আইভারমেকটিন: যেভাবে ভুয়া বিজ্ঞান তৈরি করল কোভিডের 'মিরাকল' ওষুধ

বেশ কয়েক বছর ধরেই মানুষ ও পশুদের রোগ সারাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরজীবী-নিরোধক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আইভারমেকটিন।
কিন্তু মহামারি চলাকালে কেউ কেউ এই ওষুধটির কথা উল্লেখ করেছেন অন্য একটি উদ্দেশ্যে—কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই ও মৃত্যু প্রতিরোধে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অবশ্য কোভিডের বিরুদ্ধে এই ওষুধ ব্যবহারের খুব বেশি প্রমাণ খুঁজে পায়নি। কিন্তু তারপরও হাজারো সমর্থক, বিশেষত যারা ভ্যাকসিন-বিরোধী, তারা এই ওষুধের পক্ষে তুমুল প্রচারণা চালিয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপগুলোয় অনেককেই দেখা গেছে টিপস দিতে যে কীভাবে এই ওষুধটি হাতে পাওয়া যাবে। অনেকে আবার আরো এক কাঠি সরেস। তারা সরাসরি পশুদের ব্যবহার্য সংস্করণটি মানুষের উপর প্রয়োগেরও পরামর্শ দিয়েছে।
মূলত গবেষণার শক্তির উপর ভিত্তি করেই আইভারমেকটিনকে কেন্দ্র করে এত বিপুল পরিমাণ উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ এটি ব্যবহারও করেছে।
এই ওষুধের পক্ষে প্রচারণা চালানো অনেকেই কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা বারবার উল্লেখ করছে, এবং বলছে যে সেসব প্রমাণকে হয় অগ্রাহ্য করা হচ্ছে নয়ত গোপন করা হচ্ছে। কিন্তু স্বাধীন বিজ্ঞানীদের একটি দলের করা রিভিউ ওইসব পূর্ববর্তী গবেষণার উপর সন্দেহ আরোপ করেছে।
বিবিসি জানাচ্ছে, কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যকারিতার ব্যাপারে ওষুধটির যে ২৬টি বড় ট্রায়াল হয়েছে, তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেই সাংঘাতিক ত্রুটি কিংবা সম্ভাব্য জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। এবং বাকি গবেষণাগুলোর কোনোটিও আইভারমেকটিনের কার্যকারিতার ব্যাপারে শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উত্থাপন করতে পারেনি।
গবেষণাটির তদন্তকারী দলটির অন্যতম সদস্য ড. কাইল শেলড্রিক জানিয়েছেন, তারা 'এমন একটিও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল'-এর হদিস পাননি, যেগুলোতে কোনো প্রকার অতিরঞ্জন কিংবা বড় ধরনের ত্রুটি ব্যতিরেকেই প্রমাণ দেখানো হয়েছে যে আইভারমেকটিন আসলেই কোভিডজনিত মৃত্যু প্রতিরোধে সক্ষম।
অন্যান্য বড় ধরনের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- একই রোগীর তথ্য-উপাত্ত একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নাম দিয়ে
- প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত রোগীদের পরীক্ষার জন্য র্যান্ডমভাবে বাছাই করা হয়নি
- যে সংখ্যক রোগীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা স্বাভাবিকভাবে হতে পারে না
- শতাংশের হিসাব করা হয়েছে ভুলভাবে
- স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরগুলোও এই গবেষণার ব্যাপারে অবগত নয়
তদন্তকারী গোষ্ঠীতে যে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, তারা হলেন - ড. গিডিওন মেয়েরোউইজ-ক্যাটজ, ড. জেমস হিথার্স, ড. নিক ব্রাউজ ও ড. শেলড্রিক। তাদের প্রত্যেকেরই অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে বৈজ্ঞানিক জালিয়াতি উদঘাটনের। মহামারি চলাকালীন তারা একত্রে কাজ করছেন অনানুষ্ঠানিকভাবে, স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে।
তবে আইভারমেকটিন প্রত্যক্ষভাবে মানুষের খুব বড় কোনো ক্ষতি না করলেও, পরোক্ষভাবে অনেক বড় ধরনের ক্ষতিরই কারণ হতে পারে। কেননা এটি অনেক মানুষকেই ভুল আশা ও নিরাপত্তাবোধের অনুভূতি দেয়, যার ফলে কোভিড আক্রান্ত হলে তারা হয়তো হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে এই ওষুধটি সেবন করে। আবার কেউ কেউ হয়তো এই ওষুধের প্রতি বিশ্বাসের ফলে ভ্যাকসিনই নেয় না।
বায়োমেডিকেলের শিক্ষার্থী জ্যাক লরেন্স মিশরের একটি প্রভাবশালী গবেষণায় কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেন। এরপরই উল্লিখিত বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে একটি দল গঠন করেন আইভারমেকটিন বিষয়ক গবেষণাগুলোকে গভীরভাবে খতিয়ে দেখার জন্য।
