চাকরি হারিয়ে কেউ তারা রিক্সা চালান, কেউ ফেরি করেন চা-বিড়ি

ক্লিন শেভ করা পরিচ্ছন্ন চেহারা, হাতে স্মার্টফোন, পরনে প্যান্ট, গেঞ্জি- দেখলেই বোঝা যায় রিক্সাচালকের পেশায় নতুন এসেছেন আজিজুর রহমান।
আজিজুর রহমান এসএসসি পাস করে পরিবারের অভাব ঘুচানোর জন্য চাকরির উদ্দেশ্যে তিন বছর আগে জামালপুর থেকে ঢাকায় আসেন। পুরান ঢাকায় একটি প্লাস্টিক কোম্পানিতে ১৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছিলেন, কিন্তু করোনায় চাকরি চলে যায় আজিজুরের।
টিবিএসকে আজিজুর রহমান বলেন, "করোনায় মালিকের আয় না থাকায় সাত মাসের বেতন ছাড়াই ছাঁটাই করে দেয়। তারপর দীর্ঘদিন বেকার ছিলাম, কিন্তু মা-বাবা ও পরিবারের ছোট ভাই-বোনের খরচ আমাকেই বহন করতে হয়। তাই চোখে-মুখে কোন উপায় না দেখে শেষে এখন ঢাকাতে রিক্সা চালাই। আমার পরিবার কিন্তু জানে না আমি ঢাকাতে রিক্সা চালাই, রিক্সা চালাই শুনলে তারা অনেক দুঃখ পাবেন, কিন্তু রিক্সা চালানো ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কোন পথ খোলা নেই!"
আজিজুরের মতোই করোনায় চাকরি হারিয়ে এখন সবজি বিক্রি করেন রাসেল আহমেদ (৩৫)।
রাসেল আহমেদ নারায়ণগঞ্জের একটি চালের আড়তে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। গত বছরের প্রথম লকডাউনেই চাকরি হারিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালে চলে যান; করোনায় নতুন কোন কাজ না পাওয়ায় ৫ সদস্যের সংসার চালাতে প্রায় এক লাখ টাকা ঋণ করেন। গত তিন মাস আগে ঢাকায় একটি মুদি দোকানে চাকরি নেন, সেখানেও দোকান মালিকের আয় কমে যাওয়ায় আবারও চাকরি হারান। সর্বশেষ কোন উপায় না দেখে সুদের উপর আবার ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বর্তমানে ঢাকার হাতিরপুলে ভ্যানের উপর আম ও সবজি বিক্রি করছেন।
রাসেল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "বাধ্য হয়ে এখন আমি রাস্তায় রাস্তায় কাচাঁ সবজি বিক্রি করি। করোনায় মানুষের হাতে টাকা নেই, সারাদিনে পাঁচ টাকাও টিকে না, মাসে মাসে ঋণের টাকার সুদ দিতে হয়। ঢাকায় ঘর ভাড়া এবং গ্রামে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে গেলে আর কোন টাকাই থাকে না। এই করোনায় সংসার নিয়ে মহাকষ্টে আছি"।
দেশের ৬৪ জেলায় ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই। করোনায় অনেকেরই পরিবর্তন হয়ে গেছে পেশা।
৩১শে মার্চ থেকে ৫ই এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়।
মাহফুজুর রহমান (৩০) নামের আরেকজনের সাথে কথা হয়। তিনিও একটি বায়িং হাউজে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন, করোনার প্রভাবে এ বছরের মার্চে তিনি চাকরি হারান।
মাহফুজুর রহমান বলেন, "আমাকে প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়, স্ত্রী-সন্তান ও গ্রামের বৃদ্ধ বাবা-মাকেও টাকা পাঠাতাম। করোনায় চাকরি হারিয়ে সংসার চালাতে চোখেমুখে উপায় দেখছিলাম না, তাই এখন রিক্সা চালাই। আশা করি করোনা চলে গেলে আবার ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যাব"।
এদিকে দেখা যায় করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে অনেক মানুষ নতুন করে কাজের সন্ধানে রাজধানী ঢাকায় এসেছেন। এদের কেউ কেউ রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ চা, পান-সিগারেট, মাস্ক বিক্রি করেন; অনেকে রিক্সাও চালান।
নোয়াখালী থেকে আসা শাকিবুর রহমান (২২) চট্টগ্রাম শহরের একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন। করোনায় চাকরি চলে গেলে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে বেশ কিছুদিন রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে কনস্ট্রাকশনের কাজ কমে যাওয়ায় ঢাকায় এসেছেন কাজের সন্ধানে। করোনায় সবকিছু বন্ধ থাকায় এখন ভাড়া রিক্সা চালান ঢাকা শহরে, থাকেন আদাবরের একটি বস্তিতে চাচাতো ভাইয়ের সাথে।
শাকিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "করোনা ভাইরাসের তিন মাসে আগে আমি বিয়ে করি। নিজের সংসার ও অসুস্থ বাবা-মার ওষুধ খরচের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে কাজের আশায় ঢাকায় এসেছি। এখন এখানে রিক্সা চালিয়ে ৭০০-৮০০ টাকা আয় করতে পারি"।
শাকিবের মতো আনিসুর রহমানও নতুন কাজের আশায় ঢাকায় এসেছেন। লকডাউনে কোন কাজ না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে এখন রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেট বিক্রি করেন, থাকেন বাংলামোটর ঢালের একটি বস্তিতে। আগে কিশোরগঞ্জ শহরে একটি কাপড় দোকানের সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। করোনায় তারও চাকরি চলে যায়।
আনিসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "তিন বছর আগে বিদেশ যাওয়ার জন্য আদম ব্যাপারীকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে ধরা খাই। করোনায় সেলসম্যানের চাকরি চলে যায়। সব মিলিয়ে বর্তমানে আমার ২ লাখ টাকা ঋণ আছে, তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় এখন রাস্তায় রাস্তায় চা-সিগারেট বিক্রি করি"।
সরকার এই লকডাউনে দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যান চালক, মোটর শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ যারা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন, তাদের সহায়তার জন্য ৭৬০ কোটি টাকা প্রণোদনা বরাদ্দ দেন। ঠিক কতটা কার্যকর হয়েছিল সরকরের ঘোষিত এই প্রণোদনা?
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "সরকারের এই প্রণোদনা তেমন কার্যকর হয়নি, কারণ তা চাকরি হারানো মানুষের তুলনায় খুবই সামান্য"।
তিনি বলেন, "করোনায় প্রায় এক কোটি নিম্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এভাবে লকডাউন চলতে থাকলে এর সংখ্যা দিন দিন বাড়বেই, সরকারের উচিত এ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তদের মোবাইল সেবার মাধ্যমে অন্তত ১২ মাস দুই হাজার টাকা করে প্রণোদনা দিয়ে বেঁচে থাকতে সহায়তা করা"।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশের বড় একটা সংখ্যক মানুষ এই কোভিডে চাকরি হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের"।
"সরকারের উচিত যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দিয়েছেন তাদের বাধ্য করা যাতে করোনায় কোন শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত না করে, যেসব প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেয়া হয়নি তাদেরও প্রণোদনা দেয়া দরকার যাতে শ্রমিক ছাঁটাই না করে। পাশাপাশি যারা সমাজের উচ্চবিত্ত, সরকারি চাকুরীজীবী, ব্যাংকার ইত্যাদি স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তাদের থেকে করোনাকালীন কর আরোপ করে কাজ হারানো মানুষের সহায়তা করতে হবে", বলেন সায়মা হক।