ভারতের হাসপাতালগুলোতে শোচনীয় অবস্থা, থাকতে চাচ্ছেন না রোগীরা

দুর্বল ও অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে নয়াদিল্লির হাসপাতালগুলো থেকে চলে যাচ্ছেন রোগীরা।
তিন দিন ধরে গ্রীষ্মের প্রখর রোদের মধ্যেই ২৫ বছর বয়সী গোলডি প্যাটেল দিল্লির এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন তার স্বামীকে একটি ভালো হাসপাতালে ভর্তি করাতে যেন তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারেন।
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা গোলডিকে চারটি হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়ার পর অবশেষে একটি হাসপাতালে তার স্বামীর জায়গা হয়। কিন্তু সরদার প্যাটেল কোভিড কেয়ার সেন্টারের অস্থায়ী বন্দোবস্ত ও চিকিৎসার মান এতটাই বাজে যে তার স্বামী সদানন্দ এখন সেখান থেকে তাকে সরিয়ে নেয়ার আকুতি জানাচ্ছেন।
৩০ বছর বয়সী সদানন্দ প্যাটেলের আশেপাশে মানুষ মারা যাচ্ছে। হাসপাতালের কোনো ডাক্তার তার কাছে আসছেন না বললেই চলে এবং ওষুধও পাচ্ছেন সীমিত। সদানন্দের ফুসফুসের ৮০ শতাংশই ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে এবং সামনের দিনগুলোয় নিজের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে কি করবেন তা ভেবে তিনি আতঙ্কিত।
গেল শনিবার হাসপাতালে নিজের বিছানায় শুয়ে সদানন্দ বলেন, 'আমি খুবই ভীত। আমার মনে হয়, শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে কেউই আমাকে বাঁচাতে পারবে না।' কথা বলার সময়ও তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বেসামাল হয়ে পড়েছে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। অক্সিজেন, শয্যা, স্বাস্থ্যকর্মী সবকিছুই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কিছু ক্লিনিক বা প্রচন্ড জনাকীর্ণ হাসপাতালের বাইরে ডাক্তার আসার আগেই ওয়েটিং রুমেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন রোগীরা।
অনেক ঝক্কি পোহানোর পর কিছু কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও, হাসপাতালের ভেতরে নতুন এক আতঙ্কের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। আর সেটি হলো চিকিৎসা সুবিধা বা সরবরাহ না পাওয়া।
সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ফেব্রুয়ারিতে কর্তৃপক্ষ সরদার প্যাটেল কোভিড কেয়ার সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করে, কারণ তারা ভেবেছিল যে ভারত করোনাকে জয় করে ফেলেছে। কিন্তু দৃশপট যখন ভিন্নরূপে দেখা গেল, তখন চলমান বিভীষিকা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে ২৬ এপ্রিল ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল আবার খুলে দেয়া হয়।
কিন্তু স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, হাসপাতালের লম্বা লাইন থাকার পরেও হাসপাতালের ধারণক্ষমতার চাইতে অনেক কম রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ইন্দো-তিব্বতীয় সীমান্ত পুলিশের যেসব সিনিয়র কর্মকর্তা এই হাসপাতালটি চালান, সিএনএন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে তারা কোনো সাড়া দেননি।
সদানন্দকে হাসপাতাল খোলার পরদিনই ভর্তি করা হয়, কিন্তু এর কয়েকদিন পরেই হাসপাতালে ভিড় জমে যায় বলে জানালেন গোলডি।
গর্তের মত ও ওয়্যারহাউজ ধরনের একটি স্থানে কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো খাটে শুয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে কিছু রোগীকে।
সদানন্দ জানান, তিনি তিনদিনে মাত্র একবার বা দুইবার ডাক্তারের দেখা পেয়েছেন। তিনি পাশের শয্যার দুইজন ব্যক্তিকে দেখেছেন তাদের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ার পর চিৎকার করে ওষুধ চাইতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মারা গিয়েছেন।
