ইংরেজিকে গদিচ্যুত করা যাবে?

সেই ১৯১৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন জার্মানি এবং মিত্র বাহিনীর ভেতর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটানো ভার্সাই চুক্তি করতে সফল হয়েছিলেন। ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসী ভাষাতেও এই চুক্তি লেখা হয়। তখন থেকে কূটনীতি এবং তারপর ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং গণমাধ্যমেও ইংরেজি শেকড় গেড়ে বসে। এখন দুনিয়াজোড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই ভাষাটির একচেটিয়া আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে।
একুশ শতকের শুরু থেকে অর্থনীতির দ্রুততর বিশ্বায়ন এবং ইংরেজির ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলছে। ক্রমেই বেশি হারে মানুষ মাতৃভাষার বদলে বরং ইংরেজি ব্যবহার কিংবা ইংজেরিতে বার্তা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছে। তাতে অবশ্য অনেকেই তেমন কিছু মনে করছেন না। এরা একে বিশ্বব্যাপী সমরূপতার ধারার অনিবার্য অংশ হিসাবে দেখছেন। মানুষের পরস্পরের সাথে ক্রমবর্ধমান প্রত্যক্ষ যোগাযোগের উপায়ও মনে করছেন একে।
এদিক থেকে সম্পদের সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিনিময়ও সহজ হয়ে ওঠায় ইংরেজির বিস্তারকে ইতিবাচক পরিবর্তন ভাবা যেতে পারে।

সে যাই হোক, বলা যায়, ইংরেজির অগ্রযাত্রা মানে অপরাপর ভাষাকে উৎখাত করা নয়, বরং বিপুল শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর একটা উপায় মাত্র।
কিন্তু একেই চূড়ান্ত বলে মেনে নিলে ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা, ভাষিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তৎপরতার ভেতরকার সম্পর্ককেই অস্বীকার করা হয়। অথচ এগুলোই প্রতিটি সমাজের বিভিন্ন মানুষ ও গোষ্ঠী এবং সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের ভেতরের সম্পর্ককে জোরালো করে তোলে। কোনো একটি বা একাধিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা দিয়েই ব্যক্তি বিশেষ নিজেকে আলাদা করে তোলেন। এবং বেশ কয়েক প্রজন্মান্তর শেষে সবচেয়ে উপযোগী ভাষা অন্যগুলোকে অপসারণ করে।
সাংস্কৃতিক সাম্রজ্যবাদ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের তুলনায় ঢের বেশি সূক্ষ, এটা আবার রাজনৈতিক ও সামরিক সাম্রাজ্যবাদের তুলনায় কম অনুভবযোগ্য এবং কম দৃশ্যমান। শেষদুটির বেলায় বাড়াবাড়ি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠায় প্রতিরোধ সহজ। ইংরেজি ভাষার দাপট অ্যাংলো-স্যাক্সন শক্তির রাজনৈতিক উদ্যোগ কিংবা বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মারফত বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের অনুপ্রবেশের সাথে হাত মিলিয়ে পরিকল্পিতভাবে সংগঠিত এবং সমর্থিত হয়েছে বলাটা ভুল হবে। 'ভাষার যুদ্ধ'-কে কচিৎ যুদ্ধ হিসাবে দেখা হয়েছে। কোথাও কখনও এই যুদ্ধের আনুষ্ঠাানিক ঘোষণা হয়নি।
প্রধান প্রধান পরাশক্তির সামরিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কৌশলের পর্যালোচনা এবং সমালোচনা করা সম্ভব, কিন্তু ভাষিক রণকৌশল যেন অলক্ষে অস্পষ্ট থেকে যায়, এমনকি নিরীহ কিংবা অস্তিত্বহীন ঠেকে। বিগত শতকের ইতিহাস বহু পরাশক্তিকেই ভাষার প্রতি ঢের বেশি সুবোধ দৃষ্টিভঙ্গি নিতে বাধ্য করেছে, কিন্তু একটি মাত্র ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শিক্ষা কি দিয়েছে?
