করিম জানাতের হ্যাটট্রিক ছাপিয়ে বাংলাদেশের নাটকীয় জয়
শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ৬ রান। নতুন ব্যাটসম্যান মেহেদী হাসান মিরাজ সময় নিতে চাইলেন না, করিম জানাতের করা প্রথম বলেই চার মেরে চাপ কমিয়ে আনলেন। কিন্তু অদৃশ্য চাপ তো তখনও তার কাঁধে, সেই চাপেই কিনা পরের বলে ক্যাচ তুলে সাজঘরে মিরাজ। এরপর চরম নাটকীয়তা, টানা দুই বলে তাসকিন আহমেদ ও নাসুম আহমেদকে ফিরিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিক করে বসলেন করিম। দলকে জেতানোর গুরুদায়িত্ব তখন শরিফুল ইসলামের কাঁধে, ২ রান তুলতে হবে ২ বলে। তরুণ এই পেসার নিজের খেলা প্রথম বলেই মেরে দিলেন চার, বাংলাদেশ পেল রোমাঞ্চকর এক জয়।
শুক্রবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তানকে ২ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। আফগানদের বিপক্ষে দশম ম্যাচে এটা বাংলাদেশের চতুর্থ জয়। রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে পাওয়া এই জয়ে সিলেটে জয় খরা কাটলো সাকিবদের। পাঁচ বছর আগে (২০১৮ সালে) এই মাঠে টি-টোয়েন্টি খেলা বাংলাদেশ এখানে আগের দুই ম্যাচেই হেরেছিল। এবারই প্রথম সিলেটের মাঠে টি-টোয়েন্টিতে মিললো জয়ের স্বাদ।
লক্ষ্য বড় ছিল না, কিন্তু যেভাবে শুরু হয়; তাতে চাপ এসে ভর করে। বল-রানের ব্যবধান ক্রমেই চোখ রাঙাতে শুরু করে। অর্ধেক পথ পেরোনোর আগেই চার উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন দুই তরুণ তাওহদি হৃদয় ও শামীম হোসেন পাটোয়ারী। অসাধারণ ব্যাটিংয়ে জয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন তারা। শেষ বেলায় শামীম ফিরলেও বুক চিতিয়ে লড়ে যান ম্যাচসেরা হৃদয়। যদিও অপর প্রান্তে চলতে থাকে ভাঙনের খেলা। তবু শেষ পর্যন্ত তার দুর্বার ইনিংসটি বিফলে যায়নি, দলের অসাধারণ জয়ে সবচেয়ে বড় অবদানের ঘরে তার নামটিই লেখা থাকবে।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা আফগানিস্তান বড় সংগ্রহ দাঁড় করাতে না পারলেও লড়াকু পুঁজি পায়। অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবীর হাফ সেঞ্চুরি ও আজমতউল্লাহ ওমরজাইঢয়ের জড়ো ইনিংসে ৭ উইকেটে ১৫৪ রান তোলে। জবাবে হৃদয় ও শামীমের ৭৩ রানের দারুণ জুটির পরও জেগেছিল শঙ্কা। কিন্তু শেষ ওভারের নাটকীয়তায় শেষ হাসি হাসে বাংলাদেশই। টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান তারা। আগের সফল রান তাড়া ১৩৯, ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে শুরুতেই দিক হারায় বাংলাদেশ। আফগান পেসার ফজলহক ফারুকীর করা ইনিংসের প্রথম ওভারের শেষ বলে স্টাম্প উপড়ে যায় রনি তালকুদারের। লিটন কুমার দাসের সঙ্গে যোগ দিয়ে শুরুর চাপ অনেকটাই কাটিয়ে তোলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। দ্বিতীয় উইকেটে ২৫ রান পায় বাংলাদেশ।
অনেকটা থিতু হয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আউট হন ১২ বলে একটি ছক্কায় ১৪ রান করা শান্ত। দলীয় ৩০ রানে আফগান স্পিনার মুজিব-উর-রহমানের বল সুইপ করতে গেলে বল শান্তর গায়ে লেগে স্টাম্পে আঘাত হানে। ৯ রান পর নিজের উইকেটটি বিলিয়ে দিয়ে আসেন লিটন। এগিয়ে খেলতে গিয়ে বল আকাশে তোলেন উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান, যা সহজেই তালুবন্দী করেন রশিদ খান। ১৯ বলে ২টি চারে ১৮ রান করেন লিটন।
এরপর দ্রুতই উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে লড়াই শুরু করেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। কিন্তু মারকুটে মেজাজে ব্যাটিং শুরু করতেই থামতে হয় তাকে। ১৭ বলে ৩টি চারে ১৯ রান করে আউট হন সাকিব। ৬৪ রানে ৪ উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন দুই তরুণ হৃদয় ও শামী হোসেন পাটোয়ারী।
