অটোমাবাইলে খাতে বিনিয়োগ টানতে বিপুল প্রণোদনাসহ খসড়া নীতিমালা প্রকাশ

অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বিপুল প্রণোদনার প্রস্তাবসহ 'অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা, ২০২০'-এর খসড়া প্রকাশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
নীতিমালায় দেশে সিকেডি অটোমোবাইল ও পার্টস উৎপাদন কারখানা স্থাপনে আগ্রহী দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, ও দেশে উৎপাদিত সিকেডি ও এসেম্বলিং যানবাহন রপ্তানিতে শুল্ক ও করে বিশাল ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি নগদ প্রণোদনারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালাটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে স্টেকহোল্ডারদের মতামত চেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
নীতিমালায় বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতি ও বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বাস, ট্রাক, অটোরিকশা ও তার যন্ত্রাংশ তৈরি, পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক মোটরযান তৈরি এবং এজন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
নীতিমালায় ২০২১ সাল থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশ অটোরিকশা থেকে সাভ, প্যাসেঞ্জার কার থেকে বাস-ট্রাকের অন্তত ৩০-৫০ শতাংশ দেশেই তৈরির লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জাপানের মিৎসুবিশি করপোরেশনের সহযোগিতায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ দেশে গাড়ি তৈরি করবে। বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপানের অটোমোবাইল জায়ান্ট টয়োটাও।
এ ছাড়াও ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। নিটল-নিলয়সহ দেশি উদ্যোক্তারাও এ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতেই প্রণোদনার বিস্তারিতসহ খসড়া নীতিমালাটি প্রকাশ করেছি। জাপানের সহায়তা নিয়ে নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে।'
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত বছর ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাউকি শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপান ইকোনমিক জোনে টয়োটার বিনিয়োগ আগ্রহের কথা জানান।
রাষ্ট্রদূত অটোমোবাইল শিল্পের জন্য একটি বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়নেরও পরামর্শ দেন। এ প্রেক্ষিতেই শিল্প মন্ত্রণালয় এই নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করে।
গত সেপ্টেম্বরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও জাপানি রাষ্ট্রদূত টয়োটার বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অটোমোবাইল খাতে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, স্থানীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে এসেম্বলার্স ও মূল যন্ত্রপাতি উৎপাদকদের সহায়তা দেবে সরকার। স্থানীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতে আমদানি শুল্ক বাড়ানো ও উৎপাদনখাতে বিনিয়োগকারীদের কর ছাড় দেওয়া হবে।
প্যাসেঞ্জার কার, থ্রি-হুইলারস, বাস, ট্রাক, ট্রাক্টরসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও এসেম্বলিং কারখানা স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা দেবে সরকার। আমদানি বিকল্প যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কারখানা ৭-৮ বছরের কর অব্যাহতি সুবিধা পাবে।
অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগকারীরা তাদের বার্ষিক টার্নওভারের ১ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নখাতে ব্যয় করলে তারা কর মওকুফ সুবিধা ও আমদানি শুল্কে বিশেষ রিবেট পাবেন। স্বয়ংসম্পূর্ণ অটো-ডিজাইন প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীরা কর সুবিধা পাবেন।
বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত গাড়ির উপাদান, ব্যাটারি বা চার্জিং স্টেশন স্থাপনে সরকার বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে। এজন্য প্রযুক্তি আহরণের সুবিধার্থে একটি তহবিল গঠন করবে সরকার।
খসড়া নীতিতে একটি অটো পার্টস উৎপাদন উন্নয়ন ফান্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দেওয়া হবে।
খসড়া নীতিমালায় প্রস্তাব করা বিভিন্ন সুবিধা ও প্রণোদনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা গেলে তা অটোমোবাইল খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এরকম একটি নীতি প্রণয়নের জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে আসছেন তারা।
নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অটোমোবাইল খাতে বিনিয়োগ নিয়ে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে কার্যকর করা হলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।
তিনি জানান, 'আমরা কিশোরগঞ্জে ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎচালিত গাড়ি উৎপাদনের প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। কোভিডের কারণে কার্যক্রম আপাতত স্থগিত আছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে এবং বিদেশিদের আসা-যাওয়া শুরু হলে প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা গাড়ি উৎপাদন করতে পারব।'
ব্যবসাবান্ধব নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়ে পিএইচপি অটোমোবাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আখতার পারভেজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এটি স্থানীয় অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিকে উৎসাহ যোগানোর একটি সাময়িক নীতিমালা। এই নীতিমালা প্রণয়ন করলে আমাদের মানুষদের আর পুরনো গাড়ি চালানোর দরকার পড়বে না। সেকেন্ড হ্যান্ড কার আমদানি করতে হবে না আমাদের। বাংলাদেশে তৈরি ব্র্যান্ড নিউ কার আমরা ব্যবহার করতে পারব।'
'একটি ব্র্যান্ড নিউ কার তৈরি করার জন্য আমাদের ৮৩৩২ ধরনের বিবিধ যন্ত্রাংশের প্রয়োজন পড়ে। এই নীতিমালা থেকে স্থানীয় উৎপাদনকারকরা যদি সুবিধা লাভ করে, তাহলে বাংলাদেশে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির শত-শত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে আর তা আমাদের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা,' বলেন তিনি।
অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনে গত বছর উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বিএআইএল)। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে ১০০ একর জমির ওপর ওই কারখানায় প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে কোম্পানিটি। পরবর্তী ৫ বছরে এই প্ল্যান্টে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবির।
স্থানীয় গবেষণা সংস্থা লাইট ক্যাসেল-এর তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে বাংলাদেশের অটোমোবাইল মার্কেটের আকার ছিল ৫০০ কোটি টাকারও কম। ২০১৯ সালে তা বেড়ে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।