বাংলার বারুদ যখন সাম্রাজ্য বিস্তারের নেপথ্য শক্তি

বাংলার বারুদ কুক্ষিগত করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে দেয়। স্থানীয় বণিকরা শুরুতে বুঝতেই পারেনি ইংরেজদের চালাকি।
চিলির উত্তর সীমান্তে পড়েছে উষর, প্রত্যন্ত আতাকামা মরুভূমি। বিরান, খটখটে শুকনো। দুই-তিন বছরে কালেভদ্রে এখানে বৃষ্টি ঝরে। আতাকামার বাসিন্দাদের অনেকেই জীবদ্দশায় বৃষ্টির চেহারাও দেখেনি। তবু, এখানে কিন্তু ছিঁটেফোটা বুনো প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। জীবিত প্রাণীর কষ্টসহিষ্ণুতার প্রতি যেন এক ধরনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
অদ্ভুত হলেও আতাকামায় বেশ কয়েকটি ভূতুড়ে শহর ছিল। এগুলোকে এককালে বুম-টাউন বলা হতো। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮৪ সাল, এই পাঁচ বছর বলিভিয়া এবং পেরু এই বৃষ্টিপাতহীন, উষর, বিরান এলাকার দখল পেতে চিলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়েছিল। আতাকামার এমনি বিচিত্র গুরুত্বের পেছনে রয়েছে নাইট্রাস। অবাক ব্যাপার হলো, আতাকামার নাইট্রাসই ভারতের সল্টপিটার বা শোরা ব্যবসার যতি টেনে দেয়। তার আগে শোরার এই উৎপাদন ভিত্তিক একচেটিয়া ব্যবসা ছিল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে।
১৮০৯ থেকে ১৮১০ সালে ব্রিটিশদের ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান চালাতে হয়েছিল। ফরাসীরা তাদের আইল দে ফ্রঁন্স (মরিশাস), বুরবোঁ (রেইউনিয়ন) এবং রদ্রিগেসের ভারত মহাসাগরীয় নৌঘাঁটিগুলো থেকে স্প্যানিশ যুদ্ধের পক্ষে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সল্টপিটারবাহী জাহাজে আক্রমণ চালাচ্ছিল। ঘোরতর শীতে স্পেনের উপর দিয়ে পিছু হটতে থাকা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সল্টপিটারের জরুরি প্রয়োজন ছিল। ফরাসী বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে নির্মমভাবে ধাওয়া খাওয়া ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শেষমেশ রক্ষা পাওয়াটা ছিল রীতিমতো অলৌকিক কাণ্ড। স্পেনের করুন্নায় ব্রিটিশ জেনারেল জন মুরের মৃত্যু বীরত্ব গাঁথায় পরিণত হয়। চার্লস উল্ফের 'দ্য বারিয়াল অভ স্যার জন মুর আফটার করুন্না' শিরোনামের কবিতা ইংরেজ স্কুল পড়ুয়াদের অবশ্য পাঠ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৮০০ সালে ফরাসি বিপ্লবের কারণে শরণার্থীতে পরিণত এক ধনী পরিবারের ছেলে আমেরিকায় ব্যাসায়িক সুযোগের উপর জরিপ শেষে লেখেন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে অস্তিত্ববান দুই কি তিনটা কারখানা অতি বাজে মানের পাউডার উৎপাদন করলেও বেশ ভালো ব্যবসা করছে। এদের ব্যবহার করা ভারত থেকে আনা শোরা ফ্রান্সে উৎপাদিত পাউডারের চেয়ে উন্নত মানের হলেও ওরা বাজেভাবে পরিশোধন করে থাকে।
এই তরুণটি ছিলেন দ্যু পোঁ পরিবারের এলিউথেরে ইরেনি। এদের প্রতিষ্ঠানটি এল দ্যু পোঁ দে নেমোরস অ্যান্ড কোম্পানি নামে পরিচিত ছিল।
দ্যু পোদের সমৃদ্ধির নেপথ্যে ছিল ভারতীয় শোরা। আমেরিকান গৃহযুদ্ধে লিঙ্কনের সাফল্যের পেছনে ছিল শোরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বিরুদ্ধে অ্যাংলো-ফরাসী আস্থার পেছনেও ছিল ভারতের শোরার মওজুদের উপর নিয়ন্ত্রণ। জার্মানরা শোরার বহু চালানই ডুবিয়ে দিতে সফল হয়েছিল।
সল্টপিটার বা শোরা জিনিসটা কি? কেন শোরার এত গুরুত্ব ছিল? শোরার বেলায় ভারত কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে?
যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ এই শোরা বা সল্টপিটারের রাসায়নিক নাম হচ্ছে পটাসিয়াম নাইট্রেট- গান পাউডারের অতি আবশ্যক উপকরণ। ভারতীয়রা পটাসিয়াম নাইট্রেট (KNO3) তৈরির কৌশলে নৈপুণ্য অর্জন করেছিল। গানপাউডারের বাকি দুটো উপাদান হচ্ছে চারকোল ও সালফার। এদুটো অনায়াসে সস্তা দরে পাওয়া যায়।
ভারতের সমর প্রযুক্তি ইতিহাসের বৃহত্ততম গোপন' বিষয়। ইসলামি অগ্রযাত্রা, মুগল সালতানাত, এবং ব্রিটিশ সামরাজ্যবাদের উত্থানের মুখে ভারতীয় সমর ব্যবস্থার সরকারী (এবং পাশ্চাত্য) ছবি ভারতকে স্বল্প প্রশিক্ষিত এবং তীর ধনুকে সজ্জিত শত্রুপক্ষের কাছে অনায়াসে হার মানা ভীত সন্ত্রস্ত সহজ শিকার হিসাবে তুলে ধরেছে।
কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো বাস্তবতা এমনি পরিকল্পিত ভুল উপস্থাপনের পেছনে উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ধরে।
মঙ্গোলিয়ার কাহিনী
গত ১০০০ বছরে ভারতে গানপাউডারের অস্তিত্বের পক্ষে বিক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে। মালবা অঞ্চলের রানাথাম্বরের রায় হামির দেব কিছু সংখ্যক মোঙ্গল দলত্যাগীকে সাথে নিয়ে (১৩০০ খ্রিস্টাব্দ) খিলজি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বারুদ দিয়ে যুদ্ধ করেছেন বলে কথা চালু ছিল। তবে দুটো কারণে এটি বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
আধুনিক ইতিহাস বারুদ উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেয় চীনকে। প্রথমত, মুলত জনৈক আত্মস্বীকৃত ভারতবিদ্বেষী নীডহ্যামের রচনার উপর ভিত্তি করে এই দাবি তোলা হয়ে থাকে। নীডহ্যাম নিজের সুবিধামতো নিচের প্রমাণ উপেক্ষা করে গেছেন:
জাঁ ব্যাপ্তিস্তে তাভেনিয়ের ১৬৬০এর দিকে আসামেই প্রথম বারুদ ও আর্টিলারি উদ্ভাবন সংক্রান্ত একটি স্থানীয় প্রচলিত কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ধারণা করা হয় ভারত থেকেই বারুদ চীন পর্যন্ত পৌঁছায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, আসাম দখলকারী মুগল জেনারেল যুদ্ধের সময় বাজেয়াপ্ত করা অগুনতি পুরোনো লোহার বন্দুক নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত, মঙ্গোল অধিকৃত এলাকা থেকে তা মঙ্গোলিয়া, ভিয়েনা এবং রাশিয়ার দুয়ার অবধি পৌঁছে গেলেও ভারতে আসেনি। হাতে গোনা জনাকয় দলত্যাগী সৈনিক কীভাবে অমঙ্গোলীয় ভারতীয় জমিনে এত দ্রুত বিশ্বের বৃহত্তম বারুদ উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারল! অথচ চীন, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের অধিকৃত অঞ্চলে পারল না।

নীডহ্যামের ১০০ বছরের মতো আগে শোরা উৎপাদনে ভারতের অগ্রণী অবস্থান সর্বজনবিদিত ছিল। যেমন, ১৮৫২ সালের এবং ১৮৬০ সালের অন্য একটি ইংরেজি প্রকাশনা - যারা বারুদ ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং আফ্রিকা থেকে সারাসেনদের তরফে ইউরোপিয়দের কাছে পৌঁছেছে বলে বিশ্বাস করেন; যারা এর উৎপাদনকে উন্নত করে একে যুদ্ধের জন্যে সহজলভ্য করেছে-প্রকাশনাটি এই মতামতকেই গুরুত্ব দিয়েছে।