১৯৪৫ সালে ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার ২২টি দেশ নিয়ে আরব লীগ প্রতিষ্ঠার বহু বছর বাদে ফরাসী ভাষাগত ঐতিহ্যের অংশীদার দেশগুলো একটি যৌথ নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটায়। ভাষিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এই দেশগুলো ফরাসীভাষী দেশের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলে। এই সংগঠনটি (কমনওয়েলথের মতো) ৫০০ মিলিয়ন অধিবাসী নিয়ে ৫০টিও বেশি দেশকে একাত্ম করেছে।

১৯৯১ সাল থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী আট কিংবা তারও বেশি ওলন্দাজভাষী জনগোষ্ঠীর সম্মেলনের পাশাপাশি ইবারো-আমেরিকানদের শীর্ষ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে বিরতি দিয়ে দিয়ে। শেষের এই সম্মেলনে দুই বছর পর পর ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ২০টিরও বেশি দেশকে একত্রিত (১২০ মিলিয়ন মানুষ) করছে। ১৯৯৬ সাল থেকে পোর্তুগীসভাষী দেশগুলোর সংস্থা সাতটি দেশের (২০০ মিলিয়ন) মানুষকে এক করেছে।
প্রতিরোধের অঞ্চল
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষাগুলোর সমন্বয়হীন প্রতিরোধ কি সাংস্কৃতিক সমরূপতার হুমকির সাথে পেরে উঠবে? মনে হয় না, কারণ প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব ভৌগোলিক বলয় রয়েছে, সেই বলয়ের ভেতরই সেটি উপযোগের বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশ্বের এক ডজন সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের একসাথে করলে সংখ্যাটা তিন বিলিয়ন--অর্থাৎ গোটা মানবজাতির অর্ধেক--ছাড়িয়ে যায়। এই সংখ্যা অনায়াসে মোটামুটি ইংরেজি যাদের সরকারী ভাষা (কমনওয়েলথ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), সেই দুই বিলিয়নকে ছাড়িয়ে যাবে। সমন্বিত প্রয়াসের ভেতর দিয়ে এইসব প্রধান ভাষা নিশ্চিতভাবেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় জায়গা করে নিতে পারে।
বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষার ভবিষ্যতই হুমকির মুখে পড়েছে, ব্যাপারটা তা নয়। স্কেলের আরও নিচের দিকে ১০০টিরও মতো সরকার বা উপজাতীয় অঞ্চলের স্বীকৃত ভাষা, যেমন ভারতের সাংবিধানিক ভাষা এবং রাশিয়ার বিভিন্ন জাতির ভাষাও রয়েছে। এইসব ভাষার নিজস্ব জায়গা এবং তা রক্ষার অধিকার আছে। স্কেলের একেবারে নিচে সংগ্রামে নিয়োজিত হাজার হাজার ভাষা আছে, এগুলোকে অনেক সময় দেশী, সংখ্যালঘু, গোষ্ঠী কিংবা জাতিগত ভাষা বলা হয়ে থাকে। এগুলোর বেশিরভাগই বিলুপ্তির হুমকিতে আছে। প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ এইসব ভাষায় কথা বলেন।

ছোট ছোট ভাষাগুলো কি অনেকের অনুমান মোতাবেক মারা যাবে? হ্যাঁ, তার কারণ ভিন্ন একটি ভাষা শেখানোই কোনো একটি ভাষা হত্যার সেরা উপায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় ১০০টি ভাষার একচেটিয়া অধিকারের কারণে স্কুলে যেসব ভাষা পড়ানো হয় না সেগুলোকে ঘরের ভেতর এবং লোককাহিনীতে বন্দী করে শেষতক সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকেই বিদায় জানাবে।
পরিকল্পিতভাবে হোক বা না হোক, ভাষার হত্যাকাণ্ড বা 'ভাষাহত্যা' জাতিগত বিনাশ, সবসময় উপনিবেশিকরণের শিকারে পরিণত জাতির বিসাংস্কৃতিকরণের মৌলিক কায়দাগুলোর একটি। এইসব জাতি এখনও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার অস্বীকার করে আসা সরকারগুলোর আধাসরকারী লক্ষ্য হয়ে আছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে স্থানীয় ভাষাগুলোকে ক্রমবর্ধমানহারে বাদ দেওয়ায় 'ভাষাহত্যা' ত্বরান্বিত হচ্ছে।
একুশ শতকের ভাষা ইস্যু দুটো প্রশ্ন তুলে ধরছে। বহুল ব্যবহৃত বা জাতীয় ভাষাগুলো কিভাবে ইংরেজির আগ্রাসন ঠেকাতে পারে? এবং বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা সংখ্যালঘুর ভাষাকে কিভাবে রক্ষা করা যাবে এবং তা বিকাশের সুযোগ পাবে?
