মঞ্জুশ্রী দাশ: উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মৌল অস্বাভাবিকতাগুলি

স্তন্যপায়ী জীবকুলে মানবসন্তানের তুল্য অসহায় দুর্বল ও সর্বাংশে পরমুখাপেক্ষী শৈশব আর কোনো জীব-সন্তানকে যাপন করতে হয় না; শারীরিক ও মানসিকভাবে কমবেশি আহত হতে হতে তার বড় হয়ে ওঠা। একটি মৌল বিশ্বাসপরায়ণতার স্থান তার প্রথমত দাবি। তার পিতা-মাতা, অগ্রজ ভাই-বোন, নানা জাতের অভিভাবকস্থানীয় ব্যক্তিসমূহের সমাহারে তৈরি তার যে আশ্রয়প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন নিজস্ব পার্থিব পরিবার বা পরিবেশ, তার কাছে; পেলে ভালো, সে 'স্বাভাবিক'ভাবে বেড়ে ওঠে, তার পাওয়া- পৃথিবীতেই সে সংগ্রামে-বিশ্রামে-প্রেমে-সার্থকতায় বাঁচে, মরে, সম্পূর্ণতায়, 'স্বাভাবিক'ভাবে।
যে পায় না, সে নানা রকম ঘটনাসংক্রামেই পায় না; পিতা-মাতা-আত্মীয়-পরিজন তাকে এত ভালোবাসেন ও আগলে রাখেন যে তার ক্রমাগত মনে হতে থাকে সে বড় বেশি দুর্বল, দয়ানির্ভর এবং প্রায় যেন কিনে আনা কুকুরছানার মতো; এত বেশি শাসিত হতে থাকে যে প্রায় নিশ্চিতভাবে সে জেনে ফেলে, সে সবার অধম, অকর্মণ্য- অর্থাৎ দুস্থ, তার প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে; আর যদি সে ভালবাসা পেল না, শাসিত হলো না, তাহলে সে একা হয়ে গেল, এত একা যে সবাই তার অহিতাকাক্সক্ষী, সবাই তাকে শেষ করে দিতে চায়, সবাই তার চেয়ে নির্মমভাবে সবল।
এই সব নানা রকমভাবে যতই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সে তার একাকিত্ব সম্বল করে কথা বলতে চায়, কিন্তু যারা একা নয়, তারা সে কথা বুঝতে পারে না, উল্টো বোঝে, হয়তো অপমানিত বোধ করে। সুতরাং সে তার নিজস্ব একাকিত্ব শমিত করার জন্য, বিচ্ছিন্নতার দুঃখবোধ প্রতিহত করার জন্য আর তথাকথিতভাবে সুখী ও স্বাভাবিক থাকতে পারে না, নিজের প্রয়োজনের সঙ্গে মানিয়ে এক অন্তর্গত পৃথিবী তৈরি করে নেয় এবং কখনো কখনো, স্রষ্টা হয়ে উঠতে চায়- তা সে লিখে হোক, ছবি এঁকে হোক, মৌল কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উদ্ভাবনে গিয়ে হোক বা একটি বিশিষ্ট সুর গড়ে তুলেই হোক।
আসল কথা, তার একটি বিশ্বাসপরায়ণ, যথোপযুক্ত কথোপকথনসম্ভব ও শৃঙ্খলাশীল পৃথিবী দরকার, যা তার নিজের মতো, তার শৈশবের যাবতীয় সম্ভাবনা অনিবার্যতায় গড়ে ওঠা, যেখানে সে হীন নয়, দুর্বল নয়, কাঙাল বা কেনা-পুতুল নয়; পক্ষান্তরে, স্বরাট ও সর্বসম্ভাবনাময়; সে সেই ব্যক্তিগত ও অন্তর্গত পৃথিবী তৈরি করে নেয় বলে সে স্রষ্টা হয়ে ওঠে কখনো কখনো। তাঁর কথ্য ভাষা অন্যের বোধগম্য হোক বা না হোক, সে এই কারণে গর্বী হয়ে ওঠে যে, সে তার প্রতিপক্ষ থেকে আলাদা চরিত্র প্রচার করেছে; সে যে কারও তোয়াক্কা করে না, সেই অহংকার ঘোষণা করেছে; অধিকন্তু, এমন যদি হয় যে, দু-চারজন তার কথা বুঝতে পারছে, তাহলে সে বন্ধুত্ব-আকর্ষণের শর্তে তার অমিত বলশালিতাও প্রকাশ করেছে।
কিন্তু যার বেলা এ রকমটা হলো না, তার কী হবে? কোনো সার্থক স্রষ্টার যে-সন্তান জন্মসূত্রে পিতার থেকে এই সব চরিত্র অর্জন করল, বা পিতার শৈশবের ক্রিয়াশীল যোগাযোগগুলি যার ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রবল ছিল বলে এই বিশেষ চারিত্র্য যার উপরও বর্তাল, কিন্তু যে সমানুপাতিকভাবে বহিঃপৃথিবীতে স্রষ্টা হয়ে উঠতে পারল না, যার অন্তর্গত পৃথিবীটি সুসামঞ্জস্যে গড়ে ওঠে প্রতিকূলতার প্রতিরোধের আবাস-ধর্ম হয়ে উঠতে পারল না, সে শেষ পর্যন্ত কী হয়ে উঠবে?