লরেন্সের ভুল ধরা সেই গবেষণাটিতে দেখা গেছে, সেখানে এমন সব রোগীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা ট্রায়াল শুরুর আগেই মারা গেছেন। পরবর্তীতে ওই গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশকারী জার্নালের পক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
স্বাধীন বিজ্ঞানীদের দলটি আইভারমেকটিন ও কোভিডের উপর প্রায় সকল র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল (আরসিটি) নিরীক্ষা করে দেখেছেন। ওষুধ প্রচারণাকারীরা রেফারেন্স হিসেবে যেসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কথা উল্লেখ করেছে, সেগুলোও বাদ দেননি তারা।
দলটি ছয়টি আলাদাভাবে করা প্রভাবশালী পর্যবেক্ষণ ট্রায়ালও খতিয়ে দেখেছে। এ ধরনের ট্রায়ালে সেইসব মানুষদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যারা নিজের ইচ্ছায় ওষুধ সেবন করে। ফলে তাদের বক্তব্য পক্ষপাতদুষ্টও হতে পারে।
মোট যে ২৬টি ট্রায়ালের নিরীক্ষা করা হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি এমন ছিল যেগুলোতে উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুয়া ছিল।
এছাড়া পাঁচটি ট্রায়ালও বিজ্ঞানীদের মনে বড় ধরনের সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়, কেননা সেগুলোতে সকল রোগীর সংখ্যা যোগ করা হয়নি, শতাংশও ভুলভাবে হিসাব করা হয়েছে, কিংবা স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানতই না যে এ ধরনের কোনো গবেষণা হচ্ছে।
এই ত্রুটিপূর্ণ ট্রায়ালগুলোর পাশাপাশি, গবেষণা নিবন্ধের এমন ১৪ জন লেখককেও পাওয়া গেছে, যারা তথ্য-উপাত্ত ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বাধীন দলটি একেও সম্ভাব্য জালিয়াতির সংকেত হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
স্বাধীন দলটি যেসব গবেষণা নিবন্ধের নমুনা নিরীক্ষা করেছে, তার মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কিছু উচ্চমানের গবেষণাও ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যেসব গবেষণা নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে যে আইভারমেকটিনের মাধ্যমে কোভিডজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব, সেগুলো সবই ভুয়া কিংবা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণের অভাবে অগ্রহণযোগ্য।
এ কথা অবশ্যই সত্য যে কোনো ট্রায়ালেই কিছু হিউম্যান এরর বা মানবসৃষ্ট ত্রুটি সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া যায় না। তারপরও মেডিকেল চিকিৎসক ও সিডনির ইউনিভার্সিটি অভ নিউ সাউথ ওয়েলসের গবেষক ড. শেলড্রিক বিশ্বাস করেন, প্রায় নিশ্চিতভাবেই ট্রায়ালগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে জেনে-বুঝে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে।
লেবাননের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১১ জন চিকিৎসকের তথ্য-উপাত্তই বারবার কপি-পেস্ট করা হয়েছে, যার অর্থ, ট্রায়ালে আসলে উল্লিখিত সংখ্যক রোগী কখনোই অংশগ্রহণ করেনি।
অবশ্য ওই গবেষণার লেখকরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রকৃত তথ্য-উপাত্তগুলো কেউ নষ্ট করে দিয়েছে কিংবা ভুলবশত চূড়ান্ত ফাইল থেকে বাদ পড়ে গেছে। এ ভুলের কথা স্বীকার করে তারা বৈজ্ঞানিক জার্নাল থেকে নিবন্ধটিকে প্রত্যাহারও করেছেন।
ইরানের আরেকটি গবেষণা থেকেও মনে হতে পারে যে আইভারমেকটিন মানুষকে কোভিডে মৃত্যুবরণ থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু তদন্তকারী বিজ্ঞানীরা সেই গবেষণায়ও কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছেন। রোগীদের রক্তে উপস্থিত আয়রনের পরিমাণ পরপর এমন সব সংখ্যায় সাজানো হয়েছে, যা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব।
এদিকে যেসব রোগীকে ট্রায়ালের আগে আইভারমেকটিন দেয়া হয়েছে, তাদের তুলনায় প্লাসিবো দেয়া রোগীদের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা তুলনামূলক কম ছিল। এর অর্থ, নিশ্চিতভাবেই প্লাসিবো দেয়া রোগীরা অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ ছিল, তাই পরিসংখ্যানগতভাবে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনাই বেশি হওয়ার কথা।
