কোরবানি কম, চামড়ার দামও কম

রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস এলাকার ট্রপিকেল হাউজিংয়ের ২৮টি আবাসিক ফ্লাটের বাসিন্দারা গত বছরের ইদুল আজহাতে ১৬টি গরু ও ৪টি ছাগল কোরবানি দিয়েছিলেন। এবার সেখানে মাত্র ৬টি গরু ও ২টি ছাগল কোরবানী দেওয়া হয়েছে। ট্রপিকেল হাউজিংয়ের বাসিন্দা আইনজীবী সগীর হোসেন বলেন, করোনার কারণে এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা যৌথভাবে কোরবানির আয়োজন করেছিলেন।
তিনি বলেন, করোনার কারণে অনেকের আয় কমেছে। আবার অনেকের চাকরি ও ব্যবসা নেই। ফলে এই আবাসিক ভবনে কোরবানির এই অবস্থা।
আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ১৫ নম্বর সড়কের একজন বাসিন্দা জানান, গত বছর তাদের আবাসিক ভবনে ৬-৭টি পশু কোরবানি হয়েছিল। এবার সেখানে ৩টি কোরবানি হয়েছে।
রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে এবারের কোরবানিতে। রাজধানীর চামড়ার ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গতবারের চেয়ে এবার অর্ধেকরও কম পরিমাণ চামড়া তারা সংগ্রহ করছেন বেপারিদের কাছে বিক্রির জন্য। বেগুনবাড়ি এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম পিন্টু ও সাইফুদ্দিন। গত বছর তারা দুইজনে প্রায় এক হাজার গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এবার মাত্র ৪০০টি চামড়া সংগ্রহ করেছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান শনিবার রাতে বলেন, এবার কোরবানীর পশুর পরিমাণ রাজধানীতে অর্ধেকরও কম।গত বছর যে পরিমাণ চামড়া কেনা হয়েছিল এবার তার ৭০ শতাংশ কম চামড়া কেনা হয়েছে শনিবার রাত ৮ টা পর্যন্ত। তিনি বলেন, সারাদেশে গতবারের তুলনায় অর্ধেক কম পরিমাণ চামড়া কেনার লক্ষ্য রয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের।
এদিকে কোরবানির গরু-ছাগলের চামড়ার কেনাবেচা নিয়ে বিক্রেতা ফরিয়া ও বেপারি, তিনপক্ষই অসন্তুষ্ট। বিক্রেতারা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত মূল্য পাচ্ছেন না তারা। ফরিয়ারা বলছেন, যে দামে বিভিন্ন মহল্লা থেকে চামড়া কিনেছে, সেই দামে বেপারিদের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না।
আর বেপারিরা বলছেন, যে দামে চামড়া কেনার কথা সে দামে পাচ্ছেন না তারা। চামড়ার বাজারের এই অবস্থার কারণে অনেকেই তাদের পশুর চামড়া বিভিন্ন এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন।
এর বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশু কোরবানির যে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে তাতেও উপরের কারণগুলোই স্পষ্ট। করোনা আর ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের বকেয়া।
মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার বিক্রেতা চামড়ার ক্রেতা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলেও চামড়া বিক্রি করতে পারেনি অনেকই।
জেলায় অর্ধ লক্ষাধিক পশু কোরবানীকৃত প্রস্তুত করা হয়েছিলো। কিন্তু চামড়া বেচা কেনা নেই বললেই চলে। দুপুরের আগেই জেলার সকল কোরবানী সম্পন্ন হলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত ন্যায্য বাজারদর না পাওয়ায় চামড়া বেচাকেনা থেমে গেছে।
ট্যানারি মালিকদের সাড়া কম থাকায় এবং টাকা বকেয়া থাকায় চামড়া কেনায় অনিহা খুচরা ব্যবসায়ীদের।
জেলার সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া এলাকার হাজী পান্নু মিয়া বলেন, এক লাখ সাত হাজার টাকা দিয়ে ষাঁড় কিনে কোরবানি দিয়েছি। সারাদিন অপেক্ষায় থেকেও গরুর চামড়া বিক্রি করতে পারিনি।
মানিজগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ী শিতারাম মনিদাস বলেন, মাঝারি সাইজের গরুর চামড়া দুইশো টাকা এবং বড় গরুর চামড়া তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো টাকায় কেনা হচ্ছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকেরা চামড়া নিতে আগ্রহি না। সরকার নির্ধারণ করা দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকেরা এসব দামের তোয়াক্কা করে না। প্রতি বছর চামড়া ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। চামড়ার মাপেও কম ধরেন। দরদামে ঝামেলা করলে চামড়া রিজেক্ট করে দেন।
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম চামড়া বাজার নাটোরে। প্রতিবছর নাটোরের এ বাজারে ১০ থেকে ১২ লাখ পিস চামড়া বেচা-কেনা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এখানে চামড়া বিক্রির খবর পাওয়া গেছে মাত্র ৮০ হাজার পিস।
এদিকে করোনার প্রভাবের পাশাপাশি ঢাকায় ট্যানারি মালিকদের কাছে বগুড়ার ব্যবসায়িদের বড় অংকের টাকা আটকে যাওয়ায় পাইকারী ব্যবসায়িদের অনেকেই চামড়া কিনছেন না। ফলে মৌসুমী ব্যবসায়িদের পাশাপাশি লোকশান গুণতে হচ্ছে ফরিয়াদেরও।
বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবাসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকার জানান, 'বগুড়ার ১৬ জন ব্যবসায়ির অন্তত ৩০ কোটি টাকা আটকে আছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। 'আমার নিজের এবং দুই ভাইয়ের প্রায় ৭ কোটি টাকা আটকে আছে ঢাকার মালিকদের কাছে। এ অংক আরোও বেশি ছিল কিন্তু গত ৩ বছরে কিছু টাকা শোধ করেছেন ট্যানারি মালিকরা।'
পুঁজি সংকটের কারণে অন্তত ১৫ জন চামড়া ব্যবসায়ী এবারের ঈদে চামড়া কিনছেন না। টানা প্রায় ২০ বছর ধরে চামড়া বেচাকেনা করেন বগুড়া শহরের মোঃ নাসের। এবার চামড়া বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গত বছর ঈদে বেলা ৪টার মধ্যে চামড়া সংগ্রহ করেছি প্রায় ৩শ পিস। কিন্তু এ বছর এ সময়ে হাতে এসেছে এপর্যন্ত, মাত্র একশ চামড়া।'
বাজারের এমন পরিস্থিতির কি কারণ? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, 'গত বছর ১ লাখ টাকা মূল্যের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকায়। এবার ওই মূল্যের চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮শ টাকায়। আর ৮০/৯০ হাজার টাকার মূল্যের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৭শ টাকায়।'
মৌসুমী ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন জানান, সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনে লোকশান গুনতে হয়েছে তাকে। তার মতই কাহালুর মৌসুমি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি থেকে ৫০ পিস চামড়া কিনে শহরের থানা মোড় এলাকায় পাইকারী বাজারে বিক্রি করে লোকশান দিয়েছেন ৬ হাজার টাকা।
বেশির ভাগ চামড়া ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, কোরবানি কম হওয়াতে বাজারে চামড়ার আমদানী কম। বগুড়ার ঠনঠনিয়ার মো: আশরাফ আলী জানান, এবার সকালে কোরবানির পর দুপুর পর্যন্তও চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। ৮০ হাজার টাকায় কেনা গরুর চামড়া দাম বলছে ৪শ-সাড়ে ৪শ টাকা। শেষে সাড়ে ৪শ টাকায় বিক্রি করেছি।'
অন্যদিকে বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড: মো: রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, এবার বগুড়ায় কোরবানির পশু ছিল ৩ লাখ ২৭ হাজার। চুয়াডাঙ্গায় ছাগলের চামড়া ২০ টাকা আর গরুর চামড়া ২শ টাকায় দরে বিক্রি হচ্ছে। চামড়ার ক্রেতা নেই। তাই নাম মাত্র দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতারা।
