Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

ক্র্যাক প্লাটুন: গেরিলা দলের প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক নাম

হাবিবুল আলমের সাক্ষাৎকার। ১৯৭১। ১৪ আগস্ট। পাকিস্তান দিবস। এদিন ঢাকায় সবাই চমকে উঠল, বাংলাদেশের পতাকা, সবুজ পটভূমিতে লাল বৃত্ত এবং তার মাঝে আঁকা রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, নিয়ে গ্যাসবেলুন উড়ছে ঢাকার আকাশে। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নগরীতে এমনটি কেউই আশা করেনি।
ক্র্যাক প্লাটুন: গেরিলা দলের প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক নাম

ইজেল

সৈয়দ মূসা রেজা
16 December, 2024, 10:20 pm
Last modified: 17 December, 2024, 04:45 pm

Related News

  • মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনছে সরকার
  • ১৬ বছর ভারত ছাড়া হাসিনাকে দুনিয়ার আর কোনো দেশ সমর্থন করেনি: রিজভী 
  • বিজয় দিবসে ভারতীয় সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মোদির পোস্ট
  • ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১: বাসায় লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটি আকাশে উড়ল
  • জাতি নতুন করে বিজয় দিবস উদযাপন করছে আজ

ক্র্যাক প্লাটুন: গেরিলা দলের প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক নাম

হাবিবুল আলমের সাক্ষাৎকার। ১৯৭১। ১৪ আগস্ট। পাকিস্তান দিবস। এদিন ঢাকায় সবাই চমকে উঠল, বাংলাদেশের পতাকা, সবুজ পটভূমিতে লাল বৃত্ত এবং তার মাঝে আঁকা রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, নিয়ে গ্যাসবেলুন উড়ছে ঢাকার আকাশে। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নগরীতে এমনটি কেউই আশা করেনি।
সৈয়দ মূসা রেজা
16 December, 2024, 10:20 pm
Last modified: 17 December, 2024, 04:45 pm

ক্র্যাক প্লাটুন পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছে। অন্যদিকে রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার যে নকশা ইন্ডিয়ান আর্মি করেছিল, তা-ও করেছে বানচাল!

১৯৭১। ১৪ আগস্ট। পাকিস্তান দিবস। এদিন ঢাকায় সবাই চমকে উঠল, বাংলাদেশের পতাকা, সবুজ পটভূমিতে লাল বৃত্ত এবং তার মাঝে আঁকা রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, নিয়ে গ্যাসবেলুন উড়ছে ঢাকার আকাশে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নগরীতে এমনটি কেউই আশা করেনি। সেদিন সকাল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কাটাতে হয়েছে অন্য ধরনের ব্যস্ততায়। লক্ষ্যভেদী গুলি করে আকাশে ভেসে ওঠা বেলুনকে ফুটো করার গুরুদায়িত্ব।

প্রশিক্ষণ চলছে।

এদিকে বাংলাদেশের অসম সাহসী গেরিলারা তখন পুরো মাত্রায় তৎপর ঢাকায়। এর আগে দুঃসাহসী কয়েকটা অভিযানও চালিয়েছে তারা। পিলে চমকে দিয়েছে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বাধীন সেনাদলকে। সেসব অভিযানের সাথে তুলনা করলে পতাকা ভেসে ওঠায় কোনো রক্তপাতের ঘটনা বা ভয়াবহ বিস্ফোরণ বা ঘটেনি। কিন্তু এ ঘটনায় ঢাকায় মোতায়েন পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাসদস্যদের আসলে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা যে তোমরা আমাদের নজরদারিতে আছ। চাইলেই করতে পারি হামলা। 

তবে চমকে দেওয়ার মতো গেরিলা তৎপরতার শুরু আরও আগে। আর এ তৎপরতার মূলে ছিল একটি বাহিনী। মানুষের মুখে মুখে ঢাকায় তৎপর এ বাহিনীর কথা তত দিনে ছড়িয়ে পড়েছে, নাম হয়ে গেছে ক্র্যাক প্লাটুন। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক, শাহাদত চৌধুরী (পরবর্তী সময়ে বিচিত্রার সম্পাদক), রুমিসহ আরও অনেকেই ছিলেন এ বাহিনীতে।

হাবিবুল আলম

ঢাকায় প্রথম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো যে অপারেশন চালানো হয়, তার নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুল আলাম। মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা আরও অনেকের মতো তাকেও লড়াইয়ে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছে। টিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অভিযান শেষে ত্রিপুরার ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন হায়দার বলেছিলেন, দিস বয়েজ আর রিয়েলি ক্র্যাক। তবে প্রথমেই তাদের পরানো হয়নি ক্র্যাক প্লাটুন নামের মুকুট। অক্টোবর নভেম্বরের দিকে তারা এ নামে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে মানুষের কাছে। মানুষ ভালোবেসেই এ নাম দেয় তাদের গেরিলা দলকে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো দলিলপত্রে এ নামটি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধে নিজ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলা এবং ইংরেজিতে তার লেখা 'ব্রেভ অব হার্ট' বইয়ের কথা উঠলে তিনি জানান, বইটি লিখতে ছয় বছর লেগেছে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। বই লেখার সময় পুরোনো কথা স্মরণে আসায় কখনো কখনো কেঁদেছেন, তারপর ধাতস্থ হয়ে আবার লিখতে বসেছেন। সাধারণত দিনের কাজকর্ম সেরে রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত লিখতেন। বই প্রকাশিত হয়েছে মিজানুর রহমান শেলীর জোরাজুরিতে। বই প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তান, ভারতসহ নানা দূতাবাসকে দিয়েছেন। পাকিস্তান ও ভারত বাদে আর সব দূতাবাস সৌজন্য জবাব দিয়েছে। বই প্রকাশের পর হাবিবুল আলমের জন্য ভারতের ভিসা পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। সরাসরি কারণ না বললেও বইটিই যে তার কারণ, বুঝতে অসুবিধা হয়নি।  

হাবিবুল আলমের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া, সীমান্ত অতিক্রমের যাত্রা, প্রশিক্ষণ, ফিরে আসার গল্প:  

এপ্রিল মাসের একদিন ফজরের নামাজের আগেই বিছানা ছাড়ল আলম। আগেই শলাপরামর্শ করা ছিল আরও চার সাথির সাথে। স্বাধীনতার লড়াইয়ে যোগ দিতে যাবে তারা। সেদিন বিছানায় কোলবালিশকে এমনভাবে পেতে রাখে যেন বাড়ির লোকেরা দেখলে মনে করবে চার বোনের একমাত্র ভাই আলম ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। আসলে আলম তখন চুপিসারে বিড়াল-পায়ে দিলু রোডের ঘর ছেড়েছে। পিআইয়ের একটি ব্যাগে সামান্য কিছু জামাকাপড়ই তার সম্বল। ঘর ছাড়ার আগে একটা চিরকুটে লিখে রেখে যান যাত্রার উদ্দেশ্য।