গবেষণাগুলোতে এসব অসংলগ্নতা অনিচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলবশত ঘটেছে, সে সম্ভাবনা খুবই নগণ্য বলে মনে করেন ড. শেলড্রিক।
ইরানের গবেষণাটি যিনি পরিচালনা করেছেন, তার নাম ড. মোর্তেজা নিয়াই। তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল ও পদ্ধতির পক্ষ নিয়ে সাফাই গান, এবং জানান যে তদন্তকারী বিজ্ঞানীদের উত্থাপিত অভিযোগগুলো অমূলক। তিনি বলেন, গবেষণায় এ ধরনের র্যান্ডমাইজেশন খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু লেবানন ও ইরানের গবেষণা দুটি যে গ্রহণযোগ্য নয়, এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণের রিভিউ করা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দল ককরেনও। তাদের মতে, ওই দুটি গবেষণা ছিল খুবই দুর্বল। ফলে ককরেনের বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তেও পৌঁছেছেন যে কোভিড নিরাময়ের ক্ষেত্রে আইভারমেকটিন যে সহায়ক হতে পারে এমন কোনো অব্যর্থ ও নিশ্চিত প্রমাণ ওই গবেষণাগুলোতে মেলেনি।
এখন পর্যন্ত আইভারমেকটিন নিয়ে সবচেয়ে বড় ও সর্বোচ্চ গুণগতমানের গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করা হয়েছে কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটিতে করা টুগেদার ট্রায়ালের ভিত্তিতে। সেখানেও বলা হয়েছে, কোভিডের ক্ষেত্রে ওষুধটি কোনো উপকার করতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সাধারণভাবে আইভারমেকটিন একটি নিরাপদ ওষুধ, যদিও মাঝেমধ্যে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে আইভারমেকটিনকে বিষাক্ত হিসেবে সন্দেহ প্রকাশের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও সেটির সামগ্রিক পরিমাণ খুবই কম - এ ৪৩৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১,১৪৩। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনা খুব একটা গুরুতর ছিল না। কিছু রোগীর বমি, ডায়রিয়া, হ্যালুসিনেসন, বিভ্রান্তি, আচ্ছন্নভাব বা শিহরণ অনুভূত হয়েছে।
তবে আইভারমেকটিন প্রত্যক্ষভাবে মানুষের খুব বড় কোনো ক্ষতি না করলেও, পরোক্ষভাবে অনেক বড় ধরনের ক্ষতিরই কারণ হতে পারে। কেননা এটি অনেক মানুষকেই ভুল আশা ও নিরাপত্তাবোধের অনুভূতি দেয়, যার ফলে কোভিড আক্রান্ত হলে তারা হয়তো হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে এই ওষুধটি সেবন করে। আবার কেউ কেউ হয়তো এই ওষুধের প্রতি বিশ্বাসের ফলে ভ্যাকসিনই নেয় না।
পেরুর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. প্যাট্রিসিয়া গার্সিয়া বলেন, এমন একটা সময়ও এসেছিল যখন হাসপাতালে তার দেখা প্রতি ১৫ জন রোগীর মধ্যে ১৪ জনই শুরুতে আইভারমেকটিন সেবন করেছিল, এবং যতক্ষণে তারা হাসপাতালে এসেছিল, ততক্ষণে তারা অনেক বেশি অসুস্থ ও মরণাপন্ন হয়ে পড়েছিল।
এদিকে আইভারমেকটিনের সমর্থক বিশাল বিশাল ফেসবুক গ্রুপগুলো পরিণত হয়েছে গণফোরামে, যেখানে মানুষকে দেখা যায় কোথা থেকে আইভারমেকটিন কেনা যাবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করতে। অনেকে আবার পশুর ব্যবহার্য আইভারমেকটিনেরও খোঁজ করে।
অনেকগুলো গ্রুপ আবার নিয়মিতই আইভারমেকটিনের কার্যকারিতা গোপন বিষয়ক কন্সপিরেসি থিওরি পোস্ট করে থাকে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে ভ্যাকসিন-বিরোধী চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার রোগীদেরকে উদ্বুদ্ধও করা হয় যে কোনো হাসপাতালে আইভারমেকটিন না পাওয়া গেলে তারা যেন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা না নেয়।
এই গ্রুপগুলোর মাধ্যমে আবার অনেক সময় ব্যবহারকারীদের দেয়া হয় এনক্রিপ্টেড অ্যাপ টেলিগ্রামের গোপন গ্রুপেরও সন্ধান।
এই গ্রুপগুলোর মাধ্যমে একাট্টা হয়ে হয়রানির চেষ্টা করা হয় সেইসব চিকিৎসকদেরও, যারা আইভারমেকটিন প্রেসক্রাইব করেন না। গালাগালি করা হয় বিজ্ঞানীদেরও।
ইউনিভার্সিটি অভ লিভারপুলের অধ্যাপক অ্যান্ড্রিউ হিল শুরুতে আইভারমেকটিনের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক রিভিউ লিখেছিলেন, যেটি আইভারমেকটিন সমর্থকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানে অধ্যাপক হিল লিখেছিলেন যে বিশ্বের উচিত আইভারমেকটিন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হওয়া, এর সরবরাহ বৃদ্ধি করা এবং এটিকে অনুমোদন দেয়া।
