বিপিএলের টিকিট বিক্রির অর্থ আত্মসাৎসহ ৩ অভিযোগে বিসিবিতে দুদকের অভিযান

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সদর দপ্তরে অভিযান চালিয়ে বিসিবির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নথি ও রেকর্ড সংগ্রহ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) এ অভিযান শেষে তিন সদস্যবিশিষ্ট দুদকের তদন্ত দল এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে বিপিএলের টিকিট বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ এবং ২০২০ সালে 'মুজিব ১০০' নামে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে ক্রিকেট-সংক্রান্ত ব্যয়ে অনিয়ম। কর্মসূচিটি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজনের কথা থাকলেও কোভিড মহামারির কারণে তা বাতিল হয়। এছাড়া, ঢাকার তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটের বাছাই পর্বে নিয়ম পরিবর্তনের বিষয়টিও তদন্ত করছে দুদক। তিনটি অভিযোগই সেই সময়কার, যখন নাজমুল হাসান পাপন বিসিবির সভাপতি ছিলেন।
দুদকের সহকারী পরিচালক আল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, 'এই সব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে আমরা একটি প্রতিবেদন দাখিল করব। এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।'
তিনি বলেন, 'দুদকের প্রতিটি অভিযানই নির্দিষ্ট একটি অভিযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আমরা গণমাধ্যম থেকে অভিযোগ সংগ্রহ করি। আমাদের একটি কমিটি আছে, যারা এসব অভিযোগ যাচাই করে। যাচাইয়ের পর অনুমোদন মিললে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। এই ক্ষেত্রেও ঠিক একইভাবে হয়েছে।'
দুদকের ওই কর্মকর্তা জানান, বিপিএলের তৃতীয় আসর থেকে শুরু করে টিকিট বিক্রিতে আর্থিক গরমিলের বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। আটটি আসরে টিকিট বিক্রি থেকে বিসিবির আয় হয়েছে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। অথচ একাদশ আসরেই টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ১৩ কোটি টাকা।
আল আমিন বলেন, 'বিসিবির আয়ের একটি উৎস হলো টিকিট বিক্রি। আট বছরে আয় হয়েছে ১৫ কোটি, আর এক বছরেই হয়েছে ১৩ কোটি। আমরা নথিপত্র সংগ্রহ করে বোঝার চেষ্টা করছি, এখানে গরমিলটা কোথায়।'
তিনি আরও জানান, 'মুজিব ১০০' কর্মসূচি ঘিরেও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১৭ কোটি টাকার তহবিল আত্মসাতের অভিযোগও আছে।
তিনি বলেন, 'মুজিব ১০০ কর্মসূচিতে ২৫ কোটি টাকার ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যয় ছিল প্রায় ১৭ কোটি টাকা। অভিযোগ আছে, প্রায় ১৯ কোটি টাকার ব্যয়ই দেখানো হয়নি। আমরা ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগ থেকে সেই নথি ও হিসাবপত্র চেয়েছি।'
বিসিবির সঙ্গে ঢাকার তৃতীয় বিভাগ বাছাই টুর্নামেন্টে নিয়ম পরিবর্তন নিয়েও কথা বলেছে দুদক। এই টুর্নামেন্টটি চালু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে। এটি একটি 'নন-লিগ' প্রতিযোগিতা, যেখান থেকে শীর্ষ দুই দল ঢাকার তৃতীয় বিভাগের লিগে ওঠার সুযোগ পায়। এটি ঢাকা লিগ কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তর।
নাজমুল হাসান পাপনের সময়কালে এই প্রতিযোগিতায় দলের অংশগ্রহণ ফি ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
যেহেতু এসব ছিল অপেশাদার ক্লাব, তাই অনেকেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। তবে কিছু ক্লাব বাড়তি ফি দিয়ে অংশ নেয়। তারা একটি নকআউট পদ্ধতিতে খেলে ঠিক করত, কোন দুটি ক্লাব তৃতীয় বিভাগ লিগে উঠবে। কখনও কখনও মাত্র দুই ক্লাব ফি জমা দেওয়ায় তারা সরাসরি ঢাকার তৃতীয় বিভাগ লিগে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যেত।
দুদকের সহকারী পরিচালক আল আমিন বলেন, 'নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের মধ্যে একটি হলো তৃতীয় বিভাগ বাছাই প্রতিযোগিতায় অবৈধ অর্থ লেনদেন। আমরা জেনেছি, ২০২৩ সালের আগ পর্যন্ত দলগুলো কীভাবে নির্বাচিত হতো। তখন অংশগ্রহণ ফি ছিল ৫ লাখ টাকা। মাত্র দুই-তিনটি দল আবেদন করত। সেখান থেকেই বিসিবি এক বা দুটি দল বেছে নিত। কিন্তু যখন ফি কমিয়ে ১ লাখ টাকা করা হয়, তখন ৬০টি ক্লাব এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের প্রশ্ন হলো, আগে কেন মাত্র দুই-তিনটি দল আবেদন করত, আর এবার কেন ৬০টি দল করল? আমরা এর নথিপত্র সংগ্রহ করেছি। তৃতীয় বিভাগ বাছাই প্রতিযোগিতায় দলের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত প্রভাব থাকতে পারে। আমরা জানতে পেরেছি, পাড়ার ক্লাবগুলোর জন্য এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার শর্ত পূরণ করাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।'
আল আমিন বলেন, 'গত পাঁচ থেকে সাত বছরে তৃতীয় বিভাগ বাছাই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দলগুলোর তালিকা আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা এবার এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বর্তমান বছরের শর্তাবলির সঙ্গে আগের বছরগুলোর তুলনা করব।'
তিনি আরও বলেন, 'আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, আগের বছরগুলোতে মাত্র দুই থেকে চারটি ক্লাব এই টুর্নামেন্টে অংশ নিত। অথচ এবার অংশ নিয়েছে ৬০টি দল। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, আগের বছরগুলোতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ছিল না। নিশ্চয়ই কোনও চাপ ছিল, যার কারণে ক্লাবগুলো অংশ নিতে পারেনি। আমরা সেটিই জানার চেষ্টা করছি।'
বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, এ বিষয়ে দুদককে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নথিপত্র দিতে নির্দেশনা দেবেন।