সর্বাধিক জনবহুল দেশের অলিম্পিক পদকের ঝুলি শূন্য

দ্বিতীয় রাউন্ডেই থেমে গেছে রোমান সানার অলিম্পিক যাত্রা। টোকিও অলিম্পিকে আর্চারির রিকার্ভ এককের দ্বিতীয় রাউন্ডে কানাডার ক্রিসপিন ডুয়েনাসের কাছে হেরে যান দেশসেরা এই আর্চার। হারে যতটা না আক্ষেপ, তার চেয়ে বেশি আক্ষেপ থাকতে পারে একটি পয়েন্টের জন্য। শেষ সেটে এক পয়েন্টের কারণে হার মেনে নিতে হয় দারুণ জয়ে দিন শুরু করা রোমানকে। এই এক পয়েন্টের ব্যবধান হয়তো লম্বা সময় ধরে পোড়াবে তাকে।
রোমানের বিদায়ে যেন বাংলাদেশের আশার প্রদীপই নিভে গেল। প্রথমবারের মতো অলিম্পিক পদক জয়ের স্বপ্ন তো তাকে ঘিরেই দেখছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডেই সে স্বপ্নের সমাধী! দেশের প্রতিশ্রুতিশীল আরেক আর্চার দিয়া সিদ্দিকীর খেলা এখনও বাকি। তবে তাকে নিয়ে সেভাবে আশা দেখছে না বাংলাদেশ।
টোকিও অলিম্পিকের আগে দারুণ পারফরম্যান্সে আশার বেলুন ফোলান রোমান-দিয়া জুটি। সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ আর্চারি স্টেজ-২ এর রিকার্ভের মিশ্র ইভেন্টের ফাইনালে উঠেছিলেন তারা। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারলেও টোকিও অলিম্পিকে ভালো করার আশা জাগান তারা। বিশেষ করে রোমান সানা, যদিও দেশসেরা আর্চারের পথচলা দীর্ঘ হলো না।
টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া বাকি চার অ্যাথলেট হলেন মোহাম্মদ জহির রায়হান (সাঁতার, পুরুষদের ৪০০ মিটার), আবদুল্লাহ হেল বাকি (শুটিং- পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল), মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম (সাঁতার- পুরুষদের ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল) এবং জুনায়না আহমেদ (সাঁতার- নারীদের ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল)। এদের নিয়ে আশা নেই বললেই। এর মধ্যে শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি ইতিমধ্যে বাছাইপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছেন।
অর্থাৎ, অলিম্পিক আরও একবার পুরনো গল্প লেখা হতে চলেছে। আরও একবার খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত ৪৯ জন অ্যাথলেট ১০টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু গ্রীষ্ম বা শীতকালীন অলিম্পিকে কেউই দেশকে পদক জেতাতে পারেননি।

বাংলাদেশি অ্যাথলেটদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সেরা পারফরম্যান্স সিদ্দিকুর রহমানের। রিও অলিম্পিকে চূড়ান্ত বাছাই পর্বে ৬০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ৫৫তম স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে পুরুষদের এয়ার রাইফেল শ্যুটিংয়ে আবদুল্লাহ হেল বাকি ৫০ প্রতিযোগীর মধ্যে ২৫তম হন। কাজী সায়েক সিসার ২০১২ সালে পুরুষদের প্যারালাল বারে ৭১ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ২৭তম স্থান দখল করেন। এ ছাড়া ২০১২ সালে এয়ার রাইফেল শ্যুটিংয়ে শারমিন রত্না ৫৬ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ২৭তম হন।
এদের মধ্যে সিদ্দিকুর রহমান কেবল চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিলেন। বাকিরা অলিম্পিকে অংশ নেন ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে এবং কেউই বাছাই পর্ব পেরোতে পারেননি। প্রতিবারই আশার বেলুন ফোলানো হয়, কিন্তু কোনোবারই পদক ছুঁয়ে দেখা হয় না। এখন পর্যন্ত কেউই পারেননি দেশকে পদক এনে দিতে।
বাংলাদেশ ৭২টি দেশের মধ্যে একটি দেশ, যারা কখনও কোনো অলিম্পিক পদক জেতেনি। সর্বাধিক জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার উপরে, যারা কখনও অলিম্পিক পদক জিততে পারেনি। ফিলিপাইন এবং বারমুডাও ছিল এই তালিকায়। কিন্তু টোকিও অলিম্পিকে এই দুই দেশই স্বর্ণ পদক জিতেছে।
কম্বোডিয়া দ্বিতীয় জনবহুল দেশ, যারা কখনও অলিম্পিক পদক জিততে পারেনি। দেশটির জনসংখ্যা ১ কোটি ৫৭ লাখ, যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১০ ভাগের এক ভাগ। বাহরাইন, বার্বাডোস, বারমুডা, বোতসোয়ানা, বুরুন্ডিসহ আরও অনেক দেশ আছে, যারা অন্তত একটি করে পদক জিতেছে। বাংলাদেশের অলিম্পিক যাত্রার গল্প এদের চেয়েও হতাশার।
চার বছর পর পর অলিম্পিক আসে, জমজমাট লড়াইয়ের পর শেষও হয়ে যায়; আর প্রতিবারই খালি হাত থেকে যায় বাংলাদেশের। প্রতি আসর শেষেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের অপেক্ষা কবে ফুরাবে? এ পথে আবারও আশা হতে পারে রোমান সানার বলা কথা। দেশসেরা এই আর্চার টোকিও অলিম্পিকে হারের পর জানিয়েছেন, ২০২৮ অলিম্পিকে দেশকে স্বর্ণপদক এনে দিতে দিতে চান।

