পানি বাহক থেকে ফরাসি কিংবদন্তি দেশম আরেকটি জয়ের দ্বারপ্রান্তে!

খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার হিসাবে ইতিমধ্যেই বিশ্বকাপ বিজয়ী দিদিয়ের দেশম রবিবার তার ফুটবলের খাতায় আরেকটি অসাধারণ অধ্যায় লিখতে পারেন, যেটি সম্ভবত ফ্রান্সের দায়িত্বে থাকা তার শেষ ম্যাচ।
লেজ ব্লুজরা ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের পর প্রথম দেশ হতে পারে যারা নিজেদের শিরোপা ধরে রাখবে, একইসাথে দেশমও হয়ে যেতে পারেন দ্বিতীয় কোচ যিনি তার দেশকে কোচ হিসেবে দুটো বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন।
টুর্নামেন্ট শেষ হলেই এই ৫৪ বছর বয়সী কোচের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এবং লিওনেল মেসি-অনুপ্রাণিত আর্জেন্টিনার বিপক্ষে রবিবারের ফাইনালে যা-ই ঘটুক না কেন, ফরাসি ফুটবল লোককথায় দেশমের গল্প স্থায়ীভাবে লেখা হয়ে গেছে।
'পানিবাহক ছাড়া আর কিছু নয়'
ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড এবং স্পেনের বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন দেশম, সবজায়গাতেই ভালো পারফর্ম করেছেন। যে কারণে তাকে তৎকালীন সময়ের অন্যতম সেয়া ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে সবাই তার ভক্ত ছিলেন না।
"দেশম তার পুরোটুকুই খেলার মধ্যে দেয় বলে সে পার পেয়ে যায়, কিন্তু সে কখনই পানিবাহক ছাড়া এরচেয়ে বেশি কিছু হতে পারবে না। আপনি তার মতো খেলোয়াড়দেরকে প্রতিটি রাস্তার কোণে খুঁজে পাবেন," ফ্রান্সের সাবেক সতীর্থ এরিক ক্যান্টোনা ১৯৯৬ সালের এক সাক্ষাত্কারে দেশম সম্পর্কে বলেছিলেন।
১৯৯৩ সালে মার্শেই এবং ১৯৯৬ সালে জুভেন্টাসের সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের কথা উল্লেখ করে দেশম এর জবাব দিয়েছিলেন: "রাস্তার কোণে আপনি কতজন খেলোয়াড় খুঁজে পাবেন যারা দুটি ইউরোপীয় কাপ জিতেছে?"
২০০১ সালে অবসর নেওয়ার সময় দেশম চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলেছেন, জিতেছেন পাঁচটি ঘরোয়া লিগ শিরোপা (দুটো মার্শেইয়ের সাথে এবং তিনটি জুভেন্টাসের সাথে), পাশাপাশি জুভেন্টাসের সাথে কোপা ইতালিয়া এবং চেলসির সাথে এফএ কাপও জিতেছেন।

দেশমের খাতায় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার আরও বেশি সফল। তার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স, ২০০০ সালের ইউরো জেতা ফ্রান্স দলের আর্মব্যান্ডও ছিল তার হাতেই। তার সতীর্থ মার্সেল ডেসাইলি বিবিসির ডকুমেন্টারি হাউ টু উইন দ্য ওয়ার্ল্ড কাপে বলেছেন: "দিদিয়ের আমাদের দলের সবার অধিনায়ক এবং ও একজন প্রাকৃতিক নেতা।"
সফল হওয়ার মূলমন্ত্র
দেশমের কোচিং ক্যারিয়ারও ঊর্ধ্বমুখী। এক এক করে দায়িত্ব পালন করেছেন মোনাকো, জুভেন্টাস, মার্শেইয়ের। অবশেষে ২০১২ সালে দায়িত্ব নেন ফ্রান্স জাতীয় দলের।
২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর ২০১০-এর জয়হীন বিশ্বকাপ ফ্রান্সের জন্য একটি বিপর্যয় ছিল। গ্রুপের শেষ দল হিসেবে প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে পড়েছিল তারা, তারপর ম্যানেজার রেমন্ড ডোমেনেক আর স্ট্রাইকাল নিকোলাস আনেলকার মধ্যে বাক-বিতণ্ডায় খেলোয়াড়ড়া ট্রেনিং করতে অস্বীকৃতি জানায়। বিশ্বকাপজয়ী ডিফেন্ডার লরেন্ট ব্ল্যাঙ্কও এরপর দায়িত্ব নেন। তবে তার প্রথম ও একমাত্র টুর্নামেন্ট ২০১২ সালের ইউরোতে স্পেনের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে পদত্যাগ করেন তিনি। এরপরেই দায়িত্ব নেন দেশম।
দেশমের অধীনে ২০১৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছায় ফ্রান্স, ১-০ গোলে হারে বিজয়ী জার্মানদের কাছে। ২০১৬ ইউরোতেও অল্পের জন্য স্বপ্নভঙ্গ হয়, ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হারে একই ব্যবধানে।
ততদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ফ্রান্স দেশমের অধীনে এক নতুন দল তৈরি করে ফেলেছে।
২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্স অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ ব্যবধানে জয় পেলেও দেশমকে তার খেলোয়াড়দেরকে বলতে দেখা যায় যে অস্ট্রেলিয়ানরা ফরাসিদের চেয়ে দ্বিগুণ দৌড়েছে। স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পেকেও তার কম প্রচেষ্টার জন্য কথা শুনতে হয়।

