রেবেকা: বাংলাদেশের প্রথম নারী চলচ্চিত্র পরিচালক

'রেবেকা শিল্পী। পাথর কেটে মাটি ছেনে কাঠ কুঁদে সৃষ্টি করেন লাবণ্যময় দ্যুতিময় মানব-মানবী, অমূর্তকে অপরূপে রূপদান করেন তিনি। ১৯৭০ সনে আমাদের শৈশবে, চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি তার প্রেমের, শ্রমের এবং মেধার ফসল 'বিন্দু থেকে বৃত্ত'। সেই মেধাবী আঙুলেরই সৃষ্টি 'ব্যাকুল বৃষ্টির ঠোঁটে'। এটি কবির প্রথম কাব্য প্রয়াস।'
কথাগুলো বলেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রপরিচালক রেবেকার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ব্যাকুল বৃষ্টির ঠোঁটে'র ভূমিকায় কবি এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন রেবেকাকে।
বাংলাদেশের প্রথম নারী পরিচালক রেবেকা। তার পরিচালনায় একমাত্র ছবি 'বিন্দু থেকে বৃত্ত' মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। ছবিটিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি। তবে অভিনয় তিনি আরও আগে থেকেই করতেন। পরিচালনা বা অভিনয়ের পাশাপাশি রেবেকা ভাস্কর ও কবি হিসেবেও নাম কুড়িয়েছেন।
রেবেকার পুরো নাম মনজর আরা বেগম। ডাকনাম ছিলো বকুল। ১৯৪১ সালের ১১ মার্চ পাবনার হায়দারপুরের পৈলানপুরে বাবার বাড়িতে তার জন্ম হয়।
তার বাবা শেখ বাহাদুর আলী ছিলেন পাবনা শহরের কংগ্রেস নেতা। পেশা ছিলো জর্জকোর্টের জুরি। পাশাপাশি সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ ছিলেন। থিয়েটার করতেন। রেবেকার মায়ের নাম মেহেরুন্নেসা। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে রেবেকা চতুর্থ।
বেবেকা মারা গেছেন ২০০৭ সালে। তার শৈশব কৈশোর ও কাজ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সঙ্গে। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে 'বিন্দু থেকে বৃত্ত : একজন রেবেকার কথা' নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। গবেষনাধর্মী বইটির লেখক সুচিত্রা সরকার। বইটিতে রেবেকা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। রেবেকা সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের সঙ্গে। তিনিও বেশ কিছু তথ্য যোগ করেন।
রেবেকার শৈশব
ছোটবেলা থেকেই রেবেকা ছিলেন খুব জেদী, একরোখা এবং দুরন্ত। জানা গেছে রেবেকার দাদি ও বাবা তাকে খুব আদর করতেন। দাদিও ছিলেন খুব ডানপিটে। সেই স্বভাবটাই পেয়েছিলে রেবেকা। জন্মস্থান পৈলানপুরে কেটেছে তার শৈশব। আদরেই বড় হয়েছেন তিনি।
সেখান থেকে রেবেকার পরিবার পাবনা শহরে তাদের আরেকটা বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করে। একইসঙ্গে তার স্কুলজীবনও শুরু হয়। ভর্তি হন গান্ধী বালিকা বিদ্যলয়ে। এই স্কুলে ওই সময় ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে পড়তো। ওই সময় সুচিত্রা সেনের ছোট বোন রেবেকার সহপাঠী ছিলো।
এক সাক্ষাৎকারে রেবেকা তার স্কুল জীবন সম্পর্কে বলেন, 'বাাড়ির পাশেই গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়। স্বদেশী আন্দোলনের আর্দশে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়তাম ছেলেদের সঙ্গে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোরা চালানো, লাঠিখেলা, বন্দুক, ছোড়াসহ প্রভৃতি শরীর চর্চা করতে হয়েছে। পাশাপাশি স্বদেশী মনোভাব গড়ে ওঠানোর জন্য শিল্পকর্মে উৎসাহ দেওয়া হতো স্কুল থেকেই। এখানেই শিখেছি ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি করা, চিত্রকলার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে।'
স্কুলে সবকিছুতে দক্ষ হয়ে ওঠাই সম্ভবত রেবেকার কাল হয়ে দাড়িয়ে যায়। বিষয়টি পরিবারের অনেকেই সহজ ভাবে নিতে পারেনা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে রেবেকা শোনেন তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
বাল্য বিয়ে ও সংসার
স্কুলে থাকতেই রেবেকার বিয়ে হয়ে যায়। তবে রেবেকার বড় ছেলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন রেবেকা এসএসসি পাশ করেছেন। তার স্বামী কবির উদ্দিনের বাড়ি পাবনা জেলার সুজাননগরের উলাট গ্রামে। বিএ পাশ এই ছেলে ঢাকার সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের চাকরি করতেন।
বিয়ে নিয়ে রেবেকা এক সাক্ষাৎকারে জানান, 'বিয়ের কথা শুনে আমি কেঁদে কেটে অস্থির। কিন্তু শেষ অবধি বিয়ে হলো। বিয়েতে আমার বদলে কবুল বললেন আমার বাবা। এভাবেই মৃত্যু হলো বকুল নামের এক চঞ্চল অবুঝ এক কিশোরীর। বাল্য বিয়ের জিঞ্জিরাটি পরিয়ে দেয়া হলো আমার দেহ মনের পায়ে। আমি হলাম অবরোধ বাসিনী এক বালিকা বধূ।'