সে একজন মঞ্জুশ্রী দাশ হবে।
মঞ্জুশ্রী দাশ পিতা জীবনানন্দের মতোই 'স্বাভাবিকতা' উপার্জন করতে পারলেন না, ভালোবাসতে বা ভালোবাসায় আহূত হতে পারলেন না, পারিপার্শ্বিক পৃথিবীকে ভয় পেলেন ও অবিশ্বাস করলেন, কথ্য ভাষায় কথা বলবেন বলে নানা শ্রেণীর শ্রোতার কাছে উপনীত হলেন, কিন্তু কথা বলবার আগেই মূক হয়ে গেলেন, সব রকম চাকরিতে শেষ বিচারে বেমানান প্রতিপন্ন হলেন, নিরেট দারিদ্র্যের সঙ্গে মোটামুটি এক রকম সমঝোতা করেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, তিনি যাঁদের কথা দিয়েছিলেন এবং যাঁরা তাঁকে আশ্বাস জোগাবেন কথা দিয়েছিলেন, কেউই পরস্পরের কথা রাখলেন না, ব্যবহারিক প্রেমে আস্থা খুঁজে যারপরনাই কষ্ট পেয়েছেন এবং সেই প্রেমকে পুরোপুরি অবহেলাও করেছেন শেষ অব্দি, এবং, সর্বোপরি, মানসিক চিকিৎসালয়ে সর্বদা পশ্চাদ্ধাবনশীল 'আততায়ী'দের থেকে পালাতে-পালাতে ঢুকে পড়ে মৃত্যুকে স্বীকার করলেন।
এই সব করতে করতে তিনি সপ্রমাণ করলেন যে ব্যক্তিপিতার কন্যা হিসেবে উত্তরাধিকারে তিনি সর্বাংশে নিষ্ঠাবতী থেকেছেন, কেননা স্রষ্টা পিতার সৃষ্টিপ্রতিভা ব্যতিরেকে অন্যান্য মৌল অস্বাভাবিকতাগুলি তিনি গাঢ় মমতায় অর্জন করেছিলেন।
আঠারো মার্চ ১৯৯৫ রাত নটা কুড়ি মিনিটে যাদবপুরের 'বাউল মন' নামের মানসিক হাসপাতালে জীবনানন্দের প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রী দাশের জীবন শেষ হলো। একধরনের মানসিক অবসাদে তিনি দীর্ঘদিন কষ্ট পাচ্ছিলেন, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেহে শর্করাধিক্য-বিষয়ক ব্যাধি। চিকিৎসায় মানসিক অবসাদ প্রায় কেটে এসেছিল, স্বপ্ন দেখেছিলেন আবার কর্মজীবনে যোগ দেবার। এই সময়ে সহসা তাঁর হৃদযন্ত্রের কাজ থেমে যায়।
মঞ্জুশ্রী নিজেও কবিতা লিখতেন, বাবাকে নিয়ে নানা কাজ করার তাঁর পরিকল্পনা ছিল।
শেষ দিকে অধ্যাপিকা-প্রাবন্ধিক শ্রীমতি সুমিতা চক্রবর্তী তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। মঞ্জুশ্রীকে সুস্থ করে তোলার জন্য তিনি যে শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তার জন্য মঞ্জুশ্রীর অনুরাগীরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।
- লেখক: জীবনানন্দ গবেষক