ঢাকা থেকে অতিযাত্রীবোঝাই বাস তাদের বাহন হয়। নিজেদের মধ্যে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক যাত্রাপথে কোনো আলাপ-সালাপ করেনি এই পাঁচ তরুণ। পাঁচজনই বাসের ছাদে গাদাগাদি হয়ে বসেছিল। ইলিয়টগঞ্জের কাছে গিয়ে ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টিতে ভেজে। চান্দিনার পরের স্টেশন নিমসরে নেমে যায়। সেখান থেকে শ্যামপুর বাজার পর্যন্ত হেঁটে পাড়ি দেয়। ডানে ময়নামতি সেনানিবাস এবং কুমিল্লা শহর রেখে দুই রিকশা নিয়ে পূর্ব দিকে এগোতে থাকে। রেললাইন পার হয়ে এবারে তাদের পথ চলতে হয় হেঁটে। কুমিল্লার কাছাকাছি সীমান্ত দিয়ে ঢোকে ভারতে। মতিনগরের গ্রাম্য বাজারে ক্ষুধার্ত পাঁচজন হাতে তৈরি রুটি, মিষ্টি এবং ডিম দিতে বলে।

খাওয়ার সময় সেখানে উইলি জিপ নিয়ে সামরিক পোশাক পরা এক তরুণ হাজির হন। খাওয়ার জন্যেই ওই দোকানে ঢোকে সে-ও। সামরিক পোশাকে কোনো পদবির পরিচয় নেই। কোমরে ঝুলছে চায়নিজ পিস্তল। ওদের দলের জিয়া নামের এক তরুণ আগে থেকে তাকে চিনত। তিনি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড লে. ফজলুল কবির। নিজেদের উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরে লে. কবিরের সহায়তা চাইল এই পাঁচ তরুণ। তাদেকে মতিনগর ক্যাম্পে কী নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা জানতে চাওয়া হলো? লে. কবির এ প্রস্তাবে খুশিই হলেন। এভাবেই সন্ধ্যার মধ্যেই ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে পৌঁছে গেল পাঁচজন। সেখানে পরিচয় হলো দাঁড়িওয়ালা ছোটখাটো মানুষ ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাথে। ২ নম্বর সেক্টরের দ্বিতীয় প্লাটুনে যোগ দিতে বলা হলো তাদেরÑ এর মধ্যে ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থান থেকেও অনেক তরুণ পৌঁছে গেছে, তাদের নিয়ে প্রথম প্লাটুন গঠন করা হয়েছে। পটাঁচ তরুণের জায়গা হলো দ্বিতীয় প্লাটুনে। এ প্লাটুনের নির্ধারিত তাঁবুতে ঢুকে তারা আরও কয়েকজন তরুণের দেখা পেলেন। এর মধ্যে জানা গেল, পরের দিন বেলা ২ থেকে ৩টার দিকে ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার মেজর খালেদ মোশাররফ আসবেন।

মতিনগর মানে মুক্তার শহর। টিলাময় অঞ্চলটি প্রাকৃতিকভাবেই যেন সৃষ্টিকর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বানিয়েছেন।

পরদিন ঘুম ভাঙে সেনাজওয়ানদের হাকডাকে। প্রাতঃকালীন শরীরচর্চার পর তাদের নাশতা দেওয়া হয়। চাপাতি ও নানের মাঝামাঝি একধরনের রুটি। সাথে কয়েক রকমের সবজি। স্বাভাবিক অবস্থায় এ সবজি কেউ হয়তো মুখেই তুলত না। এ ছাড়া মগভর্তি দুধছাড়া মজাদার গরম গরম চা-ও ছিল সাথে। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে হাবিবুল আলমের দল সাথে সানকি নিয়ে এসেছিল।

খালেদ মোশাররফ আসার আগেভাগে ছাত্র প্লাটুনের সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। একটা গাড়ি এসে থামল: গাড়ির দরজা খুলে দিল একজন সিপাই। নামলেন ফর্সা, দীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন ব্যক্তি।  ক্যাপটেন মাহবুব তাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে সব তরুণ হাততালিতে ফেটে পড়ে। খালেদ মোশাররফ তাদের হাততালি দিতে নিষেধ করে বাংলা এবং ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে শুরু করলেন। কেন তরুণদের দরকার, কীভাবে লড়াই চালিয়ে নেবেন। পাকিস্তান সরকারের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিকÑতিন ক্ষেত্রে লড়াই করবেন, জানালেন। একযোগে এ যুদ্ধ চলবে। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা থেকে আগত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ২ নম্বর সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর জন্য সবাইকে সাহস এবং দৃঢ় মনোবল থাকতে হবে। তবে এ-ও জানান, দেশের অর্থনীতি যেন পঙ্গু হয়ে না যায়। গভীর ভাবনাচিন্তা করে পদক্ষেপ নিলেই কেবল এটি সম্ভব। কোন কোন স্থানে ধংসাত্মক তৎপরতা চালালে রক্তপিপাসু শাসনের অবসান ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানগুলো যেন পুনর্গঠনের অবস্থা থাকে। তিনি আরও জানান, দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে এবং বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছে। এ ছাড়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু কর্মকর্তা ও সেনা, ফ্রন্টইয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের বাঙালি কর্মকর্তা, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এবং ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীও এর মধ্যে যোগ দিয়েছে এবং একযোগে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হাবিবুল আলমের মতো প্রথমবার মেজর খালেদের বক্তব্য শুনে তাদের মনে প্রশ্নের ঝড় ওঠে অনেকেরই। প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায়: এখন কী হবে? যুদ্ধ চলবে কত দিন? আমরা বাঁচতে পারব? আর কখনো কি মা-বাবা বা প্রিয়জনদের দেখতে পাব?

