বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সামনে পশ্চিমা দেশে অনলাইন জনশক্তি রপ্তানির বিরাট সুযোগ

বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলো যেভাবে ব্যবসার প্রস্তাব দেয় বা গ্রাহকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে- ডিজিটাল রুপান্তরের ফলে ইতোমধ্যেই তাতে এসেছে বড় পরিবর্তন। যা আরও তীব্র করেছে মহামারি। জনস্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলাতেও আবশ্যক হয়ে উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তি। মহামারিও বাড়িয়েছে ভোক্তাদের অনলাইনে কেনাকাটার অভ্যাস, আর গ্রাহক ব্যবস্থাপনায় অনলাইনে চাকরির সুযোগ বাড়ছে দিন দিন।
গতিশীল 'ডিজিটালাইজেশন' বিশ্ব অর্থনীতিকে আমূল বদলে দিচ্ছে। হয়ে উঠেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি।
এশিয়াকেও নতুন রূপ দিচ্ছে- ডিজিটালাইজেশন। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ডিজিটাল রুপান্তর জীবিকার অনেক উপায় তৈরি করেছে, যে সুবিধা গ্রহণে সবচেয়ে অগ্রগামী তরুণ প্রজন্ম।
ডিজিটালাইজেশনের কিছু খাতে পুরো বিশ্বকেও নেতৃত্ব দিচ্ছে এশিয়ার কিছু দেশ। যেমন ই-কমার্সের মাধ্যমে খুচরা বিক্রিবাট্টার প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে- ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়া। এখাতে তাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ২৫ ও ২৩ শতাংশ।

আরও বড় সুসংবাদ- পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে অনলাইন কর্মীর চাহিদা। এই সুযোগ নিয়ে সেখানে অনলাইন শ্রম রপ্তানিতে অগ্রণী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের মতো এশীয় দেশসমূহ। যেমন বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতি সমাজের সুবিধা-বঞ্চিত শ্রেণির জন্যও কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলে দিয়েছে।
মহামারির প্রভাব:
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে প্রচলিত বাণিজ্যে দেখা দেয় ব্যাঘাত। এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পুরো বিশ্বের মতো এশিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ডিজিটাল মাধ্যমে যোগাযোগ। মহামারির অভিঘাত থেকে এশিয়ার পুনরুদ্ধারে মৌলিক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির প্রসার। প্রভাবশালী জাপানি গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া রিভিউ জানিয়েছে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিস্ময়কর প্রভাব ফেলেছে মহামারি। এই অঞ্চলের ৬ কোটি মানুষ মহামারিকালে অনলাইন ক্রেতায় পরিণত হয়েছে।
প্রযুক্তির ব্যবহারযোগ্যতা এভাবে বেড়ে যাওয়ায় এসময়ে প্রায় সব ধরনের ই-কমার্স ব্যবসা প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে। সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে খেলার সরঞ্জাম ও সুপারমার্কেটে মেলে এমন পণ্য বিক্রির প্রবৃদ্ধি।

বিশ্বব্যাপী অনলাইনে খুচরা বিক্রিবাট্টার ৬০ শতাংশ এখন হচ্ছে এশিয়ায়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যা ২০২৫ সাল নাগাদ দ্বিগুণ হওয়ার আশা করা হচ্ছে। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনাল বলছে, আলোচিত সময়ে তা ২ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছে যাবে।
হোক সে রাইড শেয়ারিং, কেনাকাটা অথবা অনলাইন জনশক্তি রপ্তানি- সব মিলিয়ে ডিজিটাল স্ফীতি এ অঞ্চলে ব্যবসাবাণিজ্য ও সামাজিক জীবনের সর্বস্তরকে নতুন রূপ দিচ্ছে।
স্মার্টফোন গেটওয়ে:
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মহাদেশ এশিয়াতেই আছে সবচেয়ে বেশি মুঠোফোন ব্যবহারকারী। গড় হিসেবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এশীয় মোবাইল পরিষেবা ব্যবহার করেন। তারপরও রয়েছে আরও সম্প্রসারণের সুযোগ। আর সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়।

এশিয়ার বেশিরভাগ উদীয়মান অর্থনীতিতে হাতে হাতে দেখা মেলে স্মার্টফোনের। সিঙ্গাপুরে মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। তারপর যথাক্রমে ৮৩ ও ৭৫ শতাংশ ব্যবহারকারী নিয়ে অবস্থান মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের। তবে ২০২০ সালে স্মার্টফোন বাজার প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে ফিলিপাইনে, যা ৯০ শতাংশের বেশি।
মোবাইল অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন- জিসিএমএ'র তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মোবাইল ডেটার ব্যবহার তিনগুণ বাড়বে। ফলে বর্তমানের ইউজার প্রতি ৯.২ জিবি মাসিক ডেটা ব্যবহার উন্নীত হবে ২৮.৯ জিবিতে।
জাতিসংঘের আর্থ-সামাজিক কমিশন ইউএন-ইস্ক্যাপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক ই-কমার্স বাজারের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চল হচ্ছে এশিয়া। নিচের গ্রাফটিতে স্পষ্ট করেই দেখানো হয়েছে যে, এশিয়ার ২ দশমিক ৪৪৮ ট্রিলিয়ন ই-কমার্স বিক্রিবাট্টার ৭৮ শতাংশই আবার হচ্ছে স্মার্টফোনের মাধ্যমে।

সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে এগিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া:
এশিয়ায় ডিজিটালাইজেশনের আরেকটি বড় চালিকাশক্তি সামাজিক মাধ্যম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে এর ব্যবহার দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেই অনেকগুণ বেশি। মোট জনসংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী রয়েছেন মালয়েশিয়ায় (৮১%)। এরপর সিঙ্গাপুর (৭৯ %), ফিলিপাইন (৬৭ %) এবং ইন্দোনেশিয়ায় (৫৯%)।
সে তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী থাকা ভারত ও বাংলাদেশে এই হার যথাক্রমে ২৯ ও ২২ শতাংশ।
সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সময় বা গড়ে তিন ঘণ্টা ৫৩ মিনিট কাটান ফিলিপাইনের নাগরিকরা।
ডিজিটাল পরিষেবার ভোগও বাড়ছে:
এশিয়ায় ডিজিটাল ভোগ ব্যবস্থার দ্রুত প্রসারে অবদান রেখেছে চারটি মূল অনুঘটক। প্রথম ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্যস্ত তরুণ জনসংখ্যা। দ্বিতীয়ত, স্মার্টফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের সুবিধায় কোটি কোটি মানুষের র অংশগ্রহণ। তিন নম্বর বিষয়টি হলো- এই অঞ্চলে তুলনামূলক উচ্চ হারে মোবাইল ফোনের প্রবেশ। নেটওয়ার্ক সুবিধার উন্নতি যত হচ্ছে, ততই বেশি ক্রেতারা ই-কমার্স ও সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন সাইট থেকে পণ্য কিনছেন।
ম্যাককিন্সে অ্যান্ড কোম্পানির প্রক্ষেপণ, ২০২৪ সাল নাগাদ এশিয়ায় ডিজিটাল পেমেন্ট হবে ৬৫ শতাংশ। সে তুলনায় বৈশ্বিক গড় হবে ৫২ শতাংশ।
সবশেষ ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সরকারগুলোও ডিজিটাল অর্থনীতি সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রতি যত্নশীল। এজন্য তারা অনেক নীতি সহায়তা ও প্রণোদনাও দিচ্ছে।
এশিয়ার সামনে ডিজিটাল দিগন্ত:
দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ডিজিটাল প্রবৃদ্ধির নাটকীয় গতি আজ স্পষ্ট দৃশ্যমান। তবে সর্বোচ্চ সম্ভাবনা অর্জন করতে হলে- ডিজিটাল অবকাঠামো, নতুন ভোক্তার উন্নয়ন, তথ্য নিরাপত্তা এবং কার্যকর ডিজিটাল নীতির মতো বেশকিছু দিকে উন্নতি করতে হবে। তাছাড়া, অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, বর্তমানের ডিজিটাল বাণিজ্যে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) নয়—বরং শুধুমাত্র ভোক্তারাই উপকৃত হচ্ছে। সম্পদ বাড়ছে অতি-ধনী বিনিয়োগকারীদের।
এ অঞ্চলে 'গো ডিজিটাল আসিয়ান'- এর মতো আন্তঃদেশ সহযোগিতাও বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। যা নিশ্চিতভাবেই ডিজিটাল অর্থনীতির পরিসরকে আরও বিস্তৃত করবে। আঞ্চলিক অবকাঠামো উন্নয়নও পাবে নতুন মাত্রা।
এছাড়া, জাতীয় পর্যায়ে- ভারতের ন্যাশনাল ডিজিটাল কমিউনিকেশন পলিসি (২০১৮), ফার্স্ট পলিসি ফর ডিজিটাল পাকিস্তান (২০১৮) এবং বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইসিটি স্ট্র্যাটেজির মতো কৌশল ও নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় সরকারগুলোর উচিত একটি টেকসই ডিজিটাল বাস্তুসংস্থান তৈরির স্বার্থে নব-উদ্যোগ বা স্টার্টআপ-গুলোকে সহায়তা সমর্থন দেওয়া জোরদার করা। তাদের বাজার প্রবেশে বাধা দূর করা, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোনিবেশ এবং জাতীয় নিয়ন্ত্রক নীতিমালাকে ডিজিটাল অর্থনীতির সুষম বিকাশে কাজে লাগাতে উদ্যমী হওয়া। তবেই আর্থ-সামাজিক খাতে আসবে আরও লক্ষণীয় উন্নতি।
- সূত্র: দ্য প্রিন্ট