বিচিত্র কোনো লিখিত উল্লেখ বা কোনো ছবি অথবা একক কোনো একটি আর্টিফ্যাক্ট না নিয়েই চীনের বিপরীতে গোটা শিল্পটিই ছিল ভারতে। বিশ্বের ইতিহাসে ভারতের শোরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। চীনের নামমাত্র বারুদ উৎপাদনের সাথে তুলনা করতে গেলে ভারতের ব্যাপক বিস্তৃত এবং সুসংগঠিত বারুদ উৎপাদন ব্যবস্থা স্থানীয় উন্নতির দিকেই আঙুলি নির্দেশ করে। ৬৬৪ সালে চীনে জনৈক ভারতীয় পর্যটক শোরার অদ্ভুত দাহ্যশক্তির প্রদর্শনী করে এটি কোথায় পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন, এ জাতীয় খবরের অস্তিত্বও আছে।' (প্যাসি ১৯৯০, ১৬)
মঙ্গোল সেনাবাহিনীর সযত্নে ভারতে আক্রমণ চালানো এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মাথায় রাখলে দলত্যাগী মঙ্গোল সৈনিকদের কাহিনীটিকে বরং অবাস্তব বলেই মনে হয়। সেই সময়ে সম্পদের জন্যে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাওয়া বিশ্বের সমৃদ্ধতম অর্থনীতির দেশ ভারতকে চেঙ্গিস খান ঘাটাননি! ঠিক কি কারণে ইতিহাসের পয়লা সারির লুটেরা, হানাদার ভারতকে রেহাই দিলেন?
চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময় মুসলিম শরণার্থীরা ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে ভারতে আশ্রয় পেয়েছিল। ১২২১ সালে খোয়ারেজেম-শাহ এবং অন্যান পারস্য শরণার্থীরা সিন্ধু নদী পেরিয়ে চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল বাহিনীর কবল থেকে বাঁচতে ভারতের পাঞ্জাবে আশ্রয় খুঁজেছিলেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে:
'সৌভাগ্যক্রমে মঙ্গোলরা সল্ট রেঞ্জের (উত্তর পাঞ্জাব এলাকা) চেয়ে দূরে হানাদার বাহিনী না পাঠিয়ে সন্তুষ্ট ছিল, ইলতুৎমিশও বুদ্ধি করে এ এলাকা উপেক্ষা করেছেন...।'
ইসলামি শাসনের অধীনে ভারতীয় সামরিক খ্যাতি হ্রাস পাওয়ায় মঙ্গোলরা সামরিক হামলা চালিয়েছিল। মঙ্গোলরা কেবল বিপুল বিদ্রুপের শিকার তুঘলকদের শাসনের অধীনেই ভারতে সফল হয়।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গানপাউডারের উৎস
পাদনকে ভারতীয় শোরার অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল বিহার। আর এ বিহারেই প্রাচীন বৌদ্ধবিহার বা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। এখানে অবস্থানরত ভিক্ষুদের লেখাপত্রেও উল্লেখ পাওয়া যায় শোরার কথা।
১৬শ-১৭শ শতক নাগাদ, মুসলিমদের বা ইউরোপিয়দের তখন পা পড়েনি, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়দের সর্বজনীনভাবে যুদ্ধে ব্যবহার করা রকেটের দেখা পেয়েছে তারা। বণর্নাও দিয়েছেন কেউ কেউ: দশ ইঞ্চি লম্বা এবং এক ইঞ্চি ব্যসের একটা লোহার টিউব দিয়ে এই রকেট তৈরি হয়। সাধারণ বাজির মতো এটা পূর্ণ করে একটা বাঁশের শেষ মাথায় বেঁধে দেওয়া হয়। এটি সাধারণ হাঁটার ছড়ির মতো মোটা, আনুমানিক পাঁচ ফুট লম্বা, তাতে লোহার ফলা বসানো থাকে।