৫৫৫ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মাও সে-তুংয়ের কথা তুলে ধরেন মেজর খালেদ, কোনো সরকারই জীবিত গেরিলাকে চায় না। কাজেই কী ঘটবে বা যুদ্ধ শেষে সরকারের আচরণ কী হবে, সে বিষয় খালেদের পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়। বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রয়োজনে মহৎ কারণের জন্য প্রাণ দিতে তৈরি থাকতে হবে। ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হবে এবং এ কারণেই ঢাকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। যুদ্ধে একবার জড়িয়ে পড়লে পিছু হটার পথ আর খোলা থাকবে না। সৈনিকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে না ফিরে যাবে, সে সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। তার শেষ কথা ছিল, পর্যাপ্ত রেশন হয়তো জুটবে না। কিন্তু কেউ না খেয়েও থাকবে না। প্রথম এবং দ্বিতীয় প্লাটুনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভার ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের ওপর ন্যস্ত হলো। শ্মশ্রুম-িত এ কর্মকর্তার বাঁ হাতে তখন স্লিং বাধা।

তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে নন-কমিশনড অফিসার বা এনসিওর একজনকে পাঠানো হলো। প্রথম শেখানো হলো .৩০৩ রাইফেল চালনা।

আলম খুঁজে বের করল ব্যাটালিয়ন হাবিলদার মেজর (বিএইচএম) কাসেমকে। প্রশিক্ষণে নিজে কেবল খুব ভালোই করেনি; বরং অস্ত্র সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছে আলম। সেনা পরিভাষায় কোথ নামে পরিচিত অস্ত্রাগারে ঢোকার অনুমতি আদায়ের জন্যেই বিএইচএমকে দরকার। কোথে অস্ত্র পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত সৈনিকদের সহায়তা করতেই সেখানে ঢুকতে চাই আলম। শেষ অবধি এ অনুমতি দেওয়া হলো শর্ত সাপেক্ষে। কোনো রকম শর্ত বা আইন ভঙ্গ হলে কঠোর শাস্তি হিসেবে আলমকে কোয়ার্টার গার্ডে পাঠানো হবে। অল্পকথায় জানিয়ে দেয় কোথের দায়িত্ব থাকা ব্যক্তি এম এম ইদ্রিস।

প্রতিদিন দুপুরের খাওয়ার পর কোথে যাওয়া শুরু করল আলম। সেখানে অস্ত্র পরিষ্কার করার পাশাপাশি অস্ত্র খুলে আবার জোড়া দেওয়ার কাজ আগেভাগেই শিখে নিল। এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যেই সব ধরনের খুদে এবং বহনযোগ্য অস্ত্র সম্পর্কে জানাশোনা হয়ে গেল তার। বিশেষ করে চায়নিজ সাব মেশিনগান বা এসএমজি, চায়নিজ ৭.৬২ রাইফেল, জি৩ রাইফেল, .৩০৩ এলএমজি, চায়নিজ এলএমজি মতো লাইট মেশিনগান বা এলএমজি, পুরোনো কালের, প্রথম মহাযুদ্ধের আমলের ভিকার্স এলএমজি তখনো ব্যবহার হতো, সে সম্পর্কে হাতেকলমে জানা হয়ে যায়। এ ছাড়া কোন অস্ত্রে কোন ধরনের গোলাগুলি ব্যবহার হয়, তা-ও জানা হয়ে গেল। পাশাপাশি ট্রেসার বুলেট সম্পর্কেও ধারণা হলো।

যুদ্ধের অস্ত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হাবিবুল আলম বলেন, সব পুরোনো অস্ত্র দিয়ে আমাদের যুদ্ধ করতে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বড় জ্বালিয়েছে ভারতীয় এসএলআর।

গুলি আটকে যেত? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তা তো বটেই, এমনকি পানিতে নল বাঁকা হয়ে যেত। 

ক্যাপ্টেন হায়দার থেকে শুরু করে সব প্রশিক্ষকই প্রশিক্ষণের নানা পর্বে বারবার বলেন, কোনোভাবেই একটাও বুলেট অপচয় করা যাবে না।

কুমিল্লায় মোতায়েন পাকিস্তানের তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এসএসজি কর্মকর্তা ছিলেন ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার। তিনি সিলেটের তেলিপাড়া থেকে মেজর খালেদের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। কাকুলে পাকিস্তানের সামরিক একাডেমিতে হায়দারের ইন্সট্রাক্টর ছিলেন মেজর খালেদ। যুদ্ধ চলাকালীন আলমদের সতীর্থরা তাকে হায়দার ভাই বলেই ডাকত। তার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী সবার সাথেই হায়দারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সেক্টর-২-এর সব গেরিলা তৎপতার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। পদাতিক বা গোলন্দাজ বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে হায়দারের আচরণের তফাৎ যে কারও চোখেই পড়ত। হায়দার তার মিষ্টি আচরণের মধ্য দিয়ে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে ওঠে। ফলে তার আওতায় প্রশিক্ষণরত গেরিলারা আলাপ করে আরাম পেত। তেলিপাড়া চা-বাগানে এক দুর্ঘটনায় তার বাঁ হাত ভেঙে গিয়েছিল।

বিস্ফোরক ব্যবহার নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই হায়দারের ওপরই বর্তায়। যুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির ব্যবহার কৌশল সহজভাবেই শেখাতেন তিনি। সব প্রশিক্ষণার্থী যেন ব্যবহার কৌশল রপ্ত করতে পারে, সে জন্য একে আকষর্ণীয় এবং সরলভাবেই উপস্থান করতে দ্বিধা করতেন না। বিস্ফোরক পাতা, ডিটোনেটর বসানো, প্রাইম কর্ড এবং চার্জ বসানো নিয়ে প্রশিক্ষণ ছিল হাতে-কলমে। স্বাভাবিক অবস্থায় যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ লাগে, সেখানে ক্যাম্পে এক বা বড়জোর দুই দিনে সে পর্ব শেষ করা হতো।

প্রশিক্ষণ পর্বটি কী খুব কঠিন মানে নিষ্ঠুর ছিল?

জবাবে হাবিবুল আলাম জানান, প্রশিক্ষণ 'নিষ্ঠুর' হওয়াই উচিত। বোর্ডে লিখে তত্ত্ব পড়ে বোঝানো বা জানানোর মতো সময় তখন আমাদের ছিল না। সবই মাঠপর্যায়ে হাতে-কলমে শেখানো হয়েছে। এ সময়ে গিবনের রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ারের কথা আসে। গিবন রোমকদের প্রসঙ্গে বলেছেন, 'দেয়ার ড্রিল ওয়াজ ব্লাডলেস ওয়ার। দেয়ার ওয়ার ওয়াজ আ ব্লাডি ড্রিল।'

এরই মধ্যে একবার আলমকে ঢাকা যেতে হয়। মেজর নুরুল ইসলামের (শিশু) স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আসার জন্য ঝুঁকি নিতে হয়। এই অভিযানে আলম তার সঙ্গীকে নিয়ে ওঠে দিলু রোডের নিজের বাসায়। 

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর ওই প্রথম পরিবারের সাথে আলমের দেখা। ছেলেকে দেখে ঘোমটায় আধা ঢাকা মায়ের চোখে আনন্দঅশ্রু নামে। মা চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারেনি। পরিবারের সাথে সঙ্গীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে তাকেও সাদরে গ্রহণ করা হয়।
 
ছোট দুই বোন রেশমা ও শাহনাজ অনেক প্রশ্ন করে। বড় বোন আসমা, কয়েক মাস আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএসসি পাস করেছে। ঢাকায় ফেরার কারণ জানতে চাইল আসমা। টনি ভাবিকে নিয়ে যেতে হবে এবং আজ রাতেই ফিরতে হবে। আলমের জবাব। বাবা ইঞ্জিনিয়ার হাফিজুল আলম কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু জানাল, তোমাদের দুজনের যাতায়াতের জন্য গাড়ি-টাড়ি হয়তো লাগবে। ওই যে ড্রাইভারসহ গাড়িটা রইল। নিজের লাল রঙের দুই দরজার ট্রাম্প হেরাল্ডকে দেখাল। 

আলমের এ অভিযান সফল হয়। নুরুল ইসলাম শিশুর স্ত্রীকে নিয়ে ক্যাম্পে ফেরার পর পূর্বপ্রতিশ্রুতি মোতাবেক চায়নিজ এসএমজি আলমকে দিয়ে দেন। শিশু তার চায়নিজ পিস্তলটি দেন তার সঙ্গীকে।

এভাবেই হাবিবুল আলমের হাতে চলে আসে চায়নিজ এসএমজি। হাতে যেন চাঁদ পেয়েছে এমনটিই মনে হয় ১১১ নম্বরযুক্ত এসএমজি পেয়ে। আগস্টের আগে চায়নিজ অস্ত্র বিশেষ করে এসএমজি ছাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া হয়নি। 

মেজর খালেদ মোশাররফের আদেশে আলমের নেতৃত্বে গেরিলাদের একটি দলকে শহরের বুকে অভিযান চালানোর জন্য ঢাকায় পাঠানো হলো। বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে তুলে ধরার চেষ্টা করছে ইসলামবাদ সরকার। তাদের এ তৎপরতা ভন্ডুল করে দেওয়াই হবে এই গেরিলা অভিযানের উদ্দেশ্য। অভিযান চালাতে হবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। অভিযানের দলপতির দায়িত্ব দেওয়া হলো আলমকে। আর দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড বেছে নেওয়ার এখতিয়ার বর্তাল তারই ওপর। শহিদকে এ জন্য বেছে নেওয়া হলো। অভিযান সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়ার সময় বারবার বলা হতো, পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে যাওয়া যাবে না। অপর্যাপ্ত অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের যুদ্ধে জড়ালে ফল ভালো হবে না। অভিযানের জন্য গেরিলা দলকে হ্যান্ড গ্রেনেড এবং বেয়নেট কেবল সরবরাহ করা হবে। দলটির কাজ হবে দূর থেকে হোটেলের সুনির্দিষ্ট এলাকায় গ্রেনেড ছুড়ে মারা।

বিশ্বব্যাংকের দল এবং ইউএনসিএইচআরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে ঢাকা নগরীর জীবনব্যবস্থা স্বাভাবিক নয়। নগরীকে পাকিস্তানি বাহিনী পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণও করতে পারছে না। প্রথম অভিযানে এ দলে ১৭ জন গেরিলা ছিল। অভিযানের নাম দেওয়া হলো অপারেশন হোটেল ইনটারকন্টিনেন্টাল হিট অ্যান্ড রান।  

দলের সবাইকে আনারসের মতো দেখতে, তবে আনারসের তুলনায় ছোট, ইন্ডিয়ান গ্রেনেড পাঁচ থেকে ছয়টা করে দেওয়া হলো। আর দেওয়া হলো দুই ধরনের বেয়নেট। অভিযান শেষে ফিরতে পারলে বেয়নেট জমা দিতে হবে। জুন মাসের ৩ তারিখে দলটি পৌঁছাল সওয়ারি ঘাটে। সেখান থেকে আগেই ঠিক করা নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেল সবাই। আলম দলের মোফাজ্জেল হোসেন মায়া এবং জিয়াকে জানাল সন্ধ্যায় যেন তার সাথে যোগাযোগ করে। মায়া জানাল, সেগুনবাগিচার মিউজিক কলেজে তাকে পাওয়া যাবে। অন্যদিকে জিয়া বলল যে সন্ধ্যায় সে নিজেই দেখা করবে।

মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণ এ গেরিলা দলে ছিল। সে জানাল যে তার চাচা বাদল চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ক্যামেরাম্যান এবং দক্ষ গাড়িচালক বাদল ভাই তাদের অভিযানে যোগ দিতে চায়। আলম এ প্রস্তাবে রাজি হলো। 

অভিযানের জন্য গাড়ি গুলশান থেকে ছিনতাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। প্রথম দিন ব্যর্থ হলো। তৃতীয় দিন একটি ডাটসন গাড়ি ছিনতাই করা হলো। ছিনতাই করার পর গাড়িটি চালাচ্ছিল বাদল ভাই। গাড়ি নিয়ে আসার পথে টের পাওয়া গেল যে ডাটসনের চালক তাদের চিনে ফেলেছে। উপায়? জিয়া জানাল যে তাকে খসিয়ে দিতে হবে। গুলশান ও তেজগাঁও শিল্প এলাকার মাঝামাঝি একটা কালভার্টের নিচে নিয়ে তাকে খসিয়ে দেওয়া হলো। 

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ডাটসান নিয়ে অভিযানে চলল গেরিলা দলটি। চালকের আসনে ছিল বাদল ভাই। স্বপন সামনের আসনে পিস্তল হাতে বসল। মায়া এবং আলম বসল পেছনের বাঁ ও ডান দরজার কাছে। আর মাঝে রইল জিয়া। 

