ঘোড়ার পিঠে ভারতের পথে

যাত্রা শুরু হয়েছিল কৃষ্ণসাগরের উত্তর প্রান্তে থাকা আজোভ থেকে। তারপর থেকে আর থামাথামি নেই, ৬ হাজার ঘোড়ার প্রকা- বহর নিয়ে ভারতের দিকে ছুটে চলেছে একদল বণিক। যাত্রাপথের দৃশ্য প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, কখনো বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, কখনো জলশূন্য মরুভূমি আবার কখনো উঁচু পর্বত। প্রতিটি ঘোড়া যে পোষ মানা, এমনও নয়, প্রায়ই ২-১টা ঘোড়া দলছুট হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোকে ধরে আনার জন্য আবার পিছু ছুটতে হচ্ছে সহিসকে। নিজের ঘোড়া দাবড়ে দলছুট ঘোড়াটিকে অনুসরণ করে তার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে কাছাকাছি এনে নিজের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে দলছুট ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে আবার দলে ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে, আর তা করতে হচ্ছে কোনো রকম জিন (Saddle) ছাড়াই। অবশ্য হাঁটতে শেখার আগেই ঘোড়ায় চড়তে শেখা সহিসদের জন্য এসব কঠিন কিছু নয়। প্রতি ৫০টি ঘোড়ার জন্য রয়েছে একজন করে সহিস। এ রকম ১২০ জন সহিসের তত্ত্বাবধানে ঘোড়ার ভার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঘোড়ামালিকেরা রয়েছেন চাকা লাগানো ক্যারাভানে, সেগুলো টানার জন্যও রয়েছে আরও কয়েকটি ঘোড়া।
তবে যাত্রাপথে বিপদও কম নয়। রাস্তার পাশে ওত পেতে আছে ঘোড়াচোর আর ডাকাতেরা, সাথে আছে নিষ্ঠুর প্রকৃতির চোখরাঙানি। পাহাড়ে তুষারঝড়ের ভয় তো আছেই, মরুভূমিতে পথ হারালে তো কথাই নেই, মারা পড়তে হবে বেঘোরে। রোগেশোকে অসুস্থ কিংবা চোর-ডাকাতের কবলে পড়ে উধাও হয়ে যাওয়া ঘোড়ার মায়াকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার পর অবশ্য এই কষ্টের ফল মিলবে। ভালো জাতের ঘোড়ার জন্য সঠিক মূল্য দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না মোগল সম্রাটেরা। আর সে কথার প্রমাণ তাদের আস্তাবলগুলোই।
এ রকম দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দিয়েই একের পর এক ঘোড়ার বহর নিয়ে হাজির হয়েছেন ঘোড়া ব্যবসায়ীরা। পেট্রোল-ডিজেলচালিত অটোমোবাইল আসার আগে কয়েক হাজার বছর মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন ছিল এই ঘোড়া। বর্তমান সময়ের তারকাদের সুপার কার নয়, তখন আভিজাত্যের প্রতীক ছিল দুর্লভ প্রজাতির ঘোড়া। আর সে কারণে সারা পৃথিবী চষে সেরা জাতের ঘোড়াকে নিয়ে আসা হতো অভিজাতদের চাহিদা মেটানোর জন্য।
ভারতের উদ্দেশে
সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে স্থলপথে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ীরা মূলত মধ্য এশিয়া আর আফগানিস্তানের খোরাসানের ঘোড়া সাথে নিয়ে আসতেন। কেউ কেউ আবার ইরানের দক্ষিণ থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে জলপথে পৌঁছাতেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন বন্দরে। ব্যবসায়ীদের জন্য দুটি রাস্তাই খোলা ছিল, নিজেদের পছন্দমতো রাস্তা বেছে নিতেন। তবে কাছাকাছি হওয়ায় বেশির ভাগই স্থলপথ বেছে নিতেন, আর সে জন্য তাদের অতিক্রম করতে হতো হয় কাবুল অথবা কান্দাহার। উজবেকিস্তান থেকে আসা বাবর দিল্লির মসনদে বসে নাম কামানোর দুই দশক আগে কাবুল অধিকার করে নিয়েছিলেন, তখনই তিনি কাবুলকে অভিহিত করেছিলেন 'হিন্দস্তানের বাজার' হিসেবে। আর তা হবে না-ই বা কেন? সমরখন্দ, বুখারা, বলখ, বাদাকশান, ফেরঘানা থেকে ঘোড়া ব্যবসায়ীরা দলে দলে জমায়েত হতো কাবুলে, অন্যদিকে ভারতবর্ষের ব্যবসায়ীরা কাবুলে আসত দাস, কাপড়, চিনি আর মসলা বিক্রির জন্য।
