লোভনীয় নাগেট হওয়ার আগে প্রাচীনকালে মুরগি ছিল পবিত্র পাখি!

ডিম আগে না মুরগি!- আমাদের সবচেয়ে পরিচিত গৃহপালিত পাখিটির আসল রহস্যের সাথে এই তর্কের কোনো যোগ নেই। বিজ্ঞানীরা বরং জানতে চান- ঠিক কতদিন আগে ও কীভাবে জঙ্গলের এই পাখি মানুষের কাছে এসেছিল? সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ রহস্যের ধোঁয়াশা কেটেছে অনেকখানি। বিজ্ঞান জেনেছে এমন মজার সব তথ্য- যার ধারাবাহিকতায় আজকের সভ্যতায় চিকেন ফ্রাই হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় খাদ্য।
যেসব বিজ্ঞানী জৈবিক ইতিহাসের সন্ধান করেন- তারাও এক ধরনের পুরাতত্ত্ববিদ। তাই হয়তো এ দুয়ের মিশ্রণে তাদের বলা হয় বায়ো-আর্কিওলজিস্ট। এ রহস্যের সন্ধান করেন জীবের বিবর্তন নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীরাও। অতীতে তারা মুরগির মতো অতি-সাধারণ প্রাণীকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। তখনই প্রমাণ হয়েছিল মুরগি আসলেই অসাধারণ। মানে অন্তত তার ইতিহাস। কিন্তু, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা যা জেনেছেন তা আরও চমকপ্রদ। অনুসন্ধানে উঠে আসা টুকরো টুকরো তথ্য-উপাত্ত একসাথে করে যে চিত্র মিলছে—তাতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান মুরগির পূর্বপুরুষ লাল বনমুরগি এককালে পূজিত হতো পবিত্র প্রাণীর মর্যাদায়। প্রাণীটিকে খাওয়ার কথা তখনও ভাবতে পারেনি মানুষ। বরং দৃষ্টিনন্দন পাখনার চাদরে ঢাকা লাল (কেবল লাল রঙেরই নয়) বনমোরগ/মুরগিকে সভ্যতার সে পর্যায়ে কেবল প্রাচীন দেবতাদের উদ্দেশ্যেই বলি দেওয়া হতো। অর্থাৎ, খুবই সযত্নে লালিত-পালিত হতো পাখিটি। মানুষের হাতে তার প্রাণসংহারের একমাত্র উপলক্ষ ছিল বলি-প্রথা। আর সমাজে মুরগি বলি দিতে পারাটা ছিল মর্যাদারই বিষয়।
তবু মুরগি কবে ও কোথায় প্রথম গৃহপালিত হয়েছিল তার বিস্তারিত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আগের কিছু জৈব-নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ইঙ্গিত দিয়েছিল ৮ হাজার বছর আগে চীনে, ভারতে অথবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তা হয়ে থাকতে পারে। গত সোমবার (১৩ জুন) জার্নাল- প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস- এ প্রকাশিত হয় একটি গবেষণা। একইদিন সম্পর্কিত আরেকটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয় জার্নাল- এন্টিকুইটি'তে। এ দুইটি গবেষণা নিবন্ধ আরও সংশোধিত সময়কালের ইঙ্গিত দিয়েছে। সর্বশেষ এ গবেষণা দুটি বলছে, আজ থেকে সাড়ে ৩ হাজার বছরের কাছাকাছি কোনো সময়ে থাইল্যান্ডে প্রথম মুরগিকে পোষ মানানো হয়।
নিবন্ধ দুটির তত্ত্বীয় প্রস্তাবনায় (হাইপোথিসিস) দেওয়া হয়- পোষ মানানোর সবচেয়ে বাস্তব-সম্মত ব্যাখ্যা। গবেষকরা এজন্য প্রত্মতাত্ত্বিক প্রমাণ উপস্থাপন করে জানাচ্ছেন, শুকনো জমিতে ধান ও জোয়ার বা বাজরার মতো দানাদার শস্য চাষ শুরু হলে তাতে আকৃষ্ট হয়ে আসতে থাকে বনমুরগির দল। এভাবে কৃষিজীবী মানুষের সাথে তাদের সাক্ষাৎ নিয়মিত হয়ে ওঠে।
যৌথভাবে গবেষণা প্রতিবেদন দুটি 'মুরগিকে পোষ মানানো'র পূর্বাপর তত্ত্বগুলির অসারতা তুলে ধরেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীদের পোষ মানানো এবং তাদের প্রাচীন ডিএনএ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রেগর লার্সন উভয় গবেষণা নিবন্ধের লেখক। তিনি বলেছেন, এ দুটি গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, "মুরগি পোষ মানানোর সময় ও স্থান সম্পর্কে আগে আমরা কতোটা ভুল জানতাম।"
যেমন- প্রসিডিংস জার্নালের নিবন্ধে গবেষকরা ৮৯টি দেশের ৬০০টি স্থান থেকে সংগৃহীত মুরগির ফসিল বা জীবাশ্ম নমুনা আবার বিশ্লেষণ করেন। এরপর তারা দেখেন, সবচেয়ে প্রাচীন ফসিল পাওয়া গেছে থাইল্যান্ডের বান নোন ওয়াত নামক একটি প্রস্তরযুগের সাইট থেকে। মুরগির এসব হাড়ের বয়স সাড়ে ৩ হাজার বছর।
গবেষণায় আরও জানা গেছে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকেই সমুদ্রচারী বণিকেরা আরও পশ্চিমে সুদূর আফ্রিকায় নিয়ে যান মুরগি। এরপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউরোপে। এর আগে গবেষকরা ধারণা করেছিলেন, ৭ হাজার বছর আগে ইউরোপে মুরগি আসে। কিন্তু, এখন জানা যাচ্ছে আনা হয়েছিল মাত্র ২,৮০০ বছর আগে। এরপর ইউরোপের উত্তর প্রান্তে মুরগি ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগেছিল আরও শত শত বছর। স্ক্যান্ডেনেভিয়া ও স্কটল্যান্ডের মতো অঞ্চলে পৌঁছাতে লেগে যায় আরও অন্তত হাজার বছর।