মঙ্গলবার ভর্তি হওয়া সদানন্দ শনিবারের মধ্যেই তার আশেপাশে পাঁচজনকে মারা যেতে দেখেছেন। সরিয়ে নেওয়ার আগপর্যন্ত একজনের লাশ তার ঠিক পাশেই পড়ে ছিল কয়েক ঘন্টা।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় গত মাসে জানিয়েছে যে তারা হাসপাতালকে অক্সিজেন সরবরাহ সহ ২০০০ শয্যায় উন্নীত করবেন। সেই সাথে ৪০ জন ডাক্তার ও ১২০ জন বিশেষজ্ঞ প্যারামেডিক ইতিমধ্যেই ওই সেন্টারে পৌঁছেছেন বলে জানান তারা।
কিন্তু সদানন্দর অভিজ্ঞতা সেই কথা বলে না। তিনি মনে করেন, সরকার ভাবছে যে হাসপাতাল খুলে দিয়েছি মানেই সবাই সেবা পাচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়। এখানে ডাক্তার ডাকার কেউ নেই বলেই আপনি এখানে পড়ে মারা যাবেন।

শুধু সদানন্দই নন, অন্যরাও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। সারিতা সাক্সেনা শুক্রবার সিএনএনকে বলেন, ৭ টি হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়ার পর তার বোনের স্বামীকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করাতে পেরেছেন। তিনি মনে করেন, ডাক্তাররা সবাইকে চিকিৎসা দিচ্ছেনই না। কোভিড রোগীদের একমাত্র যত্ন এখন তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবেরাই করছেন। সেই সাথে মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় তাদেরও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে হাসপাতালের বাইরে প্রতি মুহূর্তে দুঃসহ ও ভীতিকর সময় আর করছেন রোগীর স্বজনরা।
সদানন্দ জানালেন, তিনি এতটাই ভয় পেয়েছেন যে তিনি ডাক্তার ও নিজের স্ত্রীর কাছে বারবার অনুরোধ করেছেন তাকে অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নিতে। কিন্তু তার স্ত্রী গোলডি বললেন, আর কোথাও জায়গা নেই।
গোলডি তার স্বামীকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে এখানে থাকলেই তিনি অক্সিজেন পাবেন এবং সুস্থ হয়ে উঠবেন।
কমে আসছে অক্সিজেন সরবরাহ
উত্তর প্রদেশের একটি শহর মীরুতের লালা লাজপত রাই মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ এখন রোগীতে প্লাবিত বলা চলে।
স্ট্রেচার, টেবিল, মেঝেতে-সব জায়গায় শুধু মানুষ আর মানুষ, সবাই ব্যাকুল হয়ে অক্সিজেন চাইছে। হাসপাতালের কর্মীরা জানালেন, ১০০ জন রোগীর জন্য ৫৫ টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু ডাক্তার রয়েছে মাত্র ৫ জন। কিছু রোগী হাসপাতালের মেঝেতেই শুয়ে আছেন।
দুই সন্তানের জননী, ৩২ বছর বয়সী কবিতা এখানের রোগীদের একজন। চারদিন ধরে তিনি হাসপাতালের মেঝেতে আছেন এবং তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনেই ২০ জনের মৃত্যু দেখলেও এখনো পর্যন্ত কবিতা কোনো অক্সিজেন পাননি। তিনি মনে করছেন, যেকোনো সময় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হতে পারে।
ভারতজুড়ে অক্সিজেন সংকট এখন মূল সমস্যা। গত এক সপ্তাহে ভারত ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন আক্রান্তের রেকর্ড করেছে।
বাইরের দেশগুলো থেকে অক্সিজেন সাহায্য পাঠানো হচ্ছে ভারতকে। তবে এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সারাদেশে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানিয়ে মন্ত্রণালয় বলে, ভারতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে, আতঙ্কিত হবার কারণ নেই।
একটি হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে হর্ষ বর্ধন বলেন, 'অক্সিজেন আগেও ছিল, এখন আরো আছে। আমাদের দেশে অক্সিজেনের অনেক উৎস রয়েছে। যারই অক্সিজেন প্রয়োজন হবে, সে পাবে।'
কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালগুলো এখনো সংগ্রাম করে চলেছে।
