ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য পুঁজিবাজার থেকে ৭০০ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা এক ডজন কোম্পানির

প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল তোলার পরিকল্পনা করছে এক ডজন কোম্পানি। নতুন সংগ্রহ করা মূলধন নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন এক সময়ে অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারকে বেছে নিচ্ছে- যখন তারল্য সংকটের মধ্যে ব্যাংকের অর্থ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
তহবিল সংগ্রহকারীদের বেশিরভাগই ছোট কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলো মহামারিজনিত লোকসান কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের পক্ষে ব্যাংকের অর্থায়ন পাওয়া কঠিন।
তবে কয়েকটি বড় গ্রুপও তাদের পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে। উদ্দেশ্য, তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনাম অর্জন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা।
যেমন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী পারটেক্স গ্রুপ তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পারটেক্স কেব্লসের জন্য একটি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প স্থাপন করতে বিদেশি বিনিয়োগ খুঁজছে। কোম্পানিটি কেব্ল উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করবে।
দেশের বাজারে এটিই কেব্ল উৎপাদনের জন্য প্রথম ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প হবে।
ব্যবসায়িক গ্রুপটি বর্তমানে কয়েকজন জাপানি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা করছে, যারা পারটেক্স কেব্লসকে কেব্লের কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
পারটেক্স কেব্লস লিমিটেডের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার রাকিব আহমেদ বলেন, 'এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমাদের কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হবে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানির মূল্যায়ন করতে পারে।'

কেবল শিল্পের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী পারটেক্স ক্যাবলস অভিহিত মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে অভিহিত মূল্যে তিন কোটি শেয়ার ইস্যু করে ৩০ কোটি টাকা তোলার পরিকল্পনা করেছে।
কোম্পানিটি এখনও পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) আনুষ্ঠানিক আবেদন করেনি।
আরেক বড় শিল্পগোষ্ঠী ডিবিএল গ্রুপ ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুলাল ব্রাদার্সকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা করছে।
বার্ষিক ৮৭০ মিলিয়ন ডলার টার্নওভারের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির একজন শীর্ষ ব্যবস্থাপক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বর্তমানে তাদের দুই ডজন কোম্পানি রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তাদের বেশ কয়েকটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা করছেন।
বর্তমানে ডিবিএল গ্রুপের মাত্র একটি কোম্পানি—মতিন স্পিনিং—ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত আছে।
গ্রুপটি এখনও বিএসইসির কাছে আইপিওর জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করেনি।
অন্যান্য বড় কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বেস্ট হোল্ডিংস ও ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড। কোম্পানি দুটি অভিহিত মূল্যের সঙ্গে প্রিমিয়ামযুক্ত পদ্ধতিতে (বুক বিল্ডিং সিস্টেম) পুঁজিবাজার থেকে যথাক্রমে ৩৫০ কোটি ও ৯৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে।
দুটি কোম্পানিই ইতিমধ্যে বিএসইসিতে আইপিওর জন্য আবেদন জমা দিয়েছে।
চিকিৎসা, শিল্প ও ল্যাবরেটরি গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদনকারী ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, 'এই সম্প্রসারণ বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও শিল্প গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে এবং বিদেশনির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে।'
তার কোম্পানি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে গ্যাস রপ্তানিও করতে পারে বলে জানান নুরুল ইসলাম।
বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা তহবিলের ১৭৬ কোটি টাকা লা মেরিডিয়ান হোটেলের নির্মাণ ও অন্যান্য পূর্ত কাজে ব্যবহার করব। বিদ্যমান দায় শোধের জন্য ১১৫.৬০ কোটি টাকা এবং বাকিটা স্থানীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ব্যবহার করব।'
তিনি বলেন, বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে করোনা মহামারির পরে হোটেলটিতে অতিথির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
আগে তার কোম্পানির বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ শোধ নিয়ে সমস্যা ছিল এবং তারা বন্ডের মাধ্যমে ঋণকে ইক্যুইটিতে রূপান্তরিত করেছেন বলে জানান আমিন আহমেদ।
ছোট উদ্যোগের মধ্যে পাঁচটি কোম্পানি এসএমই প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। উল্লেখ্য, ছোট মূলধনের ব্যবসাগুলোকে শেয়ার বাজারে আনতে এবং তাদের মূলধন বাড়াতে সহায়তা করতে ২০১৯ সালে এসএমই প্ল্যাটফর্ম চালু হয়।
আত্মপ্রকাশের পর থেকে এসএমই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দশটি প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১১২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এতে এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিলের সংগ্রহের এক নতুন দরজা খুলে গেছে।
সেকেন্ডারি মার্কেটে যেসব বিনিয়োগকারীর ৩০ লাখ টাকার বেশি পোর্টফোলিও আছে, তারা এসএমই প্ল্যাটফর্মে আইপিওতে অংশ নিতে পারেন।
ছোট কোম্পানিগুলোর মধ্যে এমকে ফুটওয়্যার লিমিটেড ১০ কোটি টাকা, গ্লোরিয়াস ক্রপ কেয়ার লিমিটেড ১১.৫০ কোটি টাকা, সুব্রা সিস্টেমস লিমিটেড ১০ কোটি টাকা, আল-মদীনা ফার্মাসিউটিক্যালস ৫ কোটি টাকা এবং এগ্রো অর্গানিকা পিএলসি ১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে পুঁজিবাজারের এসএমই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।
আরও ছয়টি উদীয়মান কোম্পানি তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৭০ কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করতে বিএসইসির কাছে আবেদন করেছে।
এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে ক্লাসিক ফয়েল ৩০ কোটি টাকা, বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস ৫০ কোটি, রাইমার কেমিক্যাল ৩০ কোটি, সিকদার ইস্যুরেন্স ১৬ কোটি, এশানা নন-ওভেন ফেব্রিক্স ৩০ কোটি এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ১৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে অভিহিত মূল্য পদ্ধতিতে।
ইশানা নন-ওভেন ফেব্রিক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাফতুন হক টিবিএসকে বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে, উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যাংকঋণ আমাদের জন্য ইতিবাচক লক্ষণ না। তাই আমরা পুঁজিবাজারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
এশানা জানিয়েছে, তারা নানা ধরনের নন-ওভেন কাপড় তৈরি করে যা পিপিই, মাস্ক, নন-ওভেন ব্যাগ, কুশন কাভার ও গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
মাফতুন হক বলেন, 'আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা কয়েক বছর আগেই নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোভিডের কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।'
তিনি জানান, 'চার বছর আগে আমরা ইউরোপের বাজারে রপ্তানি শুরু করি। এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রসহ চারটি দেশে রপ্তানি করছি।'
মহামারির পর চীনে শ্রম-ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশসহ অন্যান্য উদীয়মান দেশগুলোতে এ ধরনের ব্যবসা বাড়ছে বলে জানান তিনি।
মাফতুন হক আশা প্রকাশ করেন, তাদের কোম্পানি সফলভাবে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে তাদের উৎপাদন-ক্ষমতা ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।