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রাস্তার মাঝামাঝি আসতেই শুনতে পেল সাইরেনের শব্দ। পুলিশি এসকর্টে কয়েকটি গাড়ি ময়মনসিংহ সড়কের দিক থেকে আসছে। বহরের সবার সবার পেছনে রয়েছে সাদা শেভ্রোলে। গেরিলা দলটির বুঝতে বাকি রইল না, এ গাড়িতেই রয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেসব অতিথি। যাদের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য তাদের ঢাকা পাঠানো হয়েছে। বাদল ভাই তাদের গাড়িকে মিন্টো রোডের শেষ মাথা থেকে ইউটার্ন করিয়ে হোটেলের ছোট প্রবেশদ্বারের কাছে নিয়ে এল। ফুটপাতের সাথে লাগোয়া এ দ্বার দিয়ে পথচারীরা সরাসরি হোটেলে ঢুকতে পারে। দেয়ালের ওপর এবং ওই এলাকার আশপাশে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিল। গাড়িবহর দেখার সাথে সাথে তারা হাততালি দিতে শুরু করল। ডাটসান গাড়ির দিকে কেউই তাকানোর প্রয়োজনই অনুভব করল না। গাড়ি থেকে চারজন দ্রুত নেমে এসে প্রবেশদ্বারের পেছনের মানুষজনের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইল। জিয়া, মায়া এবং আলম তিন চার ফুট দূরে দূরে দাঁড়াল। স্বপন পকেটে ডান হাত পুরে খাড়া রইল। ওর পকেটেই ছিল পিস্তল। আলমদের কভার দেওয়াই ছিল ওর দায়িত্ব। কিন্তু ওরা তখনো জানতই না যে পিস্তলের মতো ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়ে কভার দেওয়া যায় না। 

আলম গ্রেনেডের পিন খুলতে খুলতেই জিয়া তার গ্রেনেড ছুড়ে দিয়েছে। শেভ্রোলে মাত্র এসে দাঁড়িয়েছে। দুজন গাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ছুড়ল আলম। শেভ্রোলের দরজার কাছে ওটা আছড়ে পড়ল। মায়ার ছোড়া তৃতীয় গ্রেনেডও প্রায় একই জায়গায় পড়ল। জিয়া দ্বিতীয় গ্রেনেড ছুড়ল ওই গাড়িকে তাক করে। এটা পাশের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। গ্রেনেডগুলো একের পর এক ফাটতে শুরু করল। ভারী শেভ্রোলে গাড়িটি ৩ থেকে ৪ ফুট ওপরে উঠে গিয়ে ঠাস করে পড়ল।   

হোটেলের কাছে যারা জড়ো হয়েছিল, প্রথমবার চাক্ষুষ করল যে সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধদের হামলার সাহসী দৃশ্য। দলটি আর দেরি করল না। আতঙ্কিত মানুষদের কা-কারখানা দেখার জন্য অপেক্ষা না করেই ডাটসনে চেপে বসল। বাদল ভাই গাড়িটি ছুটিয়ে নিয়ে চলল গন্তব্যে। ফেরার পথে সরকারি দৈনিক মর্নিং নিউজে গ্রেনেড হামলা চালাল। দুটো গ্রেনেড ছুড়ল। দুটিই দৈনিকটির  দপ্তরের উঁচু প্রাচীরের ওপর দিয়ে গিয়ে ভেতরে পড়ে। এ ছাড়া মগবাজার কাজি অফিসের কানাগলিতে অবস্থিত জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের বাড়িতে দুটো গ্রেনেড ছোড়া হয়। ও দুটোও বাড়ির প্রাচীরের ওপর দিয়ে ভেতরে গিয়ে পড়ে। 

অভিযান শেষ। মায়া এবং জিয়াকে নিয়ে পরদিন ঢাকা ছাড়ে আলম। আলমের বাবা ১০ জুন ওদের তিনজনকে নিজ গাড়িতে করে নারায়ণগঞ্জ গুদারা ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। নদী পার হয়ে  ওরা হাঁটতে শুরু করে। একটা মসজিদে রাতে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া রাস্তায় কোথাও এক মুহূর্তের জন্য থামেনি। তবে ঝাঁকে ঝাঁকে মশার কামড়ে বীর গেরিলাদের বিশ্রামের আশা বরবাদ হয়ে যায়। 

রাত ১১ বা ১২টা নাগাদ মতিনগর ফেরে ত্রিরত্ন। ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার এবং শহীদুল্লাহ খান বাদলের কাছে জানায় নিজেদের ফিরে আসর কথা। মেজর খালেদ মোশাররফকেও জানানো হলো তাদের কথা। এর আগেই বিবিসি এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর কল্যাণে ঢাকার সফল ঘটনা তাদের জানা হয়ে গেছে। 

এরপর, পরবর্তী অভিযানের জন্য চলতে থাকে প্রশিক্ষণ। 

১৯ জুলাই ঢাকার পাঁচটি উপবিদ্যুৎকেন্দ্রে একযোগে গেরিলা হামলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য যা বড় রকম মাথাব্যথা হয়ে দেখা দেয়। এর আগে গেরিলা দলকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে মেলানগরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। এবারে ঢাকায় ঢোকার জন্য মুরাদনগরের পথ ব্যবহার করে। ঢাকায় হোম ইকোনমিকস কলেজের কাছে একটি পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। গ্রেনেড ঠিকভাবে না বসানোর কারণে পেট্রলপাম্পের মাটির তলের তেলের ট্যাংকে আগুন না ধরে বরং পাশের হোম ইকোনমিকস কলেজের দক্ষিণের দেয়ালের সবটাই ধসে পড়ে। 

এরপরই পাঁচ উপবিদ্যুৎকেন্দ্রে একযোগে গেরিলা হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে দুই কেন্দ্র অচল করে দেওয়া যায়, তিনটাতে হামলা ঠিক সফল হয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকারদের সতর্কতার কারণে সফল হওয়া যায়নি। উলান বিদ্যুৎকেন্দ্র সফলভাবে উড়িয়ে দেওয়া গেরিলা দলের নেতৃত্ব দেয় গাজী গোলাম দস্তগীর। গুলবাগে দ্বিতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়ার দলের নেতৃত্বে ছিল আবু সাঈদ খান। এই অভিযানের সময়ই চায়নিজ এসএমজি ব্যবহার করা হয়। ঢাকায় গেরিলাদের বিদেশি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক খবরে গুরুত্ব পায়। 

মোহাম্মদপুর এলাকায় বাঙালিদের বিহারি নামে পরিচিত অবাঙালিরা মারধর করত। তাদের শিক্ষা দেওয়ার ঘটনা বলেন হাবিবুল আলম। এ ঘটনার বর্ণনা ব্রেভ টু হার্টে বইয়েও দেওয়া আছে। ইকবাল বা আরঙ্গজেব রোডে জর্দার কৌটা পেতে রাখা হয়। এটি একধরনের প্লাস্টিক মাইন। বিস্ফোরণে পা উড়ে যেতে পারে। কিংবা উড়ে যেতে পারে গাড়ির চাকা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়ির চাকা এভাবে উড়ে যাওয়ার পর রাস্তার দুই পাশের সব বাসা থেকে অবাঙালিদের রাস্তায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে রাখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাদের মারধরও করে। অবশ্য সকাল পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখে তারপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। 

