাণও বাড়িয়ে দেই। সবার সহযোগিতায় বর্তমানে প্রতিদিন ১৪০০ মানুষের দুইবেলা আহারের ব্যবস্থা করছি টিএসসিতে।"
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য সৈকত জানান, গত ৩২ দিন ধরে হল বন্ধ থাকায় টিএসসির একটি অতিথিকক্ষে থাকছেন তিনি। প্রতিদিন রাতে কারওয়ান বাজার গিয়ে রান্নার জন্য বাজার নিয়ে আসেন। এরপর সকাল বিকেল দুইবেলা রান্না হয়। শহরের ভ্রাম্যমাণ মানুষ, পথশিশু, ভবঘুরে, পাগল সবাইকে ছয় ফুট দূরত্ব (সামাজিক দূরত্ব) বজায় রেখে লাইন করে দাঁড় করান তিনি। এরপর করেন খাবার বিতরণ।

তিনি বলেন, "আজীবন অনিয়মে অভ্যস্ত এই মানুষগুলোকে প্রথমদিকে লাইন করে দাঁড় করানো খুবই কঠিন ছিল। তবে ওরা সবাই এখন আমার আপন হয়ে গেছে। নিজেরাই নিয়ম মানে।"
লকডাউনের সময়সীমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অভাবও বাড়ছে। টিএসসিতে দুই বেলা খেতে আসা মানুষের পরিমাণও বাড়ছে। অন্যদিকে কমছে সাহায্যের পরিমাণ। সৈকতের ভয়, তার এই উদ্যোগ তিনি আর বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা।
তিনি জানান, অসহায় এই মানুষগুলোর পাশে কেউ থাকতে চাইলে তার সঙ্গে 01684023411 নম্বরে যোগাযোগ করতে পারবেন অথবা সুযোগ থাকলে টিএসসিতে এসেও সরাসরি সহায়তা করতে পারবেন।

শনিবার থেকে শুরু হওয়া রমজান মাস উপলক্ষ্যে পুরো মাসজুড়ে অসহায় এই মানুষগুলোর জন্য ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করবেন তারা।
তিনি বলেন, "টাকা যোগাতে না পারলে, ভাসমান এই মানুষগুলো না খেয়ে থাকবে। কারণ টানা ৩২ দিন ধরেই এই মানুষগুলো আমাদের সঙ্গে দুপুর আর রাতের আহার করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শহরের বুকে স্বজনহীন, আশ্রয়হীন, ক্ষুধার্ত এই মানুষগুলো জানে, টিএসসিতে গেলে খাবার পাওয়া যায়। আমরা যদি কিছু না করতে পারি এই মানুষগুলো খুব বেশি বিপদে পড়ে যাবে।"