ব্যবহারকারীই সিদ্ধান্ত নেবে
পরিবেশ বিজ্ঞান যেভাবে বিশ্বকে একক কোষ থেকে শুরু করে সৌরজগতের পরস্পর সম্পর্কিত ধারা হিসাবে তুলে ধরে, তেমনি এই গ্রহের ভাষাগুলোকেও অভিকর্ষের উপর নির্ভরশীল একটা ব্যবস্থা হিসাবে তুলে ধরা সম্ভব। আজকের দিনে এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে এক ধরনের 'হাইপারসেন্ট্রাল' ভাষা ইংরেজি, যাকে ঘিরে ডজনখানেক 'সুপারসেন্ট্রাল' ভাষা ঘুরছে। দ্বিভাষিক মানুষ মারফত সুপারসেন্ট্রাল ভাষাগুলোর সাথে সম্পর্কিত ১০০ থেকে ২০০ 'সেন্ট্রাল' ভাষা আবার ৪,০০০-৫,০০০ 'পেরিফেরাল' ভাষায় ঘেরাও হয়ে আছে।
এইসব ভাষার ওজন, জৌলুশ বা সম্ভাবনা সমান নয়। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এগুলোকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
শিশু সীল বা তিমির মতো ভাষাকেও বিপদাপন্ন প্রজাতি ভাবা হচ্ছে। কিন্তু কেবল 'পেরিফেরাল' ভাষা নিয়েই উদ্বেগ কেন্দ্রীভূত নয়। ইংরেজি এবং ফরাসীসহ বহুল ব্যবহৃত হাইপার বা সুপার-সেন্ট্রাল ভাষার ক্ষেত্রেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউএস ইংলিশ, ইউএস ফার্স্ট এবং সেভ আওয়ার স্কুলস-এর মতো সংগঠনগুলো উল্লেখযোগ্য হিস্পানিক অভিবাসনের পটভূমিতে দ্বিভাষিকতার মোকাবিলায় ইংরেজিকে দেশের একমাত্র সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য ভাষা থেকে ধার করা শব্দ ব্যবহার প্রতিহত করে ফরাসী ভাষা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্যেই ফ্রান্সে ১৯৯৪ সালের 'তুবোঁ আইন' জারি করা হয়েছিল।
ভাষার শুদ্ধতার মিথ
ভাষার শুদ্ধতা একটি মিথ, এটা কেবল বন্ধ্যাত্বের দিকে নিয়ে যায়। সিসেরো যে লাতিনে কথা বলতেন, সেটা সম্ভবত খাটি ভাষা ছিল; কিন্তু এখন আর কেউ সেই ভাষায় কথা বলেন না। আজকের দিনে কয়েক শতক জুড়ে বিকশিত লাতিনের বিভিন্ন ভাষ্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। এসবের ভেতর রয়েছে ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, রোমানিয়ান এবং কাতালান।
এই মিথ, সংরক্ষণের এই আকাঙ্খা, পরিবর্তনের প্রতি এক ধরনের নির্বোধ ভীতি, অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ ও বুলি ধার করার ভীতি তুলে ধরে। যেন স্থিতিশীলতাই কোনওভাবে পরিচয়ের নিশ্চয়তা দেবে। ভাষা রক্ষার নীতি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে, বা যাওয়া উচিত?
