মার্চে ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার কমে ১০%— পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন

গত ৫ মাসের মধ্যে চলতি বছরের মার্চে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম হয়েছে— যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশের নিচে। অন্যদিকে, ব্যাংকে জমা রাখার পরিমাণ কমলেও মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মার্চে মোট আমানত ১৬.৭৫ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা গত বছরের একই সময়ের প্রবৃদ্ধির তুলনায় ৯.৯৯ শতাংশ। এরমধ্যে টাইম ডিপোজিট বেড়েছে ১০.৩৭ শতাংশ এবং ডিমান্ড ডিপোজিট বেড়েছে ৭.৬৪ শতাংশ। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে সর্বোপরি আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০.৪৩ শতাংশ।
ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিটের গ্রোথ বা আমানতের প্রবৃদ্ধি কেন কমেছে, জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "গত বছরের মার্চ মাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। ফলে অতিরিক্ত খরচের চাপ নিতে গিয়ে ডিপোজিট কমে থাকতে পারে। এছাড়া, ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণার পর অনেক ব্যাংকেই ডিপোজিট ভাঙার একটা চাপ ছিল। এটিও ডিপোজিট কমার একটি কারণ হতে পারে।"
তিনি বলেন, "তবে এক মাসের তথ্য দেখেই ট্রেন্ড বোঝা যায় না। অন্তত ২-৩ মাস যাওয়ার পর বোঝা যাবে ডিপোজিট সামনের দিনগুলোতে বাড়বে কিনা।"
সব ব্যাংকে ডিপোজিট সমানভাবে বাড়েনি উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, "যেসব ব্যাংক নিয়ে মার্কেটে ইতিবাচক মনোভাব আছে, সেগুলোর বেশিরভাগই এই খাতের গ্রোথ রেটের তুলনায় ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে গ্রাহকেরা দুর্বল ব্যাংক থেকে ডিপোজিট তুলে এনে ভালো ব্যাংকে রেখেছেন। ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট আরও ঘণীভূত হয়েছে। উল্টোদিকে, ভালো ব্যাংকের পোর্টফলিও আরও বড় হয়েছে।"
টানা তিন মাস আমানত বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১১.০৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা ছিল বিগত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এর আগে, করোনা মহামারির বৈশ্বিক লকডাউন ও সেকারণে হওয়া অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার প্রভাবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আমানত প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল।
আর্থিক অবস্থা ব্যাতিরেকে সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলো সাধারণত ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে সুদহার অফার করছে; অন্যদিকে সংকটে থাকা অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এদিকে আবার, আমানতের এই সামগ্রিক বৃদ্ধিতে আংশিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করারও আবদান রয়েছে বলে মনে করা হয়। এটি পুরো ব্যাংকিং খাতে আমানত বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মার্চ শেষে কারেন্সি আউট সাইড ব্যাংক বা মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২.৬২ লাখ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারির তুলনায় যা ৩,৬২১ কোটি টাকা বেশি। গত বছরের মার্চ মাস শেষে মানুষের হাতে টাকা ছিল ২.৫৪ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, টাকা ব্যাংকে থাকলে সেটি যে গতিতে ডিপোজিট ও লোন তৈরি করতে পারে— ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকলে এর গতি অনেক কম হয়। ফলে, ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকলে, তা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "মার্চ মাস উৎসবেরর মাস হওয়ায় ক্যাশ কারেন্সির ডিমান্ড বাড়ার কথা। সে হিসাবে কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক বেড়েছে, এটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।"
তিনি বলেন, "আমরা এই প্রবৃদ্ধিকে 'সিজনাল ইফেক্ট' বলতে পারি। এছাড়া, ব্যাংক মার্জারের মতো ঘটনাগুলোতে আর্থিক খাতের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার বিষয়কেও আমরা বাদ দিতে পারি না।"
আমানত প্রবৃদ্ধি কেন কমেছে, জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, "টানা অনেক মাস ধরে ইনফ্লেশন রেট (মূল্যস্ফীতির হার) বেশি থাকায় সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতা কমে গেছে। তবে ইনফ্লেশনের কারণে যে সবার ক্ষতি হচ্ছে, এমন নয়। এ ধরনের ইনফ্লেশনের সময়ে ধনী আরও ধনী হয় এবং গরিব আরও গরিব হয়।"
"এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় সাধারণ মানুষের 'রিয়েল ওয়েজ' (মজুরি/বেতন) দেখলে, যেটি দিনদিন কমছে," যোগ করেন তিনি।