বড় ফার্মা ভালো করলেও সংকটে ছোটরা

দেশের পুরনো ওষুধ কোম্পানিগুলোর অন্যতম বরিশাল বেইজড রেফকো ফার্মাসিউটিক্যালস। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে উৎপাদনে থাকা ফার্মা কোম্পানিটি ২০১৯ সালে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির পর এক বছরের ব্যবধানে তাদের বিক্রি কমে ৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে।
যদিও এই সময়ে বাংলাদেশের বাজারে ওষুধের ব্যবসা ১৭.২১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২০ সালের মে থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ওষুধের ব্যবসা ৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিডকালীন সময়ে দীর্ঘদিন ডাক্তারেরা চেম্বার না করায় প্রেসক্রিপশন বেইজড ওষুধ বিক্রি কমেছে। মানুষ পরিচিত ব্র্যান্ডের ওষুধ ক্রয় করায় ব্যবসা প্রবৃদ্ধির এ সুবিধা কেবল বড় কোম্পানিগুলোই নিয়েছে। ফলে দেশে ফার্মা মার্কেটের শীর্ষে থাকা কোম্পানির কোনো কোনোটির বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশও ছাড়িয়েছে। বিপরীতে ছোট কোম্পানিগুলোর অনেকেরই বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সেক্রেটারি মো. শফিউজ্জামান বলেন, "দীর্ঘদিন ডাক্তারদের চেম্বারে না বসা ও বিক্রয় প্রতিনিধিরা চলাফেরা করতে না পারায় ছোট ও নতুন কোম্পানিগুলো বাজার ধরে রাখতে পারেনি। মানুষ দোকানে এসে মূলত পরিচিত কোম্পানির ওষুধই কিনেছেন। বিপরীতে করোনা সংক্রান্ত ওষুধ উৎপাদন ও পূর্বের ব্র্যান্ড সুনামের কারণে বেক্সিমকো, স্কয়ার, হেল্থকেয়ার, ইনসেপ্টার মতো পরিচিত কোম্পানির ওষুধ বিক্রি বেড়েছে"।
রেফকো ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালক এবং ফার্মটির অন্যতম মালিক জাহিদুল আলম জুয়েল বলেন, "২০২০ সালের মার্চে মহামারি শুরুর পর থেকে আমাদের বিক্রি ৪০-৫০% হ্রাস পেয়েছে"।
"গত দেড় বছর ধরে বারবার লকডাউনের কারণে, আমাদের মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা নিয়মিত ডাক্তার এবং ওষুধের দোকান পরিদর্শনে যেতে পারেন নি, যা বিক্রির ব্যাপক হ্রাসের মূল কারণ"।
তবে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রার ৫২ বছরে বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হলেও কোম্পানির মালিকরা কখনই ওষুধের মানের সাথে আপোস করেননি বলে জানান তিনি।
রেফকো ফার্মার মতোই বিক্রি কমে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ছোট কোম্পানিগুলো। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া কোম্পানিগুলোর ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকেঅ্যাডভেন্ট ফার্মা লিমিটেডের বিক্রি কমেছে ২০ শতাংশ। একই সময়ে ১১ শতাংশ বিক্রি কমেছে সিলকো ফার্মা লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির।
সিলকো ফার্মা কোম্পানির সচিব টিংকু রঞ্জন সরকার বলেন, "করোনার শুরু থেকেই আমাদের বিক্রয় কর্মীরা ঠিকমতো যাতায়াত করতে পারেনি। ওষুধ উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহও বেশ কঠিন ছিল। ফলে বিক্রি কমেছে"।
জুলাই-মার্চ সময়ে বিক্রি হ্রাসের পাশাপাশি মুনাফা কমেছে ইন্দো বাংলা ফার্মা, সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস এন্ড ফার্মা এইড লিমিটেডেরও। স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ইন্দো বাংলা ফার্মার মুনাফা প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে।
শফিউজ্জামান বলেন, কোভিডকালে বিপণন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রথম সারির ২০-২৫টি কোম্পানি ছাড়া প্রায় সব কোম্পানিরই বিক্রি কমেছে।
বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে সক্রিয় ওষুধ কোম্পানি ২৬৯টি। এসব কোম্পানী স্থানীয় বাজারে চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণের পর বিশ্বের ১৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
শীর্ষ ১০ কোম্পানির ৭১ শতাংশ বাজার
আইকিউভিআইএর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ শেষে দেশের মোট ওষুধের প্রায় ৭১ শতাংশই শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের। এক বছর আগেও এ কোম্পানিগুলোর বাজার অংশীদারিত্ব ছিল ৬৯ শতাংশের কম। রেমডিসিভির, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেকটিনসহ কোভিড সুরক্ষার কয়েকটি ওষুধ উৎপাদনের মাধ্যমে গত এক বছর ধরে বাজার অংশীদারিত্ব বাড়িয়েছে এসব কোম্পানি।
এসব কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, কোভিডের কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী সাপ্লিমেন্টের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে ভোক্তা পর্যায়ে ভিটামিন সি ও ডি সাপ্লিমেন্টের চাহিদায় বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। ফলে তারা এসব সাপ্লিমেন্টের সরবরাহ ও বিক্রি বাড়িয়েছে। এ সময় চিকিৎসকদের আস্থা ধরে রাখার পাশাপাশি কোভিডকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগ দিয়েছেন তারা। আর এ কারণেই সামগ্রিক বিক্রি বেড়েছে।
দেশে ওষুধ খাতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মা। দেশে ওষুধ শিল্পের বাজার অংশীদ্বারিত্বে প্রায় ১৭ শতাংশ দখলে থাকা কোম্পানিটি গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ২৩.৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে।
আইকিউভিআইএর তথ্যমতে এই সময়ে কোম্পানিটি ৪ হাজার ৭১৫ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের হেড অব অপারেশন মিজানুর রহমান বলেন, "স্বাভাবিকভাবেই কোভিডকেন্দ্রিক ওষুধের চাহিদা বেশি ছিল। আমরা এসব ওষুধ বিক্রিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। এছাড়া দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও এখন বাড়ছে। ১০ বছর আগেও মানুষ অর্থাভাবে যে রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেত না, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় সে রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষ এখন চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। ফলে ওষুধের বিক্রি বাড়ছে"।
আইকিউভিআইএর তথ্যমতে, কোভিডকালীন সময়ে স্কয়ারের চেয়ে বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও বেক্সিমকো লিমিটেড। এ সময় হেলথকেয়ার ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করলেও প্রবৃদ্ধি ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে এজিথ্রোমাইসিনের পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, অ্যাসিডিটির ওষুধ বিক্রিতে বেশি সফলতা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এই সময়ে বিক্রি করেছে ২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকার ওষুধ। কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে ২৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে চতুর্থ অবস্থানে ছিল এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। করোনার এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। বিক্রি বেড়েছে ২২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।
গত মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিক্রয় প্রবৃদ্ধিতে পঞ্চম অবস্থানে ছিল অপসোনিন। কোম্পানিটির ওষুধ বিক্রিতে এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মোট বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। দেশের শীর্ষ কোম্পানির তালিকাও ৫ম অবস্থানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ খান বলেন, "কোভিডের সময়ে আমরা বেশি কাজ করেছি। জনগণকে ওষুধ পৌঁছাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এ কাজে সফলও হয়েছি। যেসব ওষুধ অনেক দেশে পাওয়া যায়নি সেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া গেছে"।