ইরান, খোরাসান থেকে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ীরা আবার কান্দাহারের পথ ধরত। কারণ, তাদের জন্য ভারতে ঢুকতে হলে কাবুলের চেয়ে কান্দাহারই বেশি উপযোগী। দুই দলই এমনভাবে তাদের যাত্রার সময় ঠিক করে নিত, যাতে করে ঠিক শীতকাল শুরু হওয়ার আগে ভারতে পৌঁছানো যেত। তবে একবার পৌঁছাতে পারলেই কেল্লাফতে, পুরো ভ্রমণের শ্রম আর বিনিয়োগকৃত অর্থ একেবারে সুদে-আসলে ফেরত আসত।
ভারতের পথে
মধ্য এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্য, যেখান থেকেই ঘোড়া আসুক না কেন, সেগুলো জাত অনুসারে আগেই ভাগ করে ফেলা হতো, আর এই ভাগ করা হতো জাতের উৎপত্তির অঞ্চল অনুসারে। বাবরের দ্বিতীয় পুত্র কামরানের ঘোড়াবহরে থাকা বিভিন্ন জাতের ঘোড়া সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলেন এক রাজস্থানী সূত্র। তার মতে, ঘোড়াগুলোকে ৫ ভাগে: তুর্কি, খোরাসানি, ইরাকি, আরবীয় এবং তাজি (ভারতে বেড়ে ওঠা ঘোড়া) ভাগ করা হতো। কয়েক দশক পরে আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল মোগল অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়াগুলোকে ৪ শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। প্রথম শ্রেণিতে ছিল আরবীয় ঘোড়া, সৌন্দর্য আর শৌর্যবীর্যের প্রতীক ছিল এই ঘোড়াগুলো। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল পারস্যতে বেড়ে ওঠা ঘোড়া, আরবীয় ঘোড়ার তুলনায় কিছুটা কম দক্ষতাসম্পন্ন। তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল পারস্য-ইরাকের ঘোড়ার সংকর। আর একেবারে শেষ শ্রেণিতে ছিল তুর্কি ঘোড়া, যেগুলো আসে মধ্য এশিয়া বা তুর্কিস্তান থেকে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর ২১ হাজার তুর্কি ঘোড়াকে মোগল ভারতে পাঠানো হতো। আওরঙ্গজেবের আমলে ইতালীয় পর্যটক নিকোলাই মানুচ্চির ভাষ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ঘোড়া ভারতে আসত, যার মধ্যে ১২ হাজারই ছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য।
জমিদারদের থেকে পাওয়া খাজনা মোগল সম্রাটদের অঢেল সম্পদের মূল অস্ত্র হলেও মধ্য এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ঘোড়া ব্যবসার দিকে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন মোগল সম্রাটরা, বিশেষ করে আকবর থেকে শুরু করে পরবর্তী শাসকেরা। আকবরের আগে খাইবার পাস ছিল প্রচণ্ড এবড়োখেবড়ো, একই সাথে বিপদসঙ্কুল। পরবর্তীতে আকবর খাইবার পাসের মধ্য দিয়ে যেন চাকা লাগানো বাহন যেতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দেন, ফলে ক্যারাভানে করে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা করা আরও সহজ হয়। ব্যবসায়ীদের পথ আরও সহজ করার জন্য নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়, ডাকাত-চোরদের হাত থেকে নিরাপত্তা দিতে তৈরি করা হয় অসংখ্য দুর্গ আর ওয়াচটাওয়ার। নিয়মিত রাস্তায় টহল দিতে দেখা যায় রাজসেনাদের, তা ছাড়া এক দুর্গ থেকে আরেক দুর্গে বার্তা পাঠানোর জন্য বিশেষ ঘোড়াদলের ব্যবস্থা করা হয়, যা পুরো সাম্রাজ্যকেই একসাথে বেঁধে রেখেছিল। রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা গাছের ছায়ায় গ্রীষ্মের তীব্র রোদ গায়ে না লাগায় যাত্রা আরও সহজ হয়ে ওঠে। যাত্রাপথ আরও আরামদায়ক করে তোলার জন্য কয়েক দিন পরেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠতে থাকে ক্যারাভানসরাই।