কিন্তু এখন তিনি মত বদলেছেন। তিনি বলছেন, যাচাই-বাছাইয়ের পর এই ওষুধটিকে আর কোভিডের বিরুদ্ধে ভরসাযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। তার এই মত পরিবর্তনকে সহজভাবে নেয়নি আইভারমেকটিনের সমর্থকগোষ্ঠী। ফলে অধ্যাপক হিলের দিকে ধেয়ে এসেছে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও কটূক্তি।
স্বল্প সংখ্যক কোয়ালিফায়েড চিকিৎসকেরও রয়েছে আইভারমেকটিন বিতর্কে অতিরঞ্জিত প্রভাব। যেমন বিশিষ্ট চিকিৎসক পিয়েরে কোরি এখনো আইভারমেকটিনের ব্যাপারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেননি। বরং তিনি সমালোচনা করেছেন ট্রায়ালের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা বিজ্ঞানীদের।
প্রেগন্যান্সি ও চাইল্ড বার্থ বিশেষজ্ঞ ড. টেস লরি আবার গড়ে তুলেছেন ব্রিটিশ আইভারমেকটিন রিকমেন্ডেশন ডেভেলপমেন্ট (বার্ড) গ্রুপ। তিনি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম বন্ধ করারও দাবি তুলেছেন, কেননা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ফলে নাকি বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
একটি অনলাইন প্যানেলে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে কোন প্রমাণ পেলে তিনি বিশ্বাস করবেন যে কোভিডের বিরুদ্ধে আইভারমেকটিন কার্যকর নয়, তখন তিনি জোর গলায় বলেন, 'আইভারমেকটিন কাজ করে। কোনোকিছুই আমার বিশ্বাস বদলাতে পারবে না।' এছাড়া তিনি বিবিসিকে জানান যে অনেকেই আইভারমেকটিনের অবদানকে ছোট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে বিশ্বব্যাপী শুরুতে আইভারমেকটিনের এত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ কিন্তু ভ্যাকসিনবিরোধিতা ছিল না। বরং ভ্যাকসিনের অভাবেই বেশিরভাগ মানুষ আস্থা রাখতে শুরু করেছিল আইভারমেকটিনে।
বিভিন্ন সময়ে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, পেরু এবং লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ এবং স্লোভাকিয়ায় এই ওষুধটিকে কোভিড নিরাময়ের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে, এটি সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, এমনকি চিকিৎসকরা এটিকে প্রেসক্রাইবও করেছেন।
তবে পরবর্তী পেরু ও ভারতের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ তাদের ট্রিটমেন্ট গাইডলাইনে আইভারমেকটিনের পরামর্শ দেয়া বন্ধ করেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মার্ক জানিয়েছে, এই ওষুধের যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কোনো থেরাপেটিক প্রভাব রয়েছে, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য খাতকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে এই ওষুধটি। একদিকে চিকিৎসকরা বারবার বলছেন যে এই ওষুধের কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু তারপরও অনেক রোগীই মরিয়া হয়ে উঠেছে এই ওষুধটি পাওয়ার জন্য, কেননা ভ্যাকসিন পেতে তাদের এখনো অনেক অপেক্ষা করতে হবে।
দেশটির একজন চিকিৎসক বলেন, তার একজন আত্মীয় রয়েছেন যিনি রেজিস্টার্ড নার্স। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ভ্যাকসিন নেননি, এবং এক পর্যায়ে কোভিড সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তার অবস্থার যখন ক্রমশ অবনতি ঘটতে লাগল, তখনো তিনি যথাযথ চিকিৎসা না নিয়ে আইভারমেকটিন নিতে শুরু করলেন।
'ডাক্তারের কাছে না গিয়ে তিনি আইভারমেকটিন খাওয়াই চালিয়ে গেলেন এবং হোম অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলেন। যতক্ষণে আমি ঘটনাটি জানতে পারলাম, ততক্ষণে তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল নেমে গেছে ৬৬ শতাংশে। আমি অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম তার মেয়ের কাছে যেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
'শুরুতে তারা কেউই রাজি ছিলেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে আমি তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করালাম। এর কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি মারা গেলেন।'
- বিবিসি অবলম্বনে জান্নাতুল নাঈম পিয়াল