ধারাবাহিক ব্যর্থতার পেছনে কী কারণ? প্রধান দুটি কারণ হতে পারে অর্থাভাব ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব। বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের আয় সীমিত এবং বড় পর্যায়ে লড়ার জন্য সঠিক নির্দেশনাও পান না তারা। প্রশ্ন করলে দেখা যাবে অনেক অ্যাথলেটই বলছেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা অন্য পেশার সঙ্গেও জড়িত।
পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেউ ভালো করলে তাকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। যেটা দেখা গেছে রোমান-দিয়া জুটি বিশ্বকাপের স্টেজ-২ এর দ্বৈত রিকার্ভের ফাইনালে ওঠার পর। কিন্তু তারা কী পরিকল্পনা অনুসরণ করে, ফেডারেশনগুলো তাদেরকে কী নির্দেশনা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়? সহজ উত্তর হবে, এসবের কোনো বালাই নেই। এমনকি তারা প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত কোচও পান না।
বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইন্তেখাবুল হামিদ মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবে সাফল্য ধরা দিচ্ছে না। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে আমাদের বড় দায় আছে, যা আসলে দৃশ্যমান। আমাদের খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণও পান না। এ দুটি বিষয় আমাদের পিছনে ফেলে দিচ্ছে।'
অর্থাভাব ও স্পন্সরের বিষয়ও বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন তিনি। ইন্তেখাবুল হামিদ বলেন, 'আমাদের পর্যাপ্ত অর্থ নেই এবং আমাদের জন্য কোনও স্পন্সরও নেই। যেকোনো কিছু করতে সরকারের সহায়তার উপর নির্ভর করতে হয় আমাদের।'
কতোটা অগোছালো অবস্থা, সেটার বড় প্রমাণ রিও অলিম্পিকে পাওয়া গেছে। মূল কোচ ছাড়াই রিও অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা। কোচের ভূমিকায় ছিলেন কর্মকর্তারা। সাঁতারু মাহফুজুর রহমান সাগর ও সোনিয়া আক্তার টুম্পার কোচের দায়িত্ব ছিলেন বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রফিজউদ্দিন রফিজ। যদিও তার কোচিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না।

ক্রিকেটের প্রতি সব সময়ই বিশেষ নজর বাংলাদেশের, যা অলিম্পিকের কোনো খেলা নয়। পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে এই বিষয়টিকেও অনেকে সামনে তুলে ধরেন। খেলাধুলার অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে বেশিরভাগ তরুণ ক্রিকেট ও ফুটবলের মতো করে অন্যান্য খেলায় নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার সহাজ দেখান না।
এ ছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর চিন্তা থাকে, সন্তানরা এমন একটি পেশা বেছে নিক যেখানে ঝুঁকি কম কিন্তু স্থিতিশীল জীবনের নিশ্চয়তা আছে। খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলে সেই নিশ্চয়তা মিলবে না। যে কারণে তারা ভবিষ্যতের কথা ভেবে অন্যান্য পেশায় ঝুঁকে পড়েন। এখনও মধ্যবিত্ত পরিবার খেলাধুলাকে বিনোদনের মাধ্যমই মনে করে।
বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি এএসএম আলী কবির মনে করেন, বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। খেলাধুলাকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়াটা পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।
তার ভাষায়, 'আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য আমাদের একটি জাতীয় জাগরণ প্রয়োজন, বলতে পারেন একটি বিপ্লব দরকার। প্রথমত, আমাদের একটি কার্যনির্বাহী ক্রীড়া কমিটি দরকার, যা ভালো ভবিষ্যতের জন্য দিক নির্দেশনা দেবে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। খেলাধুলা প্রচার করার জন্য আইনও দরকার আমাদের।' এটা করা সহজ হবে না বলে জানান তিনি। তবে আলী কবির জানান, প্রথম পদক্ষেপটি দ্রুতই গ্রহণ করা উচিত।