জলবায়ু পরিবর্তন: ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বসবাস করতে কেমন লাগবে আপনার?
জলবায়ু সংকট এখন আর ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়, এটি বর্তমান। বিশ্বের অনেক জায়গায় এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে এর প্রভাব।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ২০২১ সাল। বন্যা ও দাবানলের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে চরম তাপমাত্রার মাঝে বসবাস করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ; বিপন্ন হয়ে উঠেছে তাদের জীবনযাত্রা।
চরম আবহাওয়া কীভাবে পাঁচজন মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে, চলুন জেনে নেওয়া যাক তাদের বক্তব্য থেকে।
'অগুনতি নির্ঘুম রাত'
ভারতের শাকিলা বানু প্রায়ই রাতে ঘুমানোর জন্য তাদের একতলা বাড়ির ছাদে পরিবারের জন্য বিছানা বিছিয়ে দেন। গ্রীষ্মের রাতে অসহ্য গরমে ঘরের ভেতরে ঘুমনো কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি খালি পায়ে বাড়ির ছাদেও হাঁটা যায় না।
শাকিলার ভাষ্যে, 'এটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টের। আমরা অনেক নির্ঘুম রাত পার করেছি গরমে।'
শাকিলা তার স্বামী, মেয়ে ও তিন নাতি-নাতনির সঙ্গে আহমেদাবাদে একটি জানালাবিহীন ঘরে বাস করেন। তাদের সেই বাড়িতে পুরো পরিবারের জন্য কেবল একটি সিলিং ফ্যান রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভারতের অনেক শহরেই এখন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো 'আরবান হিট আইল্যান্ড' প্রভাবে আক্রান্ত। দিনের বেলায় কংক্রিটের ফাঁদে আটকে পড়া তাপ বিকিরণের মাধ্যমে আবহাওয়াকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। ফলে রাতের বেলায় এই আটকে পড়া তাপের প্রভাবে কংক্রিটের ভবনগুলোয় বসবাস হয়ে ওঠে অসহনীয়।
শাকিলার বাড়িতে তাপমাত্রা এখন পৌঁছেছে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গরমে তিনি অস্থির। চরম তাপমাত্রায় তার নাতি-নাতনিরা এলার্জি ও ডায়রিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয় প্রায়ই।
'আগুনের মতো উত্তাপ'
সিদি ফাদুয়া পশ্চিম আফ্রিকার উত্তর মৌরিতানিয়ার বাসিন্দা। তার মতে, দেশটির উত্তরাঞ্চল এখন আর স্বাভাবিকভাবে মানুষের বসবাস ও কাজ করার জন্য উপযোগী নয়।
তিনি বলেন, 'এখানকার তাপ এখন আর স্বাভাবিক নয়। এটি আগুনের মতো।'
৪৪ বছর বয়সী সিদি সাহারার প্রান্তের কাছাকছি একটি ছোট্ট গ্রামে বাস করেন। পাশেই একটি লবণের খনিতে কাজ করে জীবনযাত্রার খরচ মেটান তিনি। তার এই কাজ যথেষ্ট কঠিন। তার ওপর, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অঞ্চলটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় এটি আরও কঠিন হয়ে গেছে।
সিদির ভাষ্যে, 'এই তাপমাত্রা সহ্য করতে পারছি না। আমরা মেশিন নই; মানুষ।'
গ্রীষ্মের দিনে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেই উত্তাপ থেকে বাঁচতে সিদি এখন রাতের বেলায় কাজ করেন।
জীবিকার জন্য সেখানে কাজের সম্ভাবনাও কমে এসেছে। যারা একসময় পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করত, তারা আর তা করতে পারছে না। কারণ ভেড়া ও ছাগল চরানোর জন্য কোনো চারণভূমি বা গাছপালা অবশিষ্ট নেই।
তাই অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো সিদিও উপকূলীয় শহর নোয়াধিবুতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সমুদ্রের বাতাস ওই শহরকে অনেকটা শীতল রাখে।
নোয়াধিবুতে সিদি মাছ ধরার কাজ খুঁজে পাওয়ার আশা করছেন। সমুদ্রের বাতাসে হয়তো চরম তাপমাত্রার সমস্যা কিছুটা সমাধান হবে। তবে ক্রমবর্ধমান হারে মানুষ যেভাবে মরু অঞ্চল ছেড়ে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে কাজের সন্ধান করছে, তাতে সেখানে নতুন কাজ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সিদি তবু আশাবাদী।
'আপনি কীভাবে এই নরকের উত্তাপ থেকে বাঁচবেন?'