প্রসিডিংস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের আরেক লেখক ও জার্মানির মিউনিখের লুদউইগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী জরিস পিটার্স বলেন, "এই গবেষণা মুরগি পালনের আদিম উৎস ও সম্পূর্ণ ইতিহাসকে নতুন করে লিখেছে।"
এদিকে এন্টিকুইটি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় মুরগির হাড়ের ২৩টি নমুনার রেডিওকার্বন ডেটিং- এর তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, আগে তিন-চতুর্থাংশ নমুনার বয়স ভুলভাবে নির্ণিত হয়েছিল। যেমন মরক্কোতে পাওয়া আধুনিক যুগের মুরগির হাড়কে (১৯৫০ বা তার পরের সময়ের) লৌহ যুগের সময়কালীন হাড় হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল।
এই গবেষণা নিবন্ধের একজন লেখক জুলিয়া বেস্ট জানান, ভৌগলিক ও নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির তুলনায় রেডিওকার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে আমরা মানুষের সাথে মুরগির পরিচিতির প্রথম দিকের ঘটনাবলী সম্পর্কে সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র পেয়েছি।

এভাবেই পাওয়া গেছে প্রাচীনকালে মানুষ কীভাবে মুরগিকে পালন করতো তার সুস্পষ্ট ধারণা। যেমন- ব্রিটেন ও ইউরোপের লৌহযুগের পুরাতাত্ত্বিক স্থানগুলিতে পূর্ণবয়স্ক মুরগিকে কবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তাদের হত্যা করা হয়েছে এমন কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকী একটি সমাহিত মুরগির পায়ের জখম তার জীবনকালেই সেরে ওঠার প্রমাণও পান তারা। এতে ইঙ্গিত মেলে যে, মুরগিটি খুব যত্নে পালিত হতো, এবং কোনো কারণে এটি জখম হলে মানুষই সেটিকে পরিচর্যা করে সারিয়ে তুলেছিল।
এসব ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, মানুষ হয়তো প্রথমেই মুরগি খেতে শুরু করেনি। বরং পাখিটির বর্ণিল রঙ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল। মানুষের সাথে সাথে দুনিয়াজুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল মুরগি; আর এটিকে বহনকারী প্রায় সকল মানবগোষ্ঠীকে পাখিটিকে সম্মানের সাথে দেখতো।
উভয় গবেষণার আরেকজন লেখক ও ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের বিশেষজ্ঞ নাওমি সাইকস বলেন, " শত শত বছর ধরে মুরগি পূজিত হয়েছে, তাদের ছিল সেলিব্রেটি মর্যাদা।" এর অনেক পরে এসে আমরা নিয়মিতভাবে পাখিটি খেতে শুরু করি।
মানুষের সাথে নতুন স্থানে আসার পরও সেখানে মুরগি খাওয়া শুরু হয়নি। পাখিটির সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের জানতে আরও শত শত বছর লেগে যায়, এবং তারপরই মানুষ বুঝতে পারে এর মাংস সুস্বাদু ও ভোজ্য। যেমন- রোমানরা যখন ব্রিটেনে আগ্রাসন চালায়, তারা এসে মুরগি খেতে শুরু করে। কিন্তু, ব্রিটেনের স্থানীয়রা তখনও মুরগি খেত না। উল্লেখ্য, রোমানরা ছিল ইতালীয়- তারা ইউরোপের দূরতম অঞ্চলটির অনেক আগেই মুরগির মাংসের স্বাদের সাথে পরিচিত ছিল।
মুরগি পালন আজ শুধু খেত-খামার পর্যায়ে নয়- হচ্ছে শিল্পায়িত আকারে বিশাল সব বাণিজ্যিক খামারে। এসব খামার দৈনিক কোটি কোটি মুরগি মানুষের খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করে। কিন্তু, বাণিজ্যিক খামারের অমানবিক পরিবেশে মুরগি পালন দীর্ঘদিন ধরেই প্রাণী-অধিকার কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। তাদের প্রতিবাদের মুখেই, এখন উন্নত বিশ্বে ল্যাবটেরিতে কৃত্রিমভাবে চামড়া ও হাড়হীন মাংস তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছে, যার স্বাদ হবে আসল মুরগির মতোন।
অর্থাৎ, আরও একবার মানব সভ্যতায় গৃহপালিত এ পাখির অধিকার আলোচিত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা তাদের সাম্প্রতিক গবেষণার বরাতে জানাচ্ছেন, মুরগির লালন-পালন খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। আর ততোটা প্রাচীন নয় যতোটা ধারণা করা হয়েছিল। তবে খুব দ্রুতই তা দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
ড. লার্সন জানান, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে থাইল্যান্ডে শুস্ক জমিতে বিশেষ পদ্ধতিতে হতো ধানের চাষ। বনমুরগি শুস্ক স্থানে বিচরণ করতে পছন্দ করতো, তাই এসব ক্ষেত তাদের বিচরণ ভূমি হয়ে ওঠে। "আর এভাবেই মানুষের সাথে তাদের সম্পর্কের শুরু"- যোগ করেন তিনি।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস