জাহাজভাঙায় শীর্ষস্থান ধরে রাখল বাংলাদেশ

করোনার প্রথম বছর অন্যান্য খাতের ন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল জাহাজভাঙা শিল্পও। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে চলতি বছর কয়েক দফা লকডাউনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি এ শিল্পে। ফলে চলতি বছর প্রথম দুই প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন) মতো তৃতীয় প্রান্তিকেও (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জাহাজভাঙায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
এ সময় দেশে আগের বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় ১৭০ শতাংশ বেশি জাহাজ ভাঙা হয়।
জাহাজভাঙা ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করা বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা সংস্থা 'শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম'-এর সর্বশেষ প্রান্তিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয়েছে ১২০টি। এর মধ্যে ৪১টি বা ৩৪ শতাংশ ভাঙা হয়েছে বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলোতে। আর ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয়েছিল ১৭০টি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ভাঙা হয়েছিল ২৪টি জাহাজ। অর্থাৎ ওই সময় মাত্র ১৪ শতাংশ ভাঙা হয়েছিল বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে অনেক বেশি। এতে দেশে রডের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বাড়তি রড তৈরির কাঁচামালের যোগান দিতে দেশে জাহাজ ভাঙার পরিমাণ বেড়েছে। পরিমাণের দিক থেকে গত কয়েক বছর ধরে জাহাজভাঙা শিল্পে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি আরও বলেন, করোনার প্রথম বছর জাহাজভাঙা শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও চলতি বছরে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। এই বছর লকডাউনের সময়ও জাহাজ ভাঙার কাজ অব্যাহত ছিল। ফলে বছরের গত ৯ মাসে জাহাজভাঙা শিল্পে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
এদিকে, ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয়েছিল ৯৬টি। আর প্রথম তিন মাসে ভাঙা হয় ১৬৬টি জাহাজ। অর্থাৎ ছয় মাসে মোট জাহাজ ভাঙা হয়েছিল ২৬৪টি। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২০টি ভাঙা হয়েছিল বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলোতে। আর প্রথম তিন মাসে ভাঙা হয়েছিল ৫৪টি। অর্থাৎ গত বছর প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা হয় ৭৪টি।
সব মিলিয়ে চলতি বছর ৯ মাসে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৫৮২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ভাঙা হয় ১৯৭টি বা প্রায় ৩৪ শতাংশ। আর গত বছর ৯ মাসে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৩৩৪টি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলোতে ভাঙা হয়েছিল ৯৮টি বা ২৯ শতাংশ। এ হিসাবে চলতি বছর ৯ মাসে (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশে জাহাজভাঙা বেড়েছে ৯৯টি।
সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছর প্রথম ৯ মাসে জাহাজভাঙায় শীর্ষে ছিল ভারত। তবে চলতি বছর দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে গেছে দেশটি। এ সময় দেশটিতে জাহাজ ভাঙা হয়েছে ১৫৫টি। এছাড়া চলতি বছর প্রথম ৯ মাসে পাকিস্তানে জাহাজ ভাঙা হয়েছে ৮৭টি, তুরস্কে ৬৭টি, চীনে পাঁচটি ও ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ৭১টি।
শিপ ব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৬৩০টি। এর মধ্যে ভারতে ভাঙা হয়েছে ২০৩টি, বাংলাদেশে ১৪৪টি, পাকিস্তানে ৯৯টি, তুরস্কে ৯৪টি, চীনে ২০টি ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬০টি। আর ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা হয় ৬৭৬টি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই ভাঙা হয়েছিল ২৩৬টি। এছাড়া ভারতে ২০০টি, তুরস্কে ১০৭টি, পাকিস্তানে ৩৫টি, চীনে ২৯টি ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৬৯টি জাহাজ ভাঙা হয়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর জাহাজভাঙায় পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ওই সময় বিশ্বব্যাপী জাহাজভাঙার পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি ৫৮ লাখ ৬৬ হাজার ৭০৪ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশে জাহাজভাঙার পরিমাণ ছিল ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭৪ টন। এতে পরিমাণের দিক থেকে টানা ছয় বছর শীর্ষস্থান ধরে রাখে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ীসহ বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে। পাশাপাশি আবাসন খাতেও মন্দা কাটতে শুরু করেছে। এর প্রভাবে দেশে রডের চাহিদা বেড়ে যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পেও লোহার ব্যবহার বেড়েছে। এ চাহিদা পূরণে অন্যতম ভূমিকা রাখে জাহাজভাঙা শিল্প। ফলে এ শিল্পে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।