ইউরোপ প্রসঙ্গে
ইউরোপে শোরার মিশেলে তৈরি বারুদের যোগানে সবসময়ই ঘাটতি ছিল। তাদের বারুদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ১৬০৫ সালে গোয়ার (ভারতের দক্ষিণ পুব উপকূলীয় এলাকায় পর্তুগিজ বাণিজ্য কেন্দ্র) ভাইস রয়ের কাছে ১০ থেকে ১২ ক্রেট শোরার নমুনা পাঠনোর নির্দেশ দিয়ে লেখা স্পেনের রাজার একটি চিঠি থেকে এই বিষয়টি আঁচ করা যেতে পারে।' মনে রাখতে হবে ১৬০৫ সালে স্পেন ছিল প্রধান ইউরোপিয় শক্তি। এরসাথে ভারতীয় অবস্থার তুলনা কর যেতে পারে।
১৬০৯ সালে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ইসলাম খানের কাছে পরাজিত হলে তিনি বিশ হাজার পদাতিক সৈনিক, পাঁচশো জাহাজ এবং এক হাজার মন (৪১ টন) বারুদ সমর্পণে রাজি হয়েছিলেন।
ওয়াটরলুর ফলাফলের একটি বিস্মৃত পরিসংখ্যান থেকেও আঁচ করা যেতে পারে। ওয়াটারলু যুদ্ধের (১৮১৫) আগের বছরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডে ১৪৬০০০ সিডব্লুটি শোরা রপ্তানি করে।' ১৪৬০০০ সিডব্লুটি ৭৩০০ টন শোরার সমান। ব্রিট্রিশ অর্ড্যান্স বোর্ড পাউডার মিলস ১৮০৯ সালে ৩৬,৬২৩ টি নব্বই পাউন্ড ব্যারেল পাউডার উৎপাদন করে এবং ঠিকাদাররা সরকারকে আরও ২৪,৪৩৩ টি নব্বই পাউন্ড ওজনের ব্যারেল যোগান দিয়েছিল। ব্রিটিশ গোলাবরুদের কিছু পরিমাণ মিত্র সরকারগুলোকে সরবরাহ করা হয়। ১৭৯৬ থেকে ১৮০১ মেয়াদে পর্তুগাল ১০,০০০ ব্যারেল পাউডার, ৫০০ টন শোরা গ্রহণ করে। ব্রিটিশ সরকার ডিপো, উৎপাদন ও অস্ত্রাগার এবং ইউরোপিয় যুদ্ধের কেন্দ্র নির্মাণের বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাত দেয়।
স্পেন এবং সুইডেনও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে লড়তে গোলাবারুদ পেয়েছিল। ওয়ারটারলুতে ব্রিটিশ বিজয় ব্যাপকভাবে ফরাসী কয়লা-সদৃশ্য পণ্যের চেয়ে ঢের বেশি উন্নত বলে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ভারতীয় শোরা ব্যবহার করা ব্রিটিশ বারুদের অবদান ছিল। ওয়াটারলুর অব্যবহিত আগে ব্রিটিশ ঋণগ্রহণের সক্ষমতা চাঙা হয়ে ওঠে।
পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদরা এখন অনীহার সাথে মেনে নিচ্ছেন যে- ১৭৫৭ সাল থেকে ভারত থেকে আসা পুঞ্জীভূত সম্পদ না থাকলে ফরাসী যুদ্ধের সময় স্থলপথের লড়াইয়ে ব্রিটেনকে অর্থসংস্থানে আপোস করতে হত।' নেপোলিয়ন এবং ফ্রান্স - তাদের সম্মিলিত শক্তি ভারতে পাঠাতে এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি কোয়ালিশনে অর্থ যুগিয়ে চলা ব্রিটিশ সোনার যোগান ঠেকাতে পারেনি।
ভারতীয় বারুদের উৎপাদন ব্যবস্থা