হৃদয় ততোক্ষণে থিতু হয়ে গেছেন, শামীমও সময় নেননি। আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের করা ১৩তম ওভার থেকে আসে ২১ রান। হৃদয় ২টি চার ও শামীম একটি চার মারেন। দুটি সিঙ্গেল ও একটি ডাবলের পাশাপাশি ওয়াইডসহ চার দেন ওমরজাই। অনেক পিছিয়ে থাকলেও হৃদয় ও শামীমের ব্যাটে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। শেষ ৬ ওভারে জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন দাঁড়ায় ৪৯ রান।
এই জুটি আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেয়। ১৮তম ওভারে গিয়ে আউট হন শামীম, ভাঙে ৪৩ বলে ৭৩ রানের জুটি। প্রচন্ড চাপ সামলে ২৫ বলে ৪টি চারে ৩৩ রানের মহাকার্যকর ইনিংস খেলেন শামীম। ৩২ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪৭ রানে অপরাজিত থাকেন হৃদয়, এটাই তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার সেরা রান। শেষ ওভারে হ্যাটট্রিক করা করিম জানাতের শিকারও এই ৩ উইকেট। রশিদ খানের পর আফগানদের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়লেন তিনি। ফজলহক ফারুকী, মুজিব-উর-রহমান, আজমতউল্লাহ ওমরজাই, রশিদ খান ও ফরিদ আহমেদ একটি করে উইকেট পান।
এর আগে ব্যাটিং করতে নামা আফগানরা নাসুম আহমেদ ও তাসকিন আহমেদের বিপক্ষে সাবধানী শুরু করে। দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে ছক্কা মেরে খোলস ছাড়েন রহমানউল্লাহ গুরবাজ। পরের ওভারের প্রথম বলে ছক্কা মারেন হজরতউল্লাহ জাজাই। তখন মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর এই দুই ব্যাটসম্যান ঝড় তুলতে যাচ্ছেন না। যদিও নাসুম বাধায় তা হয়নি, তৃতীয় ওভারেই জাজাইকে ফিরিয়ে দেন তিনি। ১০ বলে ৮ রান করেন আফগান এই ওপেনার।
পরের ওভারে আফগানদের ইনিংসে সবচেয়ে বড় আঘাতটি হানেন তাসকিন, তার শিকার গুরবাজ। তাসকিনের লেংথ বলে কবজির মোচড়ে ছক্কা মারতে গিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ধরা পড়েন ১১ বলে ১৬ রান করা গুরবাজ। এরপর শরিফুল ইসলামের বলে ইব্রাহিম জাদরানের ব্যর্থ হওয়ার সেই পুরনো গল্প আবারও ফিরে আসে।
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে আগে চারবার শরিফুলের বিপক্ষে আউট হওয়া ইব্রাহিম আজও বাঁহাতি এই পেসারের শিকারে পরিণত হন একইভাবে। গত বছর একবার ওয়ানডেতে শরিফুলের শিকার হন তিনি। এবার টেস্টের দুই ইনিংস ও একটি ওয়ানডেতে শরিফুলের বলে আউট হওয়া ইব্রাহিম আজও একইভাবে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে থামেন।
৩২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়া দলটি কিছু সময়ের জন্য স্বস্তি পায়, চতুর্থ উইকেটে ২০ রানের জুটি গড়েন মোহাম্মদ নবী ও করিম জানাত। আফগানরা গুছিয়ে নেওয়ার পরপরই সাকিব আল হাসানের আঘাত, তার শিকার করিম জানাত। এরপর আবারও আফগানদের প্রতিরোধ, নাজিবুল্লাহ জাদরানের সঙ্গে ৩৫ রানের জুটি গড়ে তোলেন এক পাশ আগলে খেলা নবী।
২৩ বলে ৩টি চারে ২৩ রান করা নাজিবুল্লাহকে থামিয়ে এই জুটি ভাঙেন মিরাজ। তবু দমেনি আফগানরা, বরং রান তোলার গতি আরও বাড়ে তাদের। উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া নবীর সঙ্গে যোগ দিয়ে ঝড় তোলেন অলরাউন্ডার আজমতউল্লাহ ওমরজাই। সাকিবের বলে ক্যাচ তুলে আউট হওয়ার আগে ১৮ বলে ৪টি ছক্কায় ৩৩ রান করেন তিনি। নবী-নাজিবুল্লাহর জুটি থেকে আসে ৩১ বলে ৫৫ রান।
আফগানদের ইনিংসের সবচেয়ে বড় নাম নবী তখনও অবিচল। ৩৯ বলে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া ডানহাতি অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান শেষ পর্যন্ত ব্যাট চালিয়ে ৪০ বলে ৬টি চার ও একটি ছক্কায় ৫৪ রান করেন। সাকিব সর্বোচ্চ ২টি উইকেট নেন। নাসুম, তাসকিন, শরিফুল, মুস্তাফিজ ও মিরাজ একটি করে উইকেট পান।