প্লাস্টিক মাইনের চেহারার সাথে জর্দার কৌটার মিল থাকায় এগুলো ওই নামে পরিচিতি পায়। সাক্ষাৎকারের এ পর্যায়ে জানতে চাওয়া হয় যে জুতার কালির কৌটার মতো দেখতে? না না। বলেন বীর প্রতীক হাবিবুল আলম। তিনি জানান, জুতার কালির কৌটা বেশি চিকন। প্লাস্টিক মাইনের কৌটা অত চিকন নয়। জর্দার কৌটার মতোই মোটা।  

এবারে আরেক ধাপ এগিয়ে ফার্মগেটের মোড়ে সেনা চেকপোস্টের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি দারুল কাবাবে হামলার সিদ্ধান্তও হয়। দারুল কাবাবে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা কাবাবের স্বাদ নিতে আসতেন। ফার্মগেটের কাছাকাছি হওয়ায় আলমের নেতৃত্বাধীন গেরিলা দলটি নিজেরাই একই দিনে দুই জায়গায় হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ আগস্টে দুপুরের পর নিশ্চিত হওয়া যায় যে গত রাতে এ অভিযান চলেছে ৯২ সেকেন্ড। ৯২ সেকেন্ডের অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছে ৯৬ রাউন্ড গুলি। অভিযানে চেকপোস্টের ১২ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। 

ফার্মগেটে অপারেশন শেষে গ্রেনেড ফাটিয়ে সরে পড়বে গেরিলারা। দারুল কাবারের কাছে ওত পেতে থাকা গ্রেনেডের আওয়াজ পাওয়ার সাথে সাথে দ্বিতীয় গেরিলা দলটি তখনই তাদের অভিযানে নামবে। আগেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু ইন্ডিয়ান গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ফাটেনি। সংকেত না পেয়ে দারুল কাবাবে হামলার দায়িত্বে মোতায়েন দলটি পরে ওখান থেকে সরে যায়। 

এ অভিযানের পরিকল্পনা চট করে নেওয়া নয়। খুঁটিনাটি অনেক কিছু খতিয়ে দেখা হয়েছে বারবার। মাসখানেক ধরে রেকি করতে হয়েছে গেরিলাদের। অভিযানে নামার দিনেও ঝামেলা হয়েছে। সেদিন চায়নিজ এসএমজি পরিষ্কার করতে গিয়ে পুল থ্রু ভেতরে আটকে যায়। কোনোভাবেই ছোটানো যাচ্ছিল না। এদিকে অভিযানে নামার সময় এগিয়ে আসছে। টানাটানি করে কোনো কাজেই হচ্ছে না। জন্মের মতো মনে হয় আটকে গেছে ওটি। শেষ পর্যন্ত কেরাসিন তেল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। পুল থ্রুর কাপড় এতে পুড়ে যায়। ধাতব দ-টি বের করে আসতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। ঘাম দিয়ে জ্বর সারল আলমসহ সবার। 

ফার্মগেটের অভিযান চালানোর আগে ভালো করে জেনে নেওয়া হলো ওই এলাকার কোন দোকান কখন বন্ধ হয়, কে কখন আসে-যায়, এসবই খতিয়ে দেখা হলো, অন্তত মাসখানেক রেকি চলে। 
হলিক্রস স্কুলের তেতলা ভবনের প্রান্ত থেকে একজন নান এই অভিযান প্রায় পুরোটাই প্রত্যক্ষ করেন।  অভিযানের পর তার ভাই জানান এ কথা। এই নান এতই উত্তেজনা অনুভব করেন যে সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। রাতে নিজেদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ফার্মগেটের চেকপোস্ট থেকে  নিহত সতীর্থ সেনাদের সরিয়ে নিতে আসেনি পাকিস্তানি বাহিনী। দিনের আলো ফুটলে এগিয়ে আসে তারা। তখন ১২টি লাশ সরিয়ে নিয়েছে, তা দেখতে পান ওই নান। তিনি বুকে ১২ বার ক্রস চিহ্ন এঁকে নিহতের সংখ্যাটা জানিয়ে দেন।    

এদিকে একই মাসের ১১ তারিখে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বার সাকিতে বোমা ফাটায় গেরিলারা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় নাকের নিচেই এটি ফাটানো হয়। সুপরিকল্পিত এ অভিযান বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ পরিকল্পনা করতে হয়েছে। আলমসহ চারজন গেরিলা হোটেলটিতে একাধিকবার যাতায়াত করে। সাকি বারের ভেতরের টয়লেটও ব্যবহার করে। বিস্ফোরক কোথায় বসানো যায়, সাকির কমোডে বসেই আলমের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়, কেন এই কমোডেই তো বোমা পেতে রাখা যায়। সেই পরিকল্পনা ধরেই এগোয় সব তৎপরতা।    

সুইস এয়ারের কর্মকর্তা জানতে বা অজান্তে বেশ সহায়তা করেছে গেরিলা দলকে। তার দপ্তরে ব্রিফকেস নিয়ে বারবার আসা-যাওয়া করে হোটেল এলাকায় যাতায়াতের বিষয় স্বাভাবিক করে তোলা হয়। পরে এক মুক্তিযোদ্ধা ২৫ পাউন্ড পিইকে বিস্ফোরক বোঝাই ব্রিফকেস পেতে রাখে সাকির টয়লেটের এক কমোডে। টয়লেট থেকে বের হয়ে আসার পর মনে পড়ে যে টাইমার চালু করতে ভুলে গেছে। দ্রুত আবার ফিরে যায়। কিছু ফেলে এসেছে এমন ভাবসাব করে। খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজির ভান করে। তারপর চট করে টয়লেটে ঢুকে ওই টাইমার চালু করে বের হয়ে আসে দ্রুত। 

বিস্ফোরণ ঘটে হোটেলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যেই। যার শব্দ কাওরান বাজার থেকে শোনা গেছে। শোনা গেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকেও। 

এর মাত্র তিন দিন পরই ঢাকার আকাশে বাংলাদেশের পতাকা ভাসতে দেখা যায়। এভাবে পতাকা ওড়ানোর পরিকল্পনা প্রথম মাথায় আসে শাহাদত চৌধুরীর। পতাকার কাপড় ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে কেনা হয়েছে। কেউ যেন কিছু সন্দেহ করতে না পারে, সে জন্যই এই সতর্কতা।  