ইতিহাসে বিশ শতক পর্যন্ত ভারতেই, বিশেষ করে বাংলা ও বিহার অঞ্চলসমূহে বৃহত্তম বারুদ উৎপাদক পদ্ধতি ছিল। নুনিয়া নামে পরিচিত একটি সম্প্রদায়ের হাতে পরিচালিত শোরার কেয়ারিগুলোই বারুদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের যোগান দিয়েছেÑসাদা গুড়ো। কার্যত ভারতই ছিল বিশ্বে এই শোরার মূল উৎপাদক।
বিশেষ করে বিহার, বাংলা, আগ্রা ও তামিল নাড়ু, অন্ধ্র এবং কর্নাটক অঞ্চলসমূহ (অনন্তপুর, কয়েম্বাতোরে, গান্তুর, কারনুল)। গান্তুর সরকারও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শোরা উৎপাদন করেছে। সতেরো শতকে রয়্যাল সোসাইটি পত্রিকা ভারতে কিভাবে শোরা উৎপন্ন হতো তার বিবরণ তুলে ধরেছে। বাকি বিশ্বে উৎপাদিত অল্প পরিমাণ শোরা ছিল মূলত ক্যালসিয়াম নাইট্রেট। এটা এক ধরনের হাইগ্রোস্কোপিক লবন হওয়ায় বাতাস থেকে আর্দ্রতা শুষে অনায়াসে নষ্ট হয়ে যায়।
আর্মেনিয়রা, পরবর্তী সময়ে পলাশী বিদ্রোহের কুশীলব কোলকাতার কুখ্যাত বণিক উমিঁচাদ বাংলা/বিহারে শোরার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরা সবাই শোরার (পটাসিয়াম নাইট্রেট) বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ অংশীদার ছিলেন। নাইটার নামেও পরিচিত শোরাই বারুদের প্রয়োজনীয় উপকরণ ছিল।
বারুদ ব্রিটিশ একচেটিয়া বাণিজ্যে পরিণত হলো
বাংলা অধিগ্রহণের পর ব্রিটিশরা আঠারো শতকের শেষদিকে এসে ব্রিটিশ বিশ্বের মোট শোরার উৎপাদনের সত্তর শতাংশের উপরে নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়। বারুদের মওজুদ চটপট গড়ে তোলা যেত না বলে শান্তির সময়েও এর চাহিদা নেহাত কম ছিল না। এর পেছনে কারণ হলো শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছাড়াও জরুরি ভিত্তিতে কাজে লাগাতে অবিরাম এর উৎপাদন বা কেনাবেচা চলত। ভারতের মোগল ও অন্য শাসকরাও উৎসবে বাজি পোড়ানোর কাজে শোরা ব্যবহার করত।
বারুদ উৎপাদনে কৃত্রিম পদ্ধতির উপর নির্ভরতার কারণেই চীন গোলাবর্ষী আর্টিলারির বদলে আতশবাজী, রকেট এবং অন্যান্য আগুনে বস্তু প্রস্তুত করেছিল। চীনারা আবার অতিরিক্ত অনুপাতে চারকোল ও সালফারও ব্যবহার করত বলে জোরালো আগুন জ্বললেও ক্ষতির ক্ষমতা ছিল কম। অন্যদিকে ভারত খুব উন্নত মানের শোরা উৎপাদন করত বলে রকেটের পাশাপাশি বারুদের অস্ত্রশস্ত্র, বিশেষ করে ভারী বন্দুক তৈরিতে সক্ষম হয়েছিল। নানাভাবেই, বিশেষ করে চূড়ান্ত পণ্যের শক্তি, বাণিজ্যিক সংগঠন এবং সামরিক উদ্দেশ্যে এর ব্যবহারের নিরীখে ভারতীয় বারুদ উৎপাদন চীনের চেয়ে অগ্রসর ছিল। ১৪৬০-র দশকের দিকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য শুরুর প্রায় চল্লিশ বছর আগে, পারস্য সূত্রগুলো এটা স্পষ্ট করে দিচেছ যে জৌনপুর ও বাংলার শাসকগণ ইতিমধ্যেই তাদের প্রধান প্রধান বণিকদের মাধ্যমে শোরার উৎপাদনকে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া ব্যবসা হিসাবে সংগঠিত করেছিলেন।