প্রাক্তন প্রেস অফিসার ফিলিপ টুর্নন দেশম সম্পর্কে বলেন, "দেশম সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তির সাথে সঠিক শব্দ ব্যবহার করেন, এ ব্যাপারে তিনি একজন মাস্টার। তিনি জানেন কখন লাঠি বের করতে হবে এবং কখন গাজর বের করতে হবে। কখন নরম স্বরে কথা বলতে হবে আর কখন ঘুষি মারতে হবে।"
রাশিয়া বিশ্বকাপে শেষ ষোলতে আর্জেন্টিনার সাথে ৪-৩ গোলে জিতেছিল ফ্রান্স, তার ঠিক পরেই তার দল সামলানোর চূড়ান্ত উদাহরণ দেখিয়েছিলেন দেশম। টুর্নন জানান, "ম্যাচ জেতার পর বেশ কয়েকজন ফরাসি খেলোয়াড় সারারাত বাইরে থেকে ভোরবেলায় ক্যাম্পে ফিরে এসেছিল। চিৎকার করতে করতে তারা ফিরে আসার সময় ঘুমন্ত খেলোয়াড়দের জাগিয়ে তোলে। তাদের থামাতে ডিফেন্ডার আদিল রামি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র স্প্রে করে, হোটেলের করিডর বাষ্পে ভরে যায়। ততক্ষণে স্মোক ডিটেক্টর বন্ধ হয়ে গেলেও, পুরো হোটেল জেগে গিয়েছে। আমার রুমটি দেশমের পাশেই ছিল, আমি ভেবেছিলাম দেশম খেলোয়াড়দেরকে একেবারে ছিঁড়ে ফেলবে এ কাজের জন্য। দেশম তারপর ওদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে এবং খেলোয়াড়দের সাথে রাগের লেশমাত্র দেখায়নি। পরে আমাকে বলেছিল, 'আমি যদি ওদেরকে রেগে কিছু বলতাম, তাহলে আমরা গত পাঁচ-ছয় সপ্তাহ ধরে দলের মধ্যে যে একতা আর ঐক্য তৈরি করেছি তা ভেঙে যেত।"
ফ্রান্স এরপর একে একে উরুগুয়ে আর বেলজিয়ামকে হারায়, ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে ৪-২ গোলে জেতার আগে। খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা তৃতীয় এবং শেষ ব্যক্তি হিসেবে নাম লেখান তিনি।

বিশ্বকাপ জয়ের পর পগবা দেশমের দিকে ইঙ্গিত করে ক্যামেরার দিকে চিৎকার করেন, "তিনিই তারকা, তিনিই প্রধান, বিশ্বকাপের তারাটি তার মাথায়"।
'ব্যক্তির চেয়ে শক্তিশালী দল'
২০২২ বিশ্বকাপের আগে জুন মাসের চারটি ম্যাচ জিততে ব্যর্থ হয় ফ্রান্স, ব্যালন ডি'অর জেতা করিম বেনজেমাও ইনজুরিতে পড়ে যায়।
ইনজুরির তালিকায় বেনজেমার সাথে যোগ হয় মিডফিল্ডার পগবা এবং এন'গোলো কান্তে, যারা দুজনেই ২০১৮ সালের মূল খেলোয়াড় ছিলেন। তবুও ফ্রান্স এই ত্রয়ীকে ছাড়াই সামলাতে সক্ষম হয়েছে।
এমবাপ্পে পাঁচটি গোল করেছেন, ৩৬ বছর বয়সী অলিভিয়ের জিরু করেছেন চারটি গোল। অন্যদিকে আঁতোয়া গ্রিজম্যান করেছেন তিনটি অ্যাসিস্ট, সাথে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করার কৃতিত্বও তার। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলা ফ্রান্স দলের দুই উইঙ্গার হিসেবে এমবাপ্পে এবং দেম্বেলেকে রেখেছেন দেশম, সাথে পোগবা এবং কান্তের অনুপস্থিতিতে নামিয়েছেন আদ্রিয়েন র্যাবিয়ট এবং অরেলিয়ান চুয়ামেনি।
ইংল্যান্ড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট বলেছেন, "দেশম এমন একটি দল তৈরি করেছেন যা একজন ব্যক্তির চেয়ে শক্তিশালী, ফ্রান্সের অবস্থা সবসময় এরকম ছিল না।"
ফরাসি ফুটবল সাংবাদিক জুলিয়েন লরেন্স, বিবিসি রেডিও ফাইভে বলেন, "দেশম এক অবিশ্বাস্য কাজ করেছে। এই দলের সাথে ২০১৮ সালে জয়ী দলের খুব মিল: কারণ কোচ একজনই। তারা আরও ভালো খেলতে পারত, কিন্তু দেশম তাদেরকে এক নির্মম বিজয়ী দলে পরিণত করেছে। তাদের একমাত্র চিন্তা: জয় নিয়ে বাড়ি ফেরা।"