এক ধরনের স্যালাইন বা নিবিড় পরিচর্যার ভিন্ন কোনো কায়দায় ব্যবহারকারীদের বর্জিত ভাষার রূপ কি জাগিয়ে রাখা সম্ভব?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাষানীতি সফল হয়েছে:
বিশ শতকের গোড়ার দিকে তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক তুর্কী ভাষার বানান সংস্কারের বেলায় কর্তৃত্বমূলক কৌশল কাজে লাগিয়ে তুর্কী অভিধান থেকে সমস্ত আরবী-ফারসি শব্দ ঝেটিয়ে বিদায় করেন। ইন্দোনেশিয়া ঐক্যের ভাষা 'বাহাসা' গ্রহণ করেছে। অন্যান্য দেশে এই ব্যাপারটা সেভাবে প্রত্যক্ষ ছিল না। আলজেরিয়ায় আরবীকরণ এখনও বড় ধরনের বাধার মোকাবিলা করছে; এবং গিনির পরলোকগত প্রেসিডেন্ট সেকুতুরের দেশটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বহুভাষিক করে তোলার চেষ্টা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে।

'ভাষার লড়াই': এক ধরনের সুবিধাবাদী বুলি
কোনও সমাজের বিকাশের সাথে তাল মেলানো গেলেই কেবল ভাষানীতি ফল দিতে পারে। বিরল ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ভাষা বা সংস্কার চাপানো সম্ভব। লোকে যে ভাষায় কথা বলতে চায় না, সেটিকে রক্ষা বা বাঁচানো কি সম্ভব? প্রশ্নটা খোদ ভাষার নয়, বরং যারা কথা বলেন তাদের ভাষার উপর আরোপিত গুরুত্বের সাথে সম্পর্কিত। কোনো ভাষানীতিই একে অগ্রাহ্য করতে পারে না।
কেবল অন্য ভাষার আধিপত্যের কারণেই একটি ভাষা হারিয়ে যায় না—বর--সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বড় কারণ--মানুষ সেই ভাষাকে বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের সন্তানদের হাতে তুলে না দেওয়াতেই এমন ঘটে। 'ভাষার লড়াই' কথাটা একটা সুবিধাজনক বুলি, তবে খোদ ভাষা একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে পারে না। আসলে জনগণই সংগ্রাম করে, যুদ্ধ করে কিংবা একে অপরের সাথে একমত পোষণ করে। ভাষার ভেতরকার সম্পর্কের নিরীখেই আমরা সেগুলোর সংঘাতপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পর্কে অনুসরণ করতে পারি।
ভাষার মৃত্যুতে ভাষাবিদরা সবসময়ই দুঃখ পান। কিন্তু ভাষা জাদুঘরের সামগ্রী নয়। যারা যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষাই সেই জাতির সম্পদ, তাদের প্রয়োজন মোতাবেক ভাষা ক্রমাগত পাল্টায় এবং খাপ খাইয়ে নেয়। জনগণের কাজে লাগার জন্যেই ভাষা, উল্টোটি নয় কখনওই। ভাষার ধরনের বিবর্তন এবং তার সম্পর্ক একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো ভাষার মৃত্যু ঘটে, আবার অন্য ভাষার জন্ম হয়; অনেক সময় আমাদের চোখের সামনেই সেটা ঘটে।
বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংস এবং যুগোস্লাভিয়ার ভাঙনের পর থেকে নতুন নতুন দেশের আবির্ভাব ঘটেছে, নিত্য নতুন ভাষার কথা শোনা যাচ্ছে--যেমন ধরা যাক: বসনিয়ান, সার্বিয়ান, এবং ক্রোয়েশিয়ান। এতদিন অবধি একে স্রেফ সার্বো-ক্রোট ভাষা ভাবা হতো। এইসব ভাষাভাষীরা ভাষার ভেতর তফাতের উপর গুরুত্ব আরোপ করে নিজেদের পার্থক্যের উপর জোর দিচ্ছে, ফারাক বাড়িয়ে তুলছে--যদিও সেটা অল্প কয়েক ডজন শব্দের বেলায়। একইভাবে চেকোস্লোভাকিয়ার চেক রিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়ায় বিভাজন চেক এবং স্লোভাক ভাষাকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে।