চামড়ার দাম কম থাকায় এতিমখানা ও মাদ্রসা কর্তৃপক্ষ নিজেরাই লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করছেন, পরে বেশি দামে বিক্রির আশায়। চুয়াডাঙ্গার চামড়ার আড়তগুলোতেও চামড়া কম আসছে। জানা যায়, কোরবানির ঈদে জেলায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল। করোনা ভাইরাসের কারণে সাধারণ মানুষ কম কোরবানি দিয়েছেন এবার।
রংপুরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন। গ্রাম থেকে ৪শ-৫শ টাকায় চামড়া কিনে এখন তারা বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে ৫০ থেকে ২০০টাকায়। ছাগলের চামড়া ৫ টাকায়ও কিনছে না কেউ। সরকার গত বছরের চেয়ে এবার প্রতিবর্গ ফুট চামড়ার দাম ১০ টাকা কমিয়েছে। লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, ছাগল ১৫ থেকে ১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর ঢাকার বাইরে গরুর চামড়া ২৮ থেকে ৩২ টাকা এবং ছাগলের চামড়ার দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকা।
কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই দামে চামড়া কেনা-বেচা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
গাজীপুর জেলার কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হয়নি বলে অভিযোগ করছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। চামড়া কিনে বিক্রি করতে এসে দাম না পাওয়ার অভিযোগ করছেন তারা। একটি গরুর চামড়া গড়ে ২০০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনসহ জেলার কোরবানি দেয়ার বিভিন্ন স্পট থেকে চামড়াগুলো কিনে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে কিছুটা লাভের আশায় তারা মূলধন বিনিয়োগ করলেও চামড়ার বর্তমান বাজার নিয়ে হতাশ তারা।
চুয়াডাঙ্গার আড়তদাররাও বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে তারা বকেয়া টাকা পায়নি। এ বছর ধারদেনা করে চামড়া কিনছেন।
চুয়াডাঙ্গা রেলবাজারের চামড়া আড়তদার সামসুল আলম জানালেন, গত বছরের টাকা পাননি এখনও ট্যানিরি মালিকদের কাছ থেকে। এ বছর ধার করে চামড়া কিনছেন।
চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়া খাদেমুল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানান, চামড়ার দাম হতাশাজনক, তারা এখন চামড়া বিক্রি না করে নিজেরাই লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন। তবে নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি করতে না পারলে এই চামড়া মাটিতে পুতে ফেলতে হবে।
সাতক্ষীরাতেও কোরবানির চামড়ার বাজার মন্দা। এখানে ছাগলের চামড়া ১০ টাকা আর গরুর চামড়া ৫০ টাকাতেও বিক্রি করছেন কেউ কেউ। সাতক্ষীরার তালা সদরের খড়েরডাঙ্গা গ্রামের আনার আলী সরদার জানান, গরুর চামড়া নিতে চাইছে না চামড়া বেপারীরা। দাম বলেছে, ৫০ টাকা।
তালা উপজেলার শিবপুর গ্রামের মতিয়ার সরদার ১০ টাকায় বিক্রি করেছেন একটি ছাগলের চামড়া। তালা বাজারের চামড়া ব্যবসায়ী গোবিন্দ দাস বলেন, মাঝারি সাইজের গরুর চামড়ার মূল্য ৫০ টাকা আর বড় সাইজের গরুর চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা। ছাগলের চামড়ার মূল্য ১০ টাকা।
চামড়ার দাম কমের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, একটি চামড়া কিনে আমাকে ১০০-১৫০ টাকার লবণ লাগাতে হবে। তারপর বিক্রি করতে হবে। আমি ১৫০-২০০ টাকার বেশী বিক্রি করতে পারবো না।