অনলাইন বিক্রেতাদের আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক

রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতার অধীনে যারা:
- ৫ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিতে হলে
- ক্রেডিট কার্ড থাকলে
- উবার, পাঠাও চালকদের
- বাসা বাড়িতে গ্যাস কানেকশন পেতে হলে
- ৫ লাখ টাকার উপরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে
- ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার উপরে বিনিয়োগ থাকলে
- সন্তান ইংলিশ ভার্শন স্কুলে পড়লে অভিভাবককে
- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ট্যাক্স রিটার্নের প্রমাণ ঝুলিয়ে রাখতে হবে, যা আইনে স্বীকৃত তার গোপনীয়তা ক্ষুন্ন করবে
ফাতেমা জেরিন নামে রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকার একজন গৃহিণী ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইনে কিছু পোশাক আইটেম ও ব্যাগ বিক্রি করেন। সারাবছরে তার বিক্রি দুই লাখ টাকারও কম। তার মতো এ ধরনের প্রায় তিন লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে এখন থেকে সরকারের কাছে আয়করের হিসাব বা ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে।
সরকার প্রস্তাবিত বাজেটের ফাইন্যান্স বিলে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য ও সেবা বিক্রি করা সবার ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ক্রেডিট কার্ড থাকলে, পাঁচ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে, উবার-পাঠাও চালক, বাসা বাড়িতে গ্যাস কানেকশন পেতে হলে, সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকার উপরে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর অফিসে আয়-ব্যয়ের হিসাব তথা ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে।
করযোগ্য আয় থাকুক না থাকুক, ব্যাংক কারো ১০ লাখ টাকা থাকলেই তার রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
কিংবা কখনো ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন কিন্ত এখন আর ব্যবসা বাণিজ্যে নেই, তাকেও রিটার্ন জমা দিতে হবে।
ট্যাক্স এর আওতা ও আদায় বাড়াতে বিস্তর পদক্ষেপ এসেছে এবারের বাজেট প্রস্তাবে, যা কর আদায় বাড়াতে ভুমিকা রাখার পাশাপাশি অনেক স্বল্প আয়ের কিংবা করযোগ্য আয় নেই, এমন মানুষের উপরও বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয়কর আইনে স্বীকৃত করদাতার গোপনীয়তাও রক্ষা করা যাবে না। যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এতদিন তাদের ব্যবসা প্রাঙ্গণে টিআইএন রাখার নিয়ম থাকলেও নতুন করে তাদের এখন ট্যাক্স পরিশোধের প্রমাণপত্র প্রদর্শনযোগ্য স্থানে রাখতে হবে, যা একজন করদাতার আইন দ্বারা স্বীকৃত এ সংক্রান্ত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ করবে।
বর্তমানে ৩৭ ধরনের ইকোনমিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন) বাধ্যতামূলক, যাদের মধ্যে কিছু খাতকে রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিলো। নতুন প্রস্তাবে তাদের প্রায় সবাইকে রিটার্ন জমার আওতায় আনা হয়েছে। যার মধ্যে নতুন করে একাধিক খাত ও উপখাত যুক্ত হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা এবং গ্রে ইকোনমিকে ফরমাল ইকোনমিকে আনার অংশ হিসেবে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাদের করযোগ্য আয় নেই, তাদের ট্যাক্স দিতে হবে না। কিন্তু হিসাব নিকাশ সরকারের কাছে থাকা উচিত।
অনলাইনে পন্য ও সেবা বিক্রি করা উদ্যোগের মত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও করযোগ্য আয় নেই এমন মানুষের উপর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ হলে এ ধরণের উদ্যোগ ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিডিজবস ও আজকেরডিল এর প্রধান এ কে এম ফাহিম মাশরুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের রাজস্ব তেমন বাড়বে না। কিন্তু এর ফলে এ খাতের প্রসার ক্ষতিগ্রস্ত হবে কর্মসংস্থানের উদ্যোগও ব্যাহত হবে।"
তিনি জানান, এ খাতে বর্তমানে ৩ লাখ উদ্যোক্তা জড়িত, যার অর্ধেকই নারী। এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে আরো ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
