বাইডেনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোসেফ বাইডেন। দ্বিখণ্ডিত আমেরিকান জাতির একাংশের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাই জয় এনে দিয়েছে তাকে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে বাইডেন সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী নন, তিনি তা জানতেন। নির্বাচনে জিততে হলে উদারনৈতিক ও কেন্দ্রপন্থী সবার সমর্থনই প্রয়োজন, তাও জানতেন। এই জয় তার সমর্থকদের জন্য যেমন আনন্দের, সেইসঙ্গে স্বস্তিরও। তবে শেষ পর্যন্ত বাইডেন জিতে গেলেও নির্বাচনের ফলাফলে মার্কিন নাগরিকদের মিশ্র বার্তাই পাওয়া যায়।
পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিনসহ ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে বাইডেন জয় পেলেও, ভোটের ব্যবধান খুব বেশি নয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। তবে একইসঙ্গে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়েছেন ট্রাম্পও। তার মানে, বর্তমান প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থা হারায়নি তার বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী ।
জয়লাভের পরই নতুন নীতি প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন। ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতেই শুধু ভোটের ব্যবধান কম ছিল, এমন নয়; সিনেট নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাটরা খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। বড় কোনো আইন প্রণয়ন বা বিল পাসের জন্য সিনেট সদস্যদের সহায়তা পেতে বাইডেনকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়।
২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারণা ও ফলাফলে স্পষ্ট বোঝা গেছে, দেশজুড়ে ট্রাম্প এখনো কতটা জনপ্রিয়, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে। তারা দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের মধ্যেই নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন, যিনি তাদের মতো করেই তাদের কথা বলতেন। ট্রাম্পই ছিলেন এই জনগোষ্ঠীর নতুন আশ্রয়স্থল।
এখনো নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করে নেননি ট্রাম্প, আইনি লড়াই চালানোর কথা জানিয়েছেন। এরফলে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর তেমন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও, বাইডেন ক্ষমতাগ্রহণের পর তার বিভিন্ন কাজ কিছুটা কঠিন হয়ে যেতে পারে। এখনো হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ১০ সপ্তাহ সময় আছে; প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তার বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী তার পাশেই থাকবে। টুইটার বার্তা ও র্যালির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে ট্রাম্পের থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
আমেরিকান জাতির এই বিভক্তির মধ্যেই কাজ করতে হবে বাইডেনকে। ওয়াশিংটনে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার চেষ্টাও করতে পারেন তিনি। রিপাবলিকানরা বাইডেনের সঙ্গে কাজ করবে, এমন ধারণা হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবেন অনেক ডেমোক্র্যাট সমর্থক; আবার অনেকে মনে করেন, সিনেটে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণেই সহজেই তিনি রিপাবলিকানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবেন।
সেইসঙ্গে নিজ দলের একাংশের চাপের মুখেও পড়বেন বাইডেন। স্বাস্থ্যনীতি ও পরিবেশ সংক্রান্ত তার প্রস্তাবিত নীতির বিরোধী উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে নির্বাচনে হারানোর জন্যই এ যাত্রায় বাইডেনকে সমর্থন করেছেন।
নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাড়ানো ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, 'বাইডেনকে নির্বাচিত করাই শেষ কাজ নয়, এটিই শুরু।' নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তার তরুণ ও প্রগতিশীল সমর্থকদের বাইডেনকে ভোট দেওয়ার জন্যও প্রচারণা চালান বার্নি।
বাইডেনের জয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার ব্যাপারে নতুন নীতি প্রণয়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আরও এক মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে উদ্ভূত পরিণামের ব্যাপারে ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার পুরো সময়জুড়ে সতর্ক করেছেন বাইডেন । এর ফলে জাতি হিসেবে আমেরিকানদের পরিচয় আমূল বদলে যাবে, এমন আশঙ্কার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
নির্বাচনী বিতর্কে বাইডেনের বক্তব্যের একাংশ ছিল ভোটারদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়ের বিষয়-আশয়। ট্রাম্প যখনই তাকে কট্টর বামপন্থী বা দুর্নীতিগ্রস্ত অপরাধী বলেছেন, বাইডেন স্রেফ দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, 'আপনারা আমাকে চেনেন।'
বেশিরভাগ আমেরিকানের ওপর ট্রাম্পের নীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে মহামারির সময়। দেশটিতে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন; নতুন অর্থনৈতিক ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বাইডেন জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, মহামারি মোকাবেলার ব্যাপারে নিজস্ব পদ্ধতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। মহামারির স্বাস্থবিধি মেনেই সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প নিজেও কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হন।
বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারি সারা বিশ্বের মতো আমেরিকানদের জীবনেরও সকল ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। শিগগিরই মহামারি মোকাবেলার দায়িত্ব পড়বে বাইডেনের ওপর। নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কঠিন কিছু কাজের দায়িত্ব পড়বে তার ওপর। ইতোপূর্বে ১৯৩৩ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট মহামন্দার সময়ে নির্বাচিত হন।
তবে এ মুহূর্তে জয়ের আনন্দ উদযাপন করতেই পারেন বাইডেন। তার দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে ইতোপূর্বেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পদে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১৬ সালে মনোনয়ন পাওয়ার আগে নিজেই সরে দাঁড়ান। বলা যায়, ট্রাম্পের জন্যই আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে এসেছেন তিনি। ট্রাম্পের কারণেই তার প্রচারণা প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে; তাকে জিততে সাহায্যও করেছেন ট্রাম্পই।
- সূত্র: এপি