বারুদ প্রযুক্তির অবকাঠামো নির্মাণের দিক থেকে ভারত পশ্চিম ইউরোপ থেকে মোটামুটি একশো বছর এগিয়ে ছিল। তবে এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে ইউরোপ থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শোরা ভারতে চালান হতো না। ১৬১৭ সাল নাগাদ পর্তুগিজ রাজা শোরার আরও যোগানের জন্যে ইউরোপিয় প্রার্থীদের দলে যোগ দেন। রাজাপুরের শোরা বণিজ্যের পুঁজি ছিল স্বরস্বত ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে। গোয়া এবং দিউর মতো সুদূর এলাকার বিনিয়োগকারীরা এতে অংশ নিয়েছেন। শিবাজি (শা. ১৬৬৪Ñ১৬৮০) এবং তার উত্তরসুরীরা নাইট্রেট সংগ্রহকে রাষ্ট্র্রীয় একচেটিয়ায় কাযর্ক্রমে পরিণত করে পর্তুগিজ, তাদের ভারতীয় এজেন্ট এবং বানজারা উৎপাদকদের মারাঠা রাষ্ট্রের সাথে লেনদেনে বাধ্য করেন।
মুগল সাম্রাজ্যকে এ কারণেই 'গানপাউডার সাম্রাজ্য' হিসাবে উল্লেখ করা হত। মুগল নথিপত্র থেকে এটা পরিষ্কার যে, কেবল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতীক এবং বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার সরঞ্জাম হিসাবে বন্দুক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইব্রাহিম লোদীর (শা. ১৫১৭-১৫২৬) বিরুদ্ধে বাবুরের (শা. ১৫২৬-১৫৩০) বিজয় প্রায়ই তার গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহারের ফল বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন: খোদা ভীরু বাবুর তুর্কী বন্দুকের মতো নিজের বিচার বিবেচনাকেও মূল্য দিয়েছেন। পানিপথের যুদ্ধের (১৫২৬) পর প্রথম মুগল শাসক বাবুর ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের হুকুম দেন। এটা ছিল এই জাতীয় হত্যার প্রথমদিকের নজীর। বাবুরের যুদ্ধের সমসাময়িক বিররণও অশ্বারোহী বাহিনীর অব্যাহত প্রাধান্যের কথাই উল্লেখ করেছে, বন্দুকের উপস্থিতি থাকলেও তার চরম কোনো প্রভাব ছিল না। তাসত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়া যুদ্ধ নীতি বদলে যাচ্ছিল। বাবুরের বড় ছেলে ও উত্তরসুরি হুমায়ূন (শা. ১৫৩০-১৫৩৯/১৫৫৫-১৫৫৬) গুজরাটের সুলতান নিয়োজিত তুর্কী গোলন্দাজ রুমি খানকে সপক্ষে টানতে উদগ্রীব ছিলেন। স্বল্পমেয়াদী সুর শাসনামলে শের শাহর (শা. ১৫৪০-১৫৪৫) বারুদের বিস্ফোরণে তার মৃত্যুর মতো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ভারতের ক্ষেত্রে ষোল শতকের প্রথমাংস তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক অদলবদলের কাল ছিল, এটা তলোয়ার ও আগ্নেয়াস্ত্রের যুগের সন্ধিক্ষণ।
শের শাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে বর্ধিত রাজস্ব আদায়ে সক্ষম একটি আমলাতান্ত্রিক সরকার ও শক্তিশালী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটি রাষ্ট্র নিয়োজিত এবং পরিপালিত কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সেনাবাহিনী নিয়ে অনায়াসেই টিকে থাকতে পারে। এই শিক্ষা আকবর (শা. ১৫৫৬-১৬০৫) ভুলে যাননি। তার উপদেষ্টা আবুল ফজল শের শাহর বহু উদ্ভাবনই গ্রহণ করেছিলেন।
এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, শের শাহর অস্ত্রধারী পদাতিক বাহিনী গাঙ্গেয় সমতল থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল। এখানে শোরার উৎপাদন ইতিমধ্যে আঞ্চলিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে এই এলাকাটি মুগল এবং শেষপর্যন্ত ব্রিটিশদেরও সৈনিকের যোগান দিয়েছে।
ব্রিটিশরা একচেটিয়া অধিকার পাওয়ার পর একে রক্ষা করেছে। তারা শোরা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এভাবেই ভারতীয়দের বশে আনতে ইংরেজদের হাতে প্রাচীন ভারতীয় প্রযুক্তিকে বাগে আনা হয়েছিল।
ব্রিটিশরা শোরার নাগাল পাওয়ায় এবং অন্যান্য ইউরোপিয় শক্তির নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায়, অন্য ইউারোপিয় শক্তির কাছে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজরা ভারতের বাণিজ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অন্যদের জন্য পণ্যটি দুষ্প্রাপ্য করে তোলে।
দক্ষিণের কনফেডারেটদের বিরুদ্ধে আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সূচনায় উত্তর ৩ মিলিয়ন পাউন্ড নাইটার, অর্থাৎ শোরার মওজুদের সুবিধা নিয়েই লড়াইতে নামে। কনফেডারেটরা ব্রিটেন থেকে শোরা সংগ্রহের জন্যে জেমস ম্যাসন এবং জন স্নাইডেলকে পাঠিয়েছিলÑইউরোপিয় শক্তিগুলোর ফাঁকা কূটনৈতিক স্বীকৃতির জন্য মোটেও নয়। ম্যাসন ও স্নাইডেল ইউনিয়ন বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ব্রিটিশরা তাদের মুক্তি দাবী করলেও লিঙ্কন প্রত্যাখ্যান করেন।
ব্রিটেন ইউনিয়ন বাহিনির হাতে যাতে ভারতীয় শোরা না পড়ে সেজন্যে শোরার রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইউনিয়ন বাহিনীর শোরার মওজুদ হ্রাস পেতে শুরু করলে লিঙ্কন তখন পিছু হটে ম্যাসন ও স্নাইডেলকে মুক্তি দিতে রাজি হন। যুদ্ধ শুরুর এক বছরের মধ্যেই শোরার দাম .২০ ডলার থেকে আকাশ ছোঁয়া ৩.০০ মার্কিন ডলারে ঠেকেছিল। এই ঘাটতি মোকাবিলায় কনফেডারেটরা একটি নাইটার কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভারতীয় ও মিশরীয় তুলায় ব্রিটিশ গুদামগুলো উপচে পড়ছিল বলে কনফেডারেট দক্ষিণের তুলার উপর কোনো নির্ভরশীলতা না থাকায় বৃটেন আমেরকিান যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেয় আসলে তারা দুইপক্ষকেই ভারতীয় শোরা যোগাতে থাকে।
ভারতীয় শোরা বা বারুদের বিকল্প উদ্ভাবনের ১০০ বছরেরও কম সময়ের ভেতর ব্রিটেন তার সাবেক সাম্রাজ্যের ছায়ায় পরিণত হয়।
১৮৬২ সালে যেখানে শোরা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টনেরও বেশি, সেখানে ১৮৬৫ সালে তা ১১ হাজার টানে নেমে আসে। এরপর থেকে তা কমতেই থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ থেকে বাংলার বারুদের চির বিদায় ঘটে যায়।