কিছু হাসপাতাল থেকে এসওএস টুইট বার্তায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাউন্ট ট্যাগ করে আকুতি জানানো হয়েছে যেন তাদেরকে আরো অক্সিজেন দেয়া হয়।
অক্সিজেন রিফিলিং সেন্টারগুলোতে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার হাতে রোগীদের স্বজনদের ভিড় লেগেই আছে। অক্সিজেন না থাকায় শনিবারও দিল্লীতে এক ডাক্তারসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান বাট্রা হাসপাতালের ডাক্তার এসসিএল গুপ্ত।
কিছু হাসপাতালে আগে থেকেই সতর্কবাণী দিয়ে দেয়া হয়েছে যে রোগী ভর্তি করাতে হলে নিজ দায়িত্বে অক্সিজেন এনে দিতে হবে।
শনিবার উত্তর দিল্লির পাঁচশীল হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার পুনম গয়াল বলেন, 'আমরা রোগীদের বলে দিয়েছি জরুরি ভিত্তিতে রোগী ভর্তি করাতে হলে নিজেদেরই অক্সিজেন জোগাড় করতে হবে।'
তবে এলএলআরএম হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডাক্তার জ্ঞানেন্দ্র কুমার জানিয়েছেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন আছে কিন্তু তাদের কর্মী সংখ্যা কম। তারা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
ওষুধের ঘাটতি
স্বামী অক্সিজেন পেয়েছেন বলে গোলডি প্যাটেল খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেও তিনি তার স্বামীর সার্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত। ওষুধ ছাড়া তার ফুসফুসের ক্ষতি সারানো সম্ভব হবেনা।
গোলডির স্বামী যখনই উঠে বসছেন, তখনি গুরুতরভাবে কাশতে শুরু করছেন এবং বুকে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে বলে জানান তিনি। হাসপাতাল থেকে সামান্য খাদ্য, পানি ও অক্সিজেন দেয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু গোলডি নিজেকে হত্যা করার হুমকি দেয়ার পর তার স্বামীকে ওষুধ এনে দেয় হাসপাতালের কর্মীরা। শুক্রবারেও গোলডি তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তার স্বামীর জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছিলেন সেন্টার থেকে।
নয়াদিল্লির মাধুকর রেইনবো চিলড্রেন'স হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ক্রিটিক্যাল কেয়ার-এর প্রধান সিনিয়র কনসালটেন্ট, ডাক্তার চন্দ্রশেখর সিংহ বলেন, 'একজন রোগীর যদি ফুসফুসের ৮০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে তাকে অক্সিজেনের পাশাপাশি অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সুস্থ করে তুলতে হবে। অক্সিজেন দিয়ে আপনি শুধু কিছুটা সময় কিনছেন তার বেঁচে থাকার। সত্যিকার অর্থে ৮০ ভাগ ফুসফুসের ক্ষতি কোন ভাল লক্ষণ নয়।'
প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টা অন্তর, গোলডি তার স্বামীকে ডাকেন। তার নিঃশ্বাসের সমস্যা শুরু হবার আগে তারা দুয়েক মিনিট কথা বলতে পারেন।
সাত মাসের অন্তসত্ত্বা গোলডি নিজেকে নিয়েও ভীত। তিনি জানেন না তারও করোনা হয়েছে কিনা, তার কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি এখনো। করোনা পরীক্ষা করাতে ৯০০ রূপি লাগে বলে তিনি পরীক্ষাও করাননি। তবুও তিনি মনে করেন, তার স্বামীর পাশে তাকে দাঁড়াতেই হবে। তাদের দুজনের মা-বাবাই উত্তর প্রদেশে থাকেন, তাই তাদের সাহায্য করারও কেউ নেই।
গোলডি ও তার স্বামী সদানন্দ, দুজনেই সরকার ও কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা ও অদক্ষতা নিয়ে হতাশায় ভুগছেন।
সদানন্দ জানান, তিনি যদি হাসপাতালেই ভাল চিকিৎসা পেতেন তাহলে তার নিজের অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে এখানে জড়াতে হতো না। স্ত্রীও যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তখন কি হবে তা ভেবে তিনি আরো শঙ্কিত।
- সূত্র: সিএনএন