শুধু ইরান নয়, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউক্রেনও ভূপাতিত করেছে যাত্রীবাহী বিমান

ভুল করে হোক বা ইচ্ছাকৃত হোক, যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা বিশ্বের অনেক দেশই ঘটিয়েছে। সে তালিকা আরও লম্বা হলো ইরানের ছোঁড়া মিসাইলের আঘাতে ১৭৬ যাত্রী নিয়ে ইউক্রেনের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায়।
৩০ বছর আগে ১৯৮৮ সালেও এমন ঘটনার শিকার হয়েছিল ইরানের এয়ারলাইনস। সেসময় পার্সিয়ান উপসাগরের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোঁড়া মিসাইলের আঘাতে ২৯০ জন যাত্রী নিয়ে ভূপাতিত হয় ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান। ওই দুর্ঘটনায় বিমানের সব যাত্রী মারা যান।
অপরদিকে ২০০১ সালে সাইবেরিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমানকেও ৭৮ যাত্রীসহ ভূপাতিত করে ইউক্রেন।
যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ইতিহাস শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। সেবার ১৭ যাত্রীসহ চীনের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে জাপান।
গত আট দশকে বিমান ভূপাতিত করার আলোচিত ১০টি ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত দেড় হাজার যাত্রী ও বিমানের ক্রু'র।
ওই ঘটনাগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
২০১৪: মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস

২০১৪ সালের জুলাইয়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকা থেকে রাশিয়ার ছোঁড়া মিসাইলের আঘাতে ২৯৮ জন যাত্রীসহ মালয়েশিয়ান একটি বিমান ভূপাতিত হয়।
এই অঞ্চলটিতে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সংঘাতের মধ্যেই এই মিসাইল ছোঁড়ে রাশিয়া।
ওই ঘটনায় রাশিয়া বারবার নিজেদের দায় অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক তদন্তকারীদের একটি দল এ ঘটনায় রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার তিন কর্মকর্তাসহ মোট চারজনের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে।
২০০১: সাইবেরিয়ান এয়ারলাইনস
২০০১ সালের ৪ অক্টোবর ইসরাইলের তেল আবিব থেকে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় নভোসিব্রিস্ক শহরের উদ্দেশ্যে ৭৮ জন যাত্রীসহ যাত্রা করা একটি বেসামরিক বিমানকে কৃষ্ণসাগর এলাকায় ভূপাতিত করে ইউক্রেন।
তদন্ত শেষে ইউক্রেনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি স্বীকার করেন, রাশিয়ান এই বিমানটি তার দেশের সামরিক বাহিনী দুর্ঘটনাবশত ভূপাতিত করেছে।
১৯৮৮: ইরান এয়ার ফ্লাইট

১৯৮৮ সালে পার্সিয়ান উপসাগরের কাছে দ্য ইউএসএস ভিনসেন্স নামে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোঁড়া মিসাইলের আঘাতে ইরানি একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত হয়।
ওই ঘটনায় বিমানের ২৯০ জন যাত্রী ও ক্রু সবাই মারা যান। মার্কিন সেনাবাহিনী সে সময় দাবি করেছিল, তারা ইরানি যুদ্ধ বিমান ভেবে 'ভুল করে'ওই যাত্রীবাহী বিমানটিকে ভূপাতিত করে।
১৯৮৩: কোরিয়ান এয়ারলাইনস
১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে কেএএল ০০৭ নামে কোরিয়ান এই বিমানটি পথ ভুল করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশে ঢুকে পড়লে একটি যুদ্ধবিমান এটিকে ভূপাতিত করে। কোরিয়ান ওই বিমানটির ২৬৯ জন যাত্রী এবং ক্রু'র সবাই নিহত হন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসময় দাবি করেছিল, বিমানটি ছিল গুপ্তচরবৃত্তির মিশনের। তবে তা অস্বীকার করেছিল, কোরিয়ার তৎকালীন মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলে ওখোৎস্ক সাগরে বিমানটির ব্ল্যাকবক্সের খোঁজে নেমেছিল। তবে সেটি আর উদ্ধার করতে পারেনি এই তিন দেশ।
১৯৮০: ইতাভিয়া ফ্লাইট
১৯৮০ সালের ২৭ জুন ৮১ জন যাত্রী নিয়ে ইতালির বলোগনা থেকে সিসিলিতে উড়ে যাচ্ছিল এই বিমানটি। দেশটির তিরহেনিয়ান সাগরের ছোট্ট দ্বীপ উস্টিকার কাছাকাছি এলে হঠাৎ করেই সাগরের পানিতে আছড়ে পড়ে সেটি। এ নিয়ে ইতালির সামরিক বাহিনীতে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের।