রাতদিন খেটে কয়েকজন তরুণী তিন শ পতাকা তৈরি করে। নগরীর কোন কোন স্থান থেকে পতাকা ওড়ানো হবে, তা আগেই আলম এবং আরেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলোচনার মাধ্যমে শাহাদত চৌধুরী ঠিক করে দিয়েছিল। সে অনুযায়ী ১৪ আগস্ট সকাল ৯ থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ঢাকার আকাশে পতাকা উড়তে শুরু করে। 

ক্র্যাক প্লাটুনের ১৭ ডিসেম্বরের তৎপরতা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নারিন্দা এলাকায় কিছু পাকিস্তানি স্লাইপার লুকিয়ে রয়েছে। তাদের নিকেশ করার তৎপরতায় ব্যস্ত ছিল আলমসহ অন্যরা। সে সময় জরুরি বার্তা নিয়ে আসে দুই মুক্তিযোদ্ধা। আলম তাদের কাছ থেকে জানতে পারে,  মিত্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত ভারতীয় বাহিনী সেদিন বাংলাদেশ রেডিও ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেবে। সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকায় মোতায়েন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে পদস্থ ব্যক্তি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা ঢাকা রেডিও থেকে দেবে। এ খবরে আলমের মেজাজ তেতে উঠল। বিদেশি সেনা নিজ দেশের মাটি থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা দেবেÑএর চেয়ে অবমাননাকর এবং লজ্জার আর কী হতে পারে! নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকার বা সেক্টর ২-এর পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়ার মতো কেউ কি নেই? ভারতীয়দের এ নকশা কার্যকর হতে দেওয়া যাবে না। 

এটা হতে পারে না। আলম ভাবল। বন্ধ একটা চায়ের দোকানের সামনে বসে চিন্তাভাবনা শুরু হলো। যেভাবেই হোক এটা ঠেকাতে হবে। ঢাকায় তখন সেক্টর ২-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান (যুদ্ধ চলাকালে আইন মেনে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি হয়েছে) মেজর এ টি এম হায়দার ছাড়া আর কেউ নেই। লে. কর্নেল সফিউল্লাহ নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকার কোথাও হয়তো আছেন। তার সাথে যোগাযোগ নেই। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমপর্ণ অনুষ্ঠানের পর যৌথ কমান্ডের সাথে কলকাতা চলে গেছেন। সব মিলিয়ে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে হয় হায়দার ভাইকে খুঁজে বের করতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণা তাকে দেওয়ার জন্য রাজি করাতে হবে। আর না হয় ঢাকা বেতারকেন্দ্র এমনভাবে ভাঙচুর করতে হবে, যেন ঢাকায় ইন্ডিয়ান আর্মির সবচেয়ে পদস্থ কর্মকর্তা ঘোষণা না দিতে পারেন। 

রাস্তায় পরিত্যক্ত একটা টয়োটা গাড়ি পাওয়া গেল। আলমের চেষ্টায় গাড়িটাকে সচল করা হলো। হাটখোলায় এক বন্ধুর বাড়িতে মেজর হায়দারের রাত কাটানোর কথা। তার বন্ধু ফতেহকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল ফতেহর এক বন্ধুকে। যেভাবেই হোক ফতেহ ও  হায়দারকে খুঁজে বের করো, তাকে বলা হলে। এবং এক ঘণ্টার মধ্যে যেন তারা রেডিও অফিসে হাজির হয়। 

রেডিও অফিস থেকে বলা হলো, রেডিওর সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক শামসুল হুদা চৌধুরী একমাত্র ব্যক্তি, যিনি রেডিও স্টেশনকে চালু করতে পারবেন। রেডিওর সব কাজকর্ম তার কাছে হাতের তালু মতোই পরিচিত। ইস্কাটনে তার বাসাটা আলমের চেনা। সকাল সাড়ে পাঁচ বা ছয়টায় সে বাসায় হাজির হলো। খ্যাতনামা গায়িকা লায়লা আর্জুমান্দ বানু তাদের চমচম দিয়ে আপ্যায়ন করল। শামসুল হুদা চৌধুরীকে অস্ত্রের খানিকটা ভয় দেখিয়ে ঘটনা খুলে বলল আলম। সব শুনে শামসুল হুদা চৌধুরী রাজি হয়ে গেল। পাশাপাশি জানাল, মিত্র বাহিনীর কেউ আসলে তাকেও বলা হবে, রেডিও চালাতে ক্রিস্টালের প্রয়োজন এবং এ ক্রিস্টাল মিরপুরে পাওয়া যাবে বলে ঠেকানো যাবে। তখনকার দিনে রেডিও চালাতে ক্রিস্টালের প্রয়োজন হতো। এ ছাড়া রেডিও চালানো যেত না। 

রেডিও অফিসে এসে দেখে মেজর হায়দার এবং শাহাদত চৌধুরীও এসেছে। এসেছে দুজন সাংবাদিকও। দোতালার কোনার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো ক্যাপ্টেন হায়দার এবং শাহদত চৌধুরীকে। এর মধ্যে মিত্রবাহিনীর এক সেনা কর্মকর্তা রেডিও অফিসে এসে হাজির। শামসুল হুদা চৌধুরী চলে গেলেন আঞ্চলিক পরিচালকের কক্ষে। সেখানেই তাকে স্বাগত জানানো হলো। কয়েক মিনিট কথা বলার পর ভদ্রলোক হাসিখুশি মনে চলে গেল। শামসুল হুদা চৌধুরী বলল যে লে. কর্নেল পর্যায়ের ইন্ডিয়ান কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে রেডিও স্টেশন মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে। মেরামতের জন্য ক্রিস্টালের খোঁজে রয়েছে সবাই। ওসব কেবল মিরপুরেই পাওয়া যায়। 

স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার তোড়জোর চলছে, সে সময় সাদেক হোসেন খোকার দল আওয়ামী লীগের দুই নেতা, নারায়ণগঞ্জের এমপি শামুসজ্জোহা এবং চট্টগ্রামের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীকে নিয়ে উপস্থিত হলো। জহুর আহমেদ চৌধুরীকে চিনতই না আলম। তারা মেজর হায়দারের সাথে কথা বলতে চায় বলে জানাল। চালাকি করে তাদের ওই ঘরেই বসিয়ে রাখা হলো। তাদের দুজনকেই ব্যস্ত রাখার ফন্দি বের করা হলো। মেজর হায়দারের সাথে কী কী বিষয় কথা বলার ইচ্ছা আছে, তা যেন লিখে দেয়। জানানো হলো তাদের।