ক্যারাভানসরাইয়ের বিশ্রাম
ব্যবসায়ীদের বিশ্রাম ও খাবারদাবারের ব্যবস্থা করার জন্য আকবরের হাত ধরে প্রথম রাস্তার ধারে ক্যারাভানসরাই গড়ে ওঠে, তবে আকবর মূলত তৈরি করেছিলেন এসব ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি করার জন্য। অতিথিদের দেখভাল করা এবং একই সাথে সন্দেহজনক কোনো কিছু চোখে পড়লে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আকবর প্রতি সরাইখানায় একজন করে 'আমিন-ই-কারওয়ানসরা' নিয়োগ করেছিলেন। তবে সাধারণত স্বাভাবিক পরিস্থিতির ব্যত্যয় হতো না, নিজেদের 'সততা'র জন্য পরিচিত ব্যবসায়ীরাও নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী রাস্তা দিয়ে যেতে পারত।
তবে সরাইখানা যে কেবল সম্রাটের অর্থায়নে তৈরি হতো, এমন নয়। স্থানীয় অভিজাতরাও ব্যবসা করার জন্য অনেক ক্যারাভানসরাই খুলে বসেছিল। পর্তুগিজ পাদ্রি সেবাস্তিয়ান মানরিক লিখে গিয়েছেন, 'মাঝেমধ্যে আশপাশের গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে টাকা তুলে এগুলো তৈরি করা হতো, আবার সম্পদশালী অভিজাতরাও অনেকে তৈরি করত নিজেদের নাম বাঁচিয়ে রাখার জন্য, আবার অনেকে দান করত পরকালে মুক্তি পাওয়ার জন্য সওয়াবের আশায়।'
প্রথম দিকে ক্যারাভানসরাইয়ে আসা অতিথিদের অবশ্য নিজেদের খাবার বাজার থেকে কিনে আনতে হতো। তারপর ক্যারাভানসরাইয়ের কর্মচারীরা সেই খাবারই রান্না করে অতিথিদের পরিবেশন করত, একই কথা প্রযোজ্য ছিল ঘোড়াদের জন্য। ঘোড়া রাখার জন্য আলাদা বিশাল জায়গা ফাঁকা রাখা হতো সরাইখানার পাশেই। ঘোড়াদের খাবারও কিনে আনতে হতো অতিথিদের, তারপর অভুক্ত ঘোড়াদের পেটেও দানাপানি পড়ত।
দীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্যারাভানসরাই আসলেই ছিল ঘোড়া ব্যবসায়ীদের দম ফেলার জায়গা। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম শেষে দু-এক রাত কাটিয়েই আবার নেমে পড়তে হতো রাস্তায়। বাবা আকবরের ছায়া হলেও সম্রাট জাহাঙ্গীর ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল বিনা শুল্কে নৌ বাণিজ্য করার অনুমতি। তা ছাড়া নিজের কর্মচারীদের ব্যবসায়ীদের তল্পিতল্পা পরীক্ষা করে তাদের অপমান না করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরাইখানাকে কেন্দ্র করে কূপ-মসজিদ নির্মাণ এবং আশপাশে বাজার-লোকালয় তৈরি করার ব্যবস্থা করে ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার আদেশও ছিল তার। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মতো প্রাচীন রাস্তাগুলোর আশপাশে এখনো চোখে পড়বে এসব ক্যারাভানসরাইয়ের ধ্বংসাবশেষ, যেগুলো প্রমাণ দেয় মোগল আমলের বাণিজ্য আর যাতায়াতের জন্য এগুলোর প্রয়োজনীয়তা।
বেশ বড় জায়গাজুড়ে মাঝখানে ফাঁকা রেখে চারকোনা এই সরাইখানাগুলো তৈরি করা হতো, ঢোকার জন্য সামনে আর পেছনে দুটো পথ খোলা থাকত, যা দিয়ে ৩ থেকে ৪ জন সহিস পাশাপাশি এসব ক্যারাভানসরাইয়ে ঢুকতে পারত। অনেকটা দুর্গের মতো আকৃতি হওয়ায় এগুলোতে থাকতে বেশ নিরাপদ বোধ করত অতিথিরা। ২ থেকে ৩ তলার এই সরাইখানায় থাকত কর্মচারীদের জন্য আলাদা ঘর। সবচেয়ে ওপরতলা এবং ছাদে থাকত ওয়াচ পোস্ট, দূর থেকে কোনো ক্যারাভান আসছে কি না কিংবা কোনো চোর-ডাকাত আশপাশে আছে কি না, তার দিকে নজর রাখা হতো।