বর্তমানে ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যাদের বার্ষিক টার্নওভার এক কোটি টাকার উপরে, তাদের উপর সোর্স ট্যাক্স রয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরেই ট্যাক্স এর আওতা ও আদায় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আসছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনে জোর দিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও এমন বেশকিছু পদক্ষেপ রয়েছে।
এতদিন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা এলাকাগুলোতে 'স্পট অ্যাসেসমেন্ট' এর মাধ্যমে আয়কর নির্ধারণের বিধানকে প্রস্তাবিত বাজেটে আরো বিস্তৃত করা হয়েছে।
সোর্স ট্যাক্স কর্তনকারীদের কমপ্লায়েন্সে ঘাটতি হলে বড় ধরনের জরিমানা এবং ট্যাক্স অফিসিয়ালদের অথোরিটারিয়ান পাওয়ার বাড়ানোর প্রস্তাবও এসেছে।
খোদ এনবিআরের ট্যাক্স বিভাগের সাবেক কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, কর আদায় বাড়াতে এত শক্ত আইনি পদক্ষেপ এর আগে কখনো নেওয়া হয়নি। এমন কিছু শ্রেণির মানুষকে করের আওতায় আনা হয়েছে, যার ট্যাক্স ইমপ্যাক্স জিরো। কিন্তু ওইসব মানুষের ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স কস্ট ও হয়রানি বেড়ে যাবে।
এনবিআর (ট্যাক্স পলিসি) এর প্রাক্তন সদস্য ড. সৈয়দ মোহাম্মদ আমিনুল করিম টিবিএসকে বলেন, ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে এবারের মত এত শক্ত আইনি পদক্ষেপ এর আগে কখনো নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, "অনেকের বাধ্য হয়ে টিআইএন নিতে হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেরই করযোগ্য আয় নেই, যেমন উবার বা পাঠাওয়ের চালক, ক্রেডিট কার্ডধারী, সেভিং সার্টিফিকেট ক্রেতা, ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন কিন্তু ছোট ব্যবসা বা ব্যবসায় এখন নেই বা অনলাইনের ছোট ছোট উদ্যোক্তা। এমন মানুষদের কাছ থেকে বলতে গেলে রেভিনিউ ইমপ্যাক্ট জিরো। কিন্তু ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হলে তাদের কমপ্লায়েন্স কস্ট বাড়বে এবং হয়রানি বাড়বে। এতে তাদের মধ্যে ভীতি বেড়ে যাবে।"
তিনি বলেন, "উন্নত দেশে যাদের ট্যাক্সেবল ইনকাম নেই তাদের রিটার্ন জমা দিতে হয় না। করযোগ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে কর আদায়ে নিজের (এনবিআর) প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা না থাকায় সেই দায়িত্ব তো ব্যক্তির উপর দেওয়া যৌক্তিক নয়।"
তিনি মনে করেন, ইনফ্লেশনের মধ্যে ছোট ও মধ্যম আয়ের করদাতাদের জন্য কিছু সিদ্ধান্ত 'নিষ্ঠুর' হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন, ঢালাও রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতায় অনেকের উপর হয়রানি বাড়বে। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষের উপর রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতায় হয়রানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা প্রথমে রিটার্ন জমা দিতে এলেই সম্পদের উৎসের প্রমাণ দেখাতে হবে।
"তবে এনবিআর যদি নতুন করদাতাদের জন্য এমন বিধান করে যে, পরবর্তী তিন বছরে তাদের কোন প্রশ্ন করা হবে না, সেক্ষেত্রে করদাতাদের হয়রানি হয়তো কিছুটা কমতে পারে।"
অনেক ব্যাংকারও মনে করেন, ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, ডিপোজিট বা লোনের ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার শর্ত দেওয়ায় এসব কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
অবশ্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিইও এবং ফরেইন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ টিবিএসকে বলেন, "অর্থনীতিতে ট্রান্সপারেন্সি আনতে হলে এই উদ্যোগ দরকার। তবে ক্রেডিট কার্ডেহোল্ডারদের রিটার্ন জমার ক্ষেত্রে ক্রেডিটের লিমিট দেওয়া যৌক্তিক হবে।"
বর্তমানে দেশে টিআইএনধারী রয়েছেন ৭৫ লাখ, যার মধ্যে রিটার্ন জমা দেন এক তৃতীয়াংশ। এনবিআরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, নতুন এ উদ্যোগের ফলে আগামী দুই বছরে রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা ৫০ লাখে উন্নীত হবে।