ফরাসী ভাষী আফ্রিকায় সরকারী ভাষা ফরাসীর স্থানীয় রূপ আবির্ভূত হচ্ছে। সেনেগাল, গ্যাবন, নাইজার এবং কোতে ডি'আইভোয়রেতে ফরাসী ভাষার কিঞ্চিৎ ভিন্ন চেহারায় কথাবার্তা চলছে। সামান্য হলেও এইসব পার্থক্য সম্ভবত ফরাসী ভাষার ভেতর ভাঙনেরই আভাস দিচ্ছে। হয়তো রোমানদের মাতৃভাষার মতো ফরাসীও এক নতুন প্রজন্মের মাতৃভাষার মতো একটা কিছুতে পরিণত হবে। একই কথা খাটে ইংরেজি, আরবী এবং স্প্যানিশের বেলায়। মাদ্রিদের স্প্যানিশ বুলি মোটেই বুয়েনেস আইরেসের স্প্যানিশের মতো নয়। আবার লন্ডন এবং বোম্বের ইংরেজির ভেতর বিস্তর ফারাক রয়েছে। রাবাতের আরবী আদৌ রিয়াদের আরবীর মতো নয়।

ভাষার রূপের উপর তার কাজের প্রভাব রয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে ব্যবহৃত ভাষাগুলো তাদের আদি রূপ থেকে ক্রমশ ভিন্ন হয়ে উঠছে। ডাকারের ওলোফ ভাষা এখন আর গ্রামীণ লোকদের ব্যবহৃত ওলোফ ভাষা নেই। বার্নাকোতে যে বাম্বারা ভাষা শোনা যায়, সেটা ২৩০ কিলোমিটার দূরের সেগুও ভাষার মতো নয় বিলকুল।
সপ্তম ও অষ্টম শতকে ভারত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপ কিংবা ক্যারিবিয়া থেকে তুলে নেওয়া দাসরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলায় সৃষ্ট যোগাযোগ সমস্যার সমাধানের ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে ক্রেয়োল ভাষাগুলো গড়ে ওঠে। ইংরেজি, ফরাসী বা পর্তুগিজ ভাষার মতো ইউরোপিয় ভাষাগুলোকে ভিত্তি করে তারা এমন কিছু ভাষা তেরি করে যেগুলো আজকের দিনে একেবারেই অন্যরকম। আদি ভাষা—ফরাসী--এক হলেও মরিশাস, হাইতি, এবং গায়ানিয়রা পরস্পরের ভাষা বোঝে না। হয়তো অভিবাসীদের সন্তানরা একদিন মেজবান দেশের ভাষার পাশাপাশি তুর্কী ভাষার জার্মানীরূপ কিংবা আরবী ভাষার ফরাসী রূপে কথা বলবে।
একটি সদা পরিবর্তনশীল ভাষার মানচিত্রে ইংরেজীও হয়তো এই প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাবে না। আজকের দিনে গোটা বিশ্বে এর দাপট অনস্বীকার্য, সম্ভবত আরও কিছুদিন সেটা চালু থাকবে। কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখা যায়, কোনো ভাষা বিশ্বব্যাপী যত বেশি বিস্তৃত হয়, ততোই এর বিভিন্ন রূপ দেখা দেয়; সুতরাং ইংরেজির ভাগ্যেও লাতিনের পরিণতি ঘটতে পারে।
এই কারণেই বিশ্বের ভাষার মানচিত্র আগামী কয়েক শতকের ভেতর নিশ্চিত বদলে যাবে।
এই মুহূর্তে গুটিকয়েক মানুষের মুখে উচ্চারিত বহু ভাষা মরতে বসেছে, নতুন ভাষা দেখা দিচ্ছে বা দেবে। তার মানে উপরে উল্লেখ করা অভিকর্ষ মডেলে ভাষা এবং তাদের কাজের বিবর্তন ঘটবে। হাইপারসেন্ট্রাল এবং সুপার সেন্ট্রাল ভাষাগুলো পাল্টে যেতে পারে এবং কিছু পেরিফেরাল ভাষা হয়তো সেন্ট্রাল হয়ে উঠবে (এবং উল্টোটিও ঘটতে পারে)।
খোদ ইতিহাসের মতো ভাষাসমূহের ইতিহাস এক জায়গায় স্থির থাকে না। এটা এগিয়ে চলে, ক্রমাগত বদলায় এবং ব্যবহারকারীদের চর্চার ভেতর দিয়ে আকার পায়।
- সূত্র: ইউনস্কো কুরিয়ার