কানাকা বার ফার্স্ট নেশনের প্রধান প্যাট্রিক মিশেল তিন দশকেরও বেশি সময় আগে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে বনাঞ্চলে উদ্বেগজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করেছিলেন। নদীতে পানি কমে যাচ্ছিল, সেইসঙ্গে মাশরুম জন্মানোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এই গ্রীষ্মে তার শঙ্কা বস্তবে পরিণত হয়। উত্তর আমেরিকা জুড়ে চলছে তাপপ্রবাহ। চলতি বছরের ২৯ জুন তার শহর লাইটনে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৯.৬ সেলসিয়াসে। পরদিন তাপমাত্রা ছিল ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সেই তাপমাত্রা রেকর্ডের এক ঘণ্টার মধ্যেই উত্তাপজনিত কারণে তার শহরে আগুন লেগে যায়।
তার আট মাসের গর্ভবতী মেয়ে সেরেনা, তার সন্তানদের ও পোষা প্রাণীগুলোকে গাড়িতে উঠিয়ে কোনো রকম বেঁচে ফিরে আসেন।
প্যাট্রিক আবারও সেখানে ফিরে গিয়েছিলেন, যদি কোনোভাবে তিনি বাড়িটি বাঁচাতে পারেন সেই ভাবনা থেকে। দাবানলে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে প্যাট্রিকের। কিন্তু জলবায়ুর মতোই আগুনেরও পরিবর্তন হয়েছে।
প্যাট্রিক বলেন, 'সেটি আর দাবানল ছিল না; ছিল নরক। আপনি কীভাবে নরকের আগুন নেভাবেন?'
'যখন ছোট ছিলাম, আবহাওয়া এমন ছিল না'
নাইজেরিয়ার নাইজার ডেল্টার বাসিন্দা জয় বলেন, 'আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আবহাওয়া এমন ছিল না।'
এটি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি এবং এখানে প্রতিদিনই বাড়ছে তাপমাত্রা।
জয় জীবিকা নির্বাহের জন্য স্থানীয় বাজারে ট্যাপিওকা (এক ধরনের খাদ্য শস্য) বিক্রি করেন। তবে বিক্রির আগে গ্যাস চালিত অগ্নিশিখা ব্যবহার করে সেগুলো শুকিয়ে নেন তিনি।
জয় বলেন, 'আমার চুল ছোট। কারণ আমি যদি চুল লম্বা করি, তাহলে আগুন দিক পরিবর্তন করলে বা বিস্ফোরিত হলে আমার মাথা পুড়ে যেতে পারে।'
তবে এই অগ্নিশিখাও সমস্যার একটি অংশ। তেল উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো তেলের জন্য ড্রিল করার সময় মাটি থেকে নির্গত গ্যাস পোড়াতে অগ্নিশিখা ব্যবহার করে থাকে। আর এই অগ্নিশিখা বিশ্বব্যাপী কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমনের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্রমবর্ধমান অবদান রাখছে।
জয় বলেন, 'জলবায়ু কেন এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তা বোঝার জন্য এখানকার বেশিরভাগ মানুষই যথেষ্ট সচেতন নয়। তবে আমরা নন-স্টপ ফ্লেয়ার বা অগ্নিশিখার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারি না।'
নিজের ও তার পরিবারের জীবিকার জন্য গ্যাস চালিত অগ্নিশিখার ব্যবহার করে থাকলেও তিনি চান সরকার যেন অগ্নিশিখা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
'এই উত্তাপ স্বাভাবিক নয়'
ছয় বছর আগে ওম নায়েফ মরুভূমিতে একটি রাস্তার পাশে গাছ লাগানো শুরু করেছিলেন। কুয়েতের এই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী গ্রীষ্মের চরম তাপমাত্রা ও ক্রমবর্ধমান ধূলিঝড়ের কারণে ছিলেন উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, 'আমি কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাও বলেছি। তারা সবাই আমাকে বলেছে, বালিতে গাছ লাগানো অসম্ভব। তারা বলেছিল, জমি বালুকাময় এবং তাপমাত্রা খুব বেশি। তাই আমি এমন কিছু করতে চেয়েছিলাম, যা সবাইকে চমকে দেবে।'
ওম বিশ্বের উষ্ণতম জায়গা মধ্যপ্রাচ্যে বাসবাস করেন। তার দেশ কুয়েতে প্রায় নিয়মিতই ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা আরও ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। তবু কুয়েতের অর্থনীতি জীবাশ্ম জ্বালানী রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল।
কুয়েতের অনেক নাগরিকই এখন সরকারকে বড় আকারের গাছ লাগানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের সবার বক্তব্য, কুয়েত এখন জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে প্রস্তুত। ওমের মতে, তাদেরকে অবশ্যই শুকিয়ে যাওয়ার হাত থেকে ভূমি রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, 'এই উত্তাপ স্বাভাবিক নয়। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষদের ভূমি। আমাদের অবশ্যই এটি রক্ষা করতে হবে; কারণ এই ভূমি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে।'
-
সূত্র: বিবিসি