ওই তত্ত্বগুলোর একটিকে স্বীকার করে ঘটনার ৩৩ বছর পর ২০১৩ সালে এসে দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয় ইতালির সর্বোচ্চ আদালত।
আদালত স্বীকার করে নিয়েছিল, ইতালীয় যুদ্ধজাহাজ থেকে ছোঁড়া একটি মিসাইল বিমানটিকে আঘাত করেছিল। তবে মিসাইলটি কারা ছুঁড়েছিল তা বলেনি আদালত।
১৯৭৮: এয়ার রোডেশিয়া
১৯৭৯: এয়ার রোডেশিয়া
এই দুটি উড়োজাহাজকেই উড্ডয়নের মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় ভূপাতিত করেছিল তৎকালীন রোডেশিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী। রোডেশিয়ার বর্তমান নাম জিম্বাবুয়ে।
এই দুটি বিমানেই সোভিয়েত নির্মিত স্ট্রেলা মিসাইল দিয়ে আঘাত হানা হয় বলে ধারণা করা হয়েছিল। এ দুটি দুর্ঘটনায় প্রায় শতাধিক লোক মারা গিয়েছিল।
১৯৭৩: লিবিয়ান আরব এয়ারলাইনস
১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে বেনগাজি হয়ে মিসরের কায়রো যাওয়ার পথে সিনাই মরুভূমির ওপর লিবিয়ার এই যাত্রীবাহী বিমানটিকে ভূপাতিত করে ইসরাইলি একটি যুদ্ধবিমান। ওই দুর্ঘটনায় বিমানের ১১৩ জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র পাঁচজন ছাড়া সবাই নিহত হন।

ইসরাইল দাবি করেছিল, ওই বিমানটি সিনাই অঞ্চলের তাদের একটি সামরিক এলাকার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলো। সন্ত্রাসবাদী হামলার সম্ভাবনা থাকতে পারে এমন ভাবনা থেকেই বিমানটি ভূপাতিত করা করা হয়েছিল বলে দাবি তাদের।
১৯৫৫: এল আল ফ্লাইট, ইসরাইল
১৯৫৫ সালের ২৭ জুলাই লন্ডন থেকে এল আবিবে ফেরার পথে ইসরাইলি একটি যাত্রীবাহী বিমান ঝড়ের কবলে পড়ে বুলগেরিয়ার আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে। এর পরপরই বুলগেরিয়ান একটি যুদ্ধবিমান ইসরাইলি যাত্রীবাহী বিমানটিকে ভূপাতিত করে। এতে ওই বিমানের ৫৮ যাত্রীর সবাই নিহত হন।
পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ বুলগেরিয়া ইসরাইলকে দুই লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়।
১৯৫৪: ক্যাথে প্যাসিফিক ভিআর-এইচইইউ, যুক্তরাজ্য
১৯৫৪ সালের ২৩ জুলাই ব্রিটেনের অধীনে থাকা হংকং থেকে উড্ডয়নের পর ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের একটি ব্রিটিশ বিমানকে আরেকটি যুদ্ধ বিমান থেকে গুলি ছুঁড়ে ভূপাতিত করে চীন।
ওই হামলায় বিমানটির ১৮ যাত্রীর মধ্যে ১০ জন নিহত হন। এ ঘটনায় পরবর্তীকালে দুঃখপ্রকাশ করে এবং ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে চীন বলেছিল, তাইওয়ানিজ একটি যুদ্ধবিমান ভেবে ভুল করে ওই বিমানটিকে ভূপাতিত করেছে তারা।
চীনের ওই দুখঃপ্রকাশের পর ওই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া এক পদক্ষেপে। দুর্ঘটনায় জীবিতদের উদ্ধার করতে গিয়ে আরও দুটি চীনা যুদ্ধ বিমানকে ভূপাতিত করে দেয় মার্কিনিরা।
১৯৩৮: কুয়েইলিন দুর্ঘটনা, চীন
যুদ্ধবিমান দিয়ে যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা ইতিহাসে এটিই প্রথম। চীন এবং জাপানের মধ্য তখন যুদ্ধ চলছিল। ১৯৩৮ সালের ২৪ আগস্ট হংকং থেকে চীনের চেংডুতে যাওয়ার পথে ঝংসান নামে একটি অঞ্চলের আকাশে যাত্রীবাহী এ চীনা বিমানটি ভূপাতিত করে পাঁচটি জাপানী যুদ্ধবিমান।
এ ঘটনায় জাপানি যুদ্ধবিমান থেকে মেশিনগানের ছোঁড়া গুলির আঘাতে ১৪ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। বিমানটির পাইলটসহ মাত্র তিনজন ওই হামলায় বেঁচে যান।