সকাল ৮:১০-এ বাংলাদেশ রেডিও চালু হলো। মেজর হায়দার ভাষণ দেওয়ার আগে বাংলায় অনুষ্ঠানের ঘোষণা করবে ফতেহ, ঠিক করা হলো। শান্ত ভঙ্গিতে মাইক্রোফোনের সামনে বসে রইল ফতেহ। কারিগরি বিভাগের একজন বাইরে থেকে ইশারায় দেখাল লাল আলো জ্বলে উঠেছে। অর্থাৎ এখন যা বলবে সবই বেতারে শোনা যাবে। অন এয়ারে যাবে। ফতেহ ঘোষণা করল, তারপরই ৮:১৫ মিনিটে মেজর এ টি এম হায়দারের কণ্ঠ বেতারে ছড়িয়ে পড়ল, ঘোষিত হলোÑ'দেশ মুক্ত হয়েছে এবং বাঙালিরা এখন এ দেশের স্বাধীন নাগরিক।' এরপর সব মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীরা নিরাপত্তার জন্য কিছু নির্দেশ দেওয়া হলো। তার ঘোষণা শেষ হওয়ার পরই আলম ও তার দলের যোদ্ধারা, ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা রেডিওর দায়িত্বভার খোকার দলের কাছে দিয়ে ওই স্থান ছাড়ল। 

সেদিন দুপুরে আলমের সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী ফোন করল ঢাকা টেলিভিশনের পরিচালক এজাজ আহমদকে। ইংরেজিতে কথা বলার সময় নিজেকে মেজর হায়দারের স্টাফ অফিসার হিসেবে পরিচয় দিল। এর আগে শামসুল হুদা চৌধুরী এই ফোন করার পরামর্শ দিয়েছিল। এজাজ আহমেদ চৌধুরী প্রয়োজন মনে করলে রেডিও শামসুল হুদা চৌধুরীর সাথে কথা বলে নিতে পারে। জানানো হলো, বর্তমান পরিস্থিতি ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেবে শামসুল হুদা চৌধুরী। যা হোক, সাড়ে চারটায় পূর্বকথামতো টেলিভিশন স্টুডিওতে পৌঁছে গেল ফতেহ, মুক্তিযোদ্ধা আফিকুর রহমান (টিপু) এবং অন্যরা। এর কয়েক মিনিট পর একটা খোলা জিপে হাজির হলো মেজর হায়দার, শাহাদত এবং আলম। ডিআইটি ভবনের প্রথম তলায় ছিল স্টুডিও। এর আগে কখনোই টিভি স্টুডিওতে যায়নি আলম। 

একটি টেবিল ফ্যান বসানো হলো পতাকা দ-ের নিচে। পুরো গতিতে ফ্যান ঘোরানোর ব্যবস্থা করা হলো। সে বাতাসে পতাকাটা উড়তে থাকল পত পত  করে। বিশাল স্টুডিও ক্যামেরায় উড়ন্ত পতাকার দৃশ্য ধারণ করা হলো। শাহাদত এবং অন্য কয়েকজন মিলে অনুষ্ঠান সূচি চূড়ান্ত করল। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তাতে সই করতে হলো আলম এবং ফতেহকে। এজাজ আহমদ টিভি প্রশাসনের পক্ষ থেকে সই করলেন। ফতেহ আলী চৌধুরী অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেবে বলে ঠিক করা হলো। এরপরই রেডিওতে স্বাধীন হওয়ার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাই দেবে মেজর হায়দার। সুদর্শন মুক্তিযোদ্ধা আফিকুর রহমান (গোপীবাগের টিপু) ইংরেজিতে একই ঘোষণা পড়বে। 

অনুষ্ঠান তরতর করে সূচি ধরেই এগিয়ে গেল। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে এল আলম ও তার সাথিরা।
 

Related Topics

টপ নিউজ

ক্র্যাক প্লাটুন / ১৯৭১ / ১৬ ডিসেম্বর / পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী / হাবিবুল আলম

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • হাফ ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে শিক্ষার্থীকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যার অভিযোগ
  • ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল বন্ধ: ইউটিউবের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে সরকার, প্রয়োজনে পালটা পদক্ষেপ
  • পাকিস্তানের হামলায় রাফাল ভূপাতিত: দাসোর শেয়ারে ধস, চীনের চেংডুর শেয়ার ঊর্ধ্বমুখী
  • আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিয়ে ‘কয়েকটি কথায়’ যে ইঙ্গিত দিলেন মাহফুজ আলম
  • পাকিস্তানের হামলায় ভূপাতিত ভারতের ইসরায়েলি হ্যারপ ড্রোন সম্পর্কে যা জানা গেলো
  • বকেয়া পরিশোধ: জালালাবাদ ৬৫ মিলিয়ন ডলারের গ্যাস প্রকল্প ফের চালু করতে শেভরনকে অনুরোধ সরকারের 

Related News

  • মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনছে সরকার
  • ১৬ বছর ভারত ছাড়া হাসিনাকে দুনিয়ার আর কোনো দেশ সমর্থন করেনি: রিজভী 
  • বিজয় দিবসে ভারতীয় সৈন্যদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মোদির পোস্ট
  • ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১: বাসায় লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটি আকাশে উড়ল
  • জাতি নতুন করে বিজয় দিবস উদযাপন করছে আজ

Most Read

1
বাংলাদেশ

হাফ ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে শিক্ষার্থীকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যার অভিযোগ

2
বাংলাদেশ

ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেল বন্ধ: ইউটিউবের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে সরকার, প্রয়োজনে পালটা পদক্ষেপ

3
আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানের হামলায় রাফাল ভূপাতিত: দাসোর শেয়ারে ধস, চীনের চেংডুর শেয়ার ঊর্ধ্বমুখী

4
বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিয়ে ‘কয়েকটি কথায়’ যে ইঙ্গিত দিলেন মাহফুজ আলম

5
আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানের হামলায় ভূপাতিত ভারতের ইসরায়েলি হ্যারপ ড্রোন সম্পর্কে যা জানা গেলো

6
বাংলাদেশ

বকেয়া পরিশোধ: জালালাবাদ ৬৫ মিলিয়ন ডলারের গ্যাস প্রকল্প ফের চালু করতে শেভরনকে অনুরোধ সরকারের 

The Business Standard
Top

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net

Copyright © 2022 THE BUSINESS STANDARD All rights reserved. Technical Partner: RSI Lab