মূল সরাইখানাকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হতো। বড় অভিজাত ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা বড় আরামদায়ক ঘর বরাদ্দ রাখা হতো, অন্যদিকে সাধারণ পথচারী বা ভ্রমণকারীদের জন্য ছিল রাত কাটানোর জন্য ছোট ছোট ঘর। তবে অনেক সময়, বিশেষ করে অতিথি মৌসুমে এক ঘরে কয়েকজনকে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে তখন অনেক অতিথি বালিশ-কাঁথা নিয়ে ছাদে বিছিয়ে আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়ত।
ক্যারাভানসরাইগুলো ব্যবসায়ের মৌসুমে সারাক্ষণ গমগম করত। মাঝখানের বিশাল ফাঁকা জায়গায় প্রতিদিন স্থানীয় বিক্রেতারা হাজির হতো খাবারদাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিয়ে, ব্যবসায়ীরাও পছন্দমতো জিনিস কিনে নিয়ে তাদের ঝোলা ভরত। ঘোড়ার নাল আর ঘোড়ার খাবার বিক্রির জন্য স্থানীয় বিক্রেতারা সারি ধরে বসে থাকত। এ ছাড়াও কাপড় বিক্রেতা থেকে শুরু করে নাপিত, দর্জি, ধোপারাও ভিড় করত এ সময়। সরাইখানার এক কোনায় ছিল গোসল-ওজু করার জায়গা এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা, ১-২টি কূপ আলাদা করে রাখা হতো কেবল অতিথিদের ব্যবহারের জন্যই।
মোগল অশ্বারোহী বাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের জন্য বরাদ্দ ছিল মধ্য এশিয়া বা তুর্কিস্তানের ঘোড়া। আরবীয় বা পারস্যের ঘোড়ার মতো সুন্দর না হলেও পুরো এশিয়ার প্রান্তর দাবড়ে আসা এই কঠোর পরিশ্রমী ঘোড়াগুলোই ছিল মোগল বাহিনীর প্রাণ, অবশ্য এগুলোর সাথে ভারতে বেড়ে ওঠা তাজি ঘোড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল। দামে কিছুটা কম তো কারণ হিসেবে ছিলই, এর সাথে ছিল পূর্বপুরুষ বাবরের দেশ থেকে আসা ঘোড়ার প্রতি টান। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে মোগল অভিজাতরা ঘোড়া ব্যবসায়ীদের সহযোগীদের নিজেদের ঘোড়া দেখাশোনা করার পাশাপাশি নিজেদের সৈন্যদলেও নিয়োগ দিত। এবং ঘোড়া নিয়ে এরাও হয়ে উঠত একেকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।

মোগলদের পর
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মোগল সাম্রাজ্য নামেমাত্র টিকে ছিল, তত দিনে ভারতবর্ষের অধিকাংশ চলে গিয়েছে ইংরেজদের পেটে, কেবল শিখ আর মারাঠারা টিকে রয়েছে হুমকি হিসেবে। রাজস্থানের রাজপুতরা, যারা আগে মোগলদের অভিজাত এবং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিল, তারাও একে একে কোম্পানির অধীনে কাজ করা শুরু করল। রাজস্থানের দায়িত্বে থাকা কোম্পানির রাজনৈতিক প্রতিনিধি জেমস টড ভারতবর্ষের ঘোড়া বাণিজ্য কমে আসা সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন।
তার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রাজপুতরা প্রতিবছর পশ্চিম রাজস্থানে গুজরাট আর পাঞ্জাবের মুলতান থেকে আনা ঘোড়া নিয়ে মেলার আয়োজন করত। কিন্তু গত ২০-৩০ বছর ধরে বাইরে থেকে ঘোড়া আসা একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। যেসব ঘোড়া বিক্রি হয় তার সবই স্থানীয়। এর কারণ অনেকগুলো হতে পারে। প্রথমত, উত্তর-পশ্চিমের শিখরা ঘোড়া বাণিজ্যের পথ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘোড়াশূূন্য করে