পাকিস্তানে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ আবার শুরু হচ্ছে, ১১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে মোট ১১ বিলিয়ন ডলারের কয়েকটি প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' প্রকল্পটির নতুন সম্ভাবনার পথ তৈরি হয়েছে।
গত ২৫শে জুন স্বাক্ষরিত হয় ৩.৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কাশ্মীরের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পের চুক্তি। ৬ জুলাই স্বাক্ষরিত হয় উপনিবেশিক সময়ে গড়ে ওঠা রেলপথের সংস্কারের চুক্তি। এই চুক্তিটির মূল্যমান ৭.২ বিলিয়ন ডলার, এটিই পাকিস্তানে চীনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের প্রজেক্ট।
গতবছর ইমরান খানের সরকার কর্তৃক 'চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর' (সিপেক) প্রজেক্টের দায়িত্বে নিয়োজিত হন আসিম সালীম বাজওয়া। ইমরান খানের দায়িত্বকালে পাকিস্তানের স্তিমিত হয়ে পরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন সচল হয় অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট জেনারেলের সিপেকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর। গত এপ্রিলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
পাকিস্তানের রপ্তানি কার্যক্রমের ও বড় কিছু শহরের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণে সাহায্য করেছে চীনের বিনিয়োগ প্রকল্প। ইমরান খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে কোনো প্রকল্পের উদ্যোগ না নেয়ায়, বিনিয়োগকৃত অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন থেমে ছিল।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০১৩ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের কাজ শুরুর পর, বিশ্বজুড়ে ৫৭৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়েছে, কিছু প্রকল্পের কাজ এখনো চলছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন তাদের রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থে দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলছে এমন অভিযোগের পর থেকে এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি কিছুটা কমে গেছে।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের কর্মকর্তা জোনাথন হিলম্যান বলেন, "প্রকৃতপক্ষে সিপেকের বেশিরভাগ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের বাস্তবায়নে পাকিস্তান গুরুত্ব বহন করে বিধায় উন্নয়ন হচ্ছে তার প্রচারই বেশি জরুরী।"
সিপেকের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে এই ধারণা ভুল দাবী করে আসিম বাজওয়া গতমাসে টুইটারে আরও লিখেন, বর্তমানে সিপেকের বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজের গতি বেড়েছে, সেই সাথে নতুন আরও দুটি বড় প্রোজেক্ট শুরুর কাজ চলেছে। এর অংশ হিসেবে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে বলে উল্লেখ করেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা আবদুল রাজাক দাঊদ এ বিষয়ে বলেন, "আমরা মনে করি আমাদের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনেক। প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পের কাজে জোর দিয়েছেন।"
অগ্রগতির অভাব
চীনের সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড় থেকে গোয়াডার মরুভূমির অঞ্চলসহ চীনা বিনিয়োগের সবকয়টি প্রকল্পের নিরাপত্তার কাজে সেনাবাহিনী নিযুক্ত আছে। গত বছর চীনের ৩টি প্রকল্পের আওতাধীন জায়গায় সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে।
ইসলামাবাদের তাবাদল্যাবের ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন পরামর্শদাতা মোশাররফ যায়িদি বলেন, "এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সিপেকের প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ইমরান খানের ক্ষমতাগ্রহণের প্রভাব আছে। "
পাকিস্তানের এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে। দ্য সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট চীনের এই প্রকল্পের কারণে বড় ঋণ সংকটে পড়তে পারে এমন শীর্ষ ৮ টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে। পাকিস্তানও আছে এই তালিকায়।
গত বছর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএম) এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আই এম এফের কাছ থেকে পাকিস্তানের নেয়া ঋণের থেকেও দ্বিগুণের বেশি চীনকে পরিশোধ করতে হবে দেশটিকে আগামী ৩ বছরে।
তবে, গত ৬ বছরে পাকিস্তানে প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতি হয়েছে দাবী করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজান বলেন, সিপেকের অগ্রগতি ও লক্ষ্য অর্জনে পাকিস্তানের সাথে কাজ করতে চীন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গত ৭ জুলাই বেইজিং এ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, "অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি
জীবনযাত্রা, শিল্প- কৃষি, সামাজিক উন্নয়ন-ই হবে আগামীর লক্ষ্য। "
আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২টি প্রকল্পের স্থানই কাশ্মীর। বর্তমানে কাশ্মীরের ভারতীয় অংশ জম্মু কাশ্মীরে রাজ্যটিকে ভেঙে দেওয়াকে কেন্দ্র করে সংকট চলছে।
২.৪ ও ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটির কাজ চলবে মুজাফফরবাদের জেহলুম নদীতে। প্রকল্পের জায়গা থেকে ৬০ মাইল দূরেই উভয় দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলিবর্ষণ চলে।
চীন ও পাকিস্তান ভারতকে বিপাকে ফেলতে পারে মন্তব্য করে জোনাথন হিলম্যান বলেন, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটিও কাশ্মীরে, রেলপথ সংস্কারের প্রকল্পও দেশ দুটিকে রেলপথে সংযুক্ত করার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।"
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কারণে বেশ কয়েকটি দেশ সমস্যায় পড়েছে। দুর্নীতি, ঋণ সংকট, পরিবেশ বিপর্যয়, চীনের শ্রমবাজার প্রাধান্য পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেক দেশ প্রকল্পের পরিকল্পনা বদলেছে।
রেলপথ সংস্কার প্রকল্পের পূর্ব মূল্য ছিল ৮.২ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের দরকষাকষির পর প্রকল্পের প্রাথমিক মূল্য আগের চেয়ে আগের চেয়ে ১ বিলিয়ন কমে।
নতুন প্রকল্পগুলোর ঘোষণার আগে থেকে বিষয়টি অনেকদিন ধরে আলোচনাধীন ছিল।
সূত্র: আলজাজিরা