ডলারের রেট কমায় ঈদের মাসেও কমেছে রেমিট্যান্স

সাধারণত ঈদের আগ দিয়ে রোযার মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ে তবে ডলারের রেট কিছুটা কম দেওয়ায় ঈদের মাস এপ্রিলের প্রথম তিন সপ্তাহে আগের মাসের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মার্চের ৪-২৪ তারিখ পর্যন্ত তিন সপ্তাহে রেমিট্যান্স এসেছিল ১,৪২৩ মিলিয়ন ডলার। চলতি এপ্রিলের প্রথম তিন সপ্তাহে এসেছে ১,২৭২ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সর্বশেষ সপ্তাহে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩১৩ মিলিয়ন, যেখানে প্রথম দুই সপ্তাহে ৪৭৫ মিলিয়নের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। অর্থাৎ, ঈদ উপলক্ষে যেখানে রেমিট্যান্স বেশি আসার কথা ছিল, সেখানে আগের মাসের তিন সপ্তাহের হিসাবে এপ্রিলে রেমিট্যান্স কম এসেছে ১৫১ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের পুরো এপ্রিল ছিল রমজান মাস। সে মাসে ২.০১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
মার্চের তুলনায় চলতি এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স তেমন না বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে রেমিট্যান্সের ডলারের রেট কম দেওয়াকে উল্লেখ করে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, অন্য সাধারণ মাসের তুলনায় ঈদের মাসে রেমিট্যান্স কয়েকশ মিলিয়ন বেশি আসে। এবারও তেমন হবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে ২০টির বেশি ব্যাংক রেমিট্যান্সের ডলারের রেট ১১৪ টাকা পর্যন্ত দেওয়ায় মার্চ মাসে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলার পার করেছিল। এপ্রিলে অধিকাংশ ব্যাংকই রেমিট্যান্সের ডলারে ১০৭ টাকা রেট দিচ্ছে। ফলে ঈদ উপলক্ষে রেমিট্যান্স যেটুকু বাড়ার কথা ছিল, সেটি আর বাড়েনি।
অবশ্য অধিকাংশ ব্যাংক বাফেদা নির্ধারিত ১০৭ টাকা রেটে ডলার নিয়ে আসলেও অল্পকিছু ব্যাংক রেট বেশি দিচ্ছে দাবি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের এমডি টিবিএসকে বলেন, 'সামনের দুই-তিন মাস আমাদের ইমপোর্ট পেমেন্টের বেশ ভালো একটা চাপ আছে। ফলে রেমিট্যান্স বেশি আসাটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেস্ট্রিকশন ও ডলার সংকটের কারণে আমাদের ইমপোর্ট কমে এসেছে। এক্সপোর্টও কিন্তু কিছুটা কমার ধারায় আছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে আমরা ইমপোর্ট বেসড কান্ট্রি, এক্সপোর্ট বেসড নই। অর্থাৎ, আমাদের এক্সপোর্ট থেকে ইমপোর্ট বেশি হয়। এই দুইটা এমাউন্টের গ্যাপ আমাদের রেমিট্যান্স থেকে পূরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে ২ বিলিয়নের কম রেমিট্যান্স আসলে ইমপোর্ট পেমেন্ট সঠিকভাবে করা কঠিন হয়ে যায়। এপ্রিলের রেমিট্যান্স ফ্লো বলছে, মাস শেষে রেমিট্যান্স ২ বিলিয়ন ডলার আসবে না। ডলারের রেট কম দেওয়াটাই রেমিট্যান্স কমার মূল কারণ।'
তাই রেমিট্যান্সের ডলারের রেট জোর করে ধরে রাখাটা খুব বেশি ভালো ফল আনবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রেজা ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, 'রেমিট্যান্স যারা পাঠান তাদের মধ্যে দুইটি পক্ষ দুইভাবে চিন্তা করার কারণে রেমিট্যান্স কমেছে বলে আমি মনে করি। এর একটি পক্ষের ভাবনা রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বেশি হওয়া উচিত। তারা কিছুটা বেশি রেট পাওয়ার আশায় এখনই রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন না।'
'আরেকটি পক্ষ ডলারপ্রতি ৩-৪ টাকা রেট বেশি পেতে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, ফলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স বেশি আসাটা আমাদের দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।'
আমদানি এলসিতে ১১৪ টাকা রেট নিচ্ছে ব্যাংক
রেমিট্যান্সের ডলারের দাম মার্চের তুলনায় কিছুটা কমলেও আমদানি এলসি সেটেলমেন্টে ব্যবসায়ীদের আগের মতোই ১১৪ টাকা পর্যন্ত রেট দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) মহাসচিব এবং মেট্রোসেম ইস্পাত লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শহীদুল্লাহ বলেন, 'কাঁচামাল আমদানির জন্য আমরা পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারছি না। গত এক সপ্তাহে আমাদের ১০টি এলসি খোলার চাহিদা থাকলেও ডলার সংকটের কারণে মাত্র ২টি খুলতে পেরেছি। এছাড়া এসব এলসিতে প্রতি ডলারের জন্য ১১৩-১১৪ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে নগদ মার্জিন রাখার পরিমাণ বাড়ায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বেশি লাগছে ও উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আগে ৫% নগদ মার্জিন রাখতে হলেও এখন অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ৫০% পর্যন্ত রাখতে হচ্ছে।'
সিমেন্ট ও ইস্পাত উৎপাদনে শতভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয় উল্লেখ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'পর্যাপ্ত কাঁচামাল না পাওয়ায় আমাদের সক্ষমতার ৩০-৪০% ব্যবহার করতে পারছি। উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালের দাম বাড়ছে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এক শীর্ষ আমদানিকারক বলেন, 'আমরা বেশি রেট দিয়েও ডলার পাচ্ছি না। ব্যাংকগুলো ১০৭-১০৮ টাকা পর্যন্ত অফিশিয়ালি ডলারের রেট নিচ্ছে, বাকি ৬-৭ টাকা ক্যাশ বা চেকের মাধ্যমে নিচ্ছে।'
এ বিষয়ে জানতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, 'এক্সপোর্টাররা আমাদের কম রেটে ডলার দিতে চাচ্ছেন না। বড় এক্সপোর্টাররা ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে ১১৩ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ১ টাকা প্রফিট রেখে ১১৪ টাকা পর্যন্ত ডলারের রেট নিচ্ছি। বর্তমানে সাপ্লাইয়ের তুলনায় আমদানিকারকদের ডলারের ডিমান্ড অনেক বেশি বলে যাদের কাছে ডলার আছে তারা কম দামে বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।'