ফেলার কৌশল গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, মধ্য এশিয়ার ঘোড়া ব্যবসায়ীদের কাছে একসময় মোগল ভারত তাদের ব্যবসায়ের প্রধান কেন্দ্র হলেও চীনা সাম্রাজ্য এবং রুশ সাম্রাজ্যের উত্থানের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণ ঘোড়া সেদিকে চলে যাচ্ছিল। ফলে ভারতে পাঠানোর মতো আর কোনো ঘোড়া অবশিষ্ট ছিল না। তৃতীয়ত, আফগানিস্তানে দুররানি সাম্রাজ্যের উত্থানের ফলে, বিশেষ করে আহমদ শাহ আবদালি প্রায়ই উত্তর-ভারতে আক্রমণ চালাচ্ছিল। ফলে তিনিও তার সাম্রাজ্যের ভেতর দিয়ে ভারতে যেন ঘোড়া রপ্তানি না হয়, তার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
যা-ই হোক, বাইরে থেকে ঘোড়া আমদানি না হলেও ভারতে ঘোড়ার ব্যাপক চাহিদা মিটছিল স্থানীয় ঘোড়ার মাধ্যমেই। রাজপুত আর মারাঠাদের মতো যোদ্ধা জাতিরা তাদের নিজেদের ঘোড়ার চাহিদা মেটাত নিজস্ব ঘোরার মাধ্যমেই। মারাঠারা তাদের ঘোড়া সংগ্রহ করত ডেকান অঞ্চল (বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ) থেকে। অন্যদিকে রাজপুতদের আগ্রহের কেন্দ্র ছিল ডেকানের ভীম উপত্যকা, রাজস্থানের মারোয়াড় আর গুজরাটের কাঠিয়াওয়াড়ের ঘোড়া, তবে তাদের মধ্যে তুর্কি ঘোড়া নিয়ে আলাদা কোনো মুগ্ধতা ছিল না, যেমনটা ছিল মোগলদের। তা ছাড়া তুর্কি ঘোড়ার চেয়ে এসব স্থানীয় ঘোড়া ছিল সস্তা। তবে ট্রফি হিসেবে আফগান ঘোড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঘোড়া কিনত রাজপুতেরা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ীদের প্রধান রুট পাঞ্জাবের দখল নিয়ে মারাঠা, শিখ আর আফগানদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। শিখদের মহারাজা রঞ্জিত সিং ১৭৯৯ সালে পাঞ্জাবে শিখ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করার পর আফগানদের সাথে এই ঘোড়া নিয়েই দর-কষাকষি করার চেষ্টা করেন। তবে আফগানরা এর জবাবে পেশোয়ার দখল করে নিলে কোম্পানি প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের সূচনা করে।
ধীরে ধীরে ইংরেজরা শিখ আর মারাঠাদের হটিয়ে পুরো ভারতবর্ষ দখল করে নিলে ঘোড়া ব্যবসাতেও এর প্রভাব পড়ে। মধ্য এশিয়ার ঘোড়ার প্রতি ইংরেজদের তেমন টান ছিল না, ঘোড়া হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ ছিল আরব আর পারস্যের ঘোড়া। তা ছাড়া ভারতে বেড়ে ওঠা ঘোড়া নিয়েও ইংরেজদের বিরক্তি ছিল। ফলে রাজপুত আর মারাঠাদের কল্যাণে যেমন হঠাৎ করে ঘোড়া ব্রিড করা বেড়ে গিয়েছিল, ইংরেজদের এক ঝটকায় তা একেবারে থেমে যায়।
মোগল আমলে ক্যারাভান নিয়ে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ীদের কাছে ভারত ছিল স্বর্গ। তবে ইংরেজদের সাথে আফগানদের বারবার যুদ্ধে আফগান সীমান্ত ক্রমেই অশান্ত হয়ে ওঠে। আফগানিস্তান সীমান্তে থাকা আদিবাসীদের সাথে লাগাতার যুদ্ধ চলতে থাকে। ফলে ব্যবসায়ীরাও এই যুদ্ধপ্রবণ অঞ্চল এড়িয়ে যেতে শুরু করে। চাকা লাগানো ক্যারাভান হয়ে ওঠে অমাবস্যার চাঁদ।
হিন্দি একটি বিখ্যাত প্রবাদ হলো: 'ঘোড়া বেঁচ কে সোয়া,' যেটি বেশির ভাগ সময়েই লোকজন ব্যবহার করে এর প্রেক্ষাপট না জেনে। অনেকের কাছেই এর অর্থ হয়তো ঘোড়া বিক্রি করলে খুব ভালো ঘুম হয়। তবে মোগলদের কাছে ঘোড়া বিক্রি করার পর ঘোড়া ব্যবসায়ীরা গরম পকেট আর ঘোড়ার বহর থেকে মুক্তির আনন্দ নিয়ে যে বেশ একটা শান্তির ঘুম ঘুমাত, তা আর বলে দিতে হয় না।