বিয়ের পর প্রথমে নারিন্দায় ছিলেন। সেখানেই তিন সন্তানের জন্ম দেন রেবেকা। বড় ছেলে রাগীব এহসান, মেঝ ছেলে শিবলী এহসান এবং ছোট মেয়ে মোনালিসা তুলি।
বিচ্ছেদ ও দ্বিতীয় বিয়ে
তিন সন্তান জন্ম দেয়ার পর রেবেকার পারিবারিক জীবনে টানাপোড়েন শুরু হয়। রেবেকা কবিতা লেখেন, ছবি আঁকেন, ভাস্কর্য গড়েন এসব অপছন্দ ছিলো তার স্বামীর। বাধ্য হয়ে রেবেকা নিজেই ১৯৬০ সালে স্বামীকে তালাক দেন। তারপর পুরোপুরি নিজের কাজে মন দেন। এরইমধ্যে অবশ্য দ্বিতীয় বিয়ে করেন হারুন নামের একজনকে। পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় শুরু করেন। এই বিয়ে টিকে ছিল বছর দশেকের একটু বেশি। ১৯৮০ সালের দিকে হারুনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় রেবেকার।
বেবেকার তিন সন্তানেরা কখনো বাবার কাছে কখনো মায়ের কাছে থাকতেন। তবে স্বাধীনতার পর পাকাপাকিভাবে মায়ের সঙ্গে থাকা শুরু করে তিন ভাইবোন।
অভিনয়ের শুরু
ছোটবেলা থেকেই অভিনয় হাতে খড়ি রেবেকার। বাবা সংস্কৃতিবান হওয়ার কারণে সবসময় একটা সাংস্কৃতিক আবহেই থেকেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অভিনয় ও পরিচালনা করতেন। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটক পরিচালনা করেন তিনি। রানা প্রতাপ নাটকে মানসিংহের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রেবেকা। পাশাপাশি নাচ গানও রপ্ত করেন।
সবকিছুতে ছেদ পড়ে বিয়ের কারনে। সেগুলো আবার নতুন করে শুরু হয় বিচ্ছেদের পর। ১৯৬৪ সালে রেবেকা প্রথমবাররের মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। জিল্লুর রহমান পরিচালিত এই তো জীবন চলচ্ছিত্রে ছোট্টএকটা চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
পরিচালক জিল্লুর রহমান গ্রীন রোডে রেবেকার পাশের বাড়িতে থাকতেন। জিল্লুর রহমানের স্ত্রীকে রেবেকা আপা বলে ডাকতেন। সেই সূত্রেই পরিচয়। তারাও জানতেন রেবেকা ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতি চর্চা করতেন। তাই জিল্লুর রহমানই প্রস্তাবটা দেন। কিন্তু পরিবারেরা লোকেরা কী ভাববে? তাই রেবেকা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য নিজের নাম পাল্টে রাখেন রাত্রি রায়।
এই তো জীবন চলচ্চিত্রে রেবেকা হয়েছিলেন ভাবী। এই একটি ছবির মাধ্যমে আরও সুযোগ আসতে থাকে তার। একে একে অভিনয় করেন প্রায় ১৫টি চলচ্চিত্রে। কখনো মা, কখনো ভাবী হিসেবে রেবেকা পর্দায় আসতেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো, জহির রায়হানের বাহানা, মুস্তাফিজের মালা, এতেহশামের ডাকবাবু, ছোটো সাহেব, আজহার হোসেনের উলঝন, বশীর হোসেনের ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন। নুরুল হক বাচ্চুর আগুন নিয়ে খেলা, মানুষ অমানুষ এবং নিজের ছবি বিন্দু থেকে বৃত্ত।
প্রথম ও একমাত্র পরিচালনা
নারী কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার এবং পরিচালিত রেবেকার প্রথম ছবি বিন্দু থেকে বৃত্ত। তার শেষ ছবিও এটি। ১৯৭০ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। কিন্তু এই ছবির নেগেটিভ বা প্রিন্ট ভার্ষন কোথাও পাওয়া যায়নি। জানা গেছে এটির নেগেটিভ ও পজিটিভ পাকিস্তানি আর্মিরা পুড়িয়ে ফেলেছে।
ছবির বুকলেট সুত্রে জানা যায়, এই ছবিতে অভিনয় করেছেন আতিয়া মফিজ, এফ আলম, রেবেকা, গোলাম আকবর, অমিতা, আনোয়ার আশরাফ, ফয়জুল্লাহ, শহীদ, অনুপ, কালিপদ, ওয়াবেয়দ, কাসেম, দুলালী, সুষমা, মুস্তাক, শাহজাহান।
পারিবারিক গল্পের এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সুনাম কুড়ান আতিয়া চৌধুরী। রেবেকার পরিচালনার ভূয়সী প্রশংসা করেন সেই সময়ের চলচ্চিত্র সমালোচেকরা।
পরিচালনা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রেবেকা বলেন, '১৯৬৯ সালের কথা। দেশের অবস্থা তখন উত্তাল। কারফিউ চলছে। ঘরের বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। সেই অবস্থায় শুরু করলাম ছবিটা। পুরুষরা যা পারে তা যে মেয়েরাও পারে- সেই বোধ চিরকাল আমার ভেতরে কাজ করেছে। একজন নারীও যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে সেটা করে দেখানোর জন্য। আমি নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি। তবে এর পটভূমি ছিলো দীর্ঘ। প্রস্তুতিও ছিলো অনেকদিনের। আসলে কোনো কিছু সৃষ্টি করবো এটাই ছিল মূল কথা। উদ্দেশ্যে তো ছিলই। প্রথমত উর্দু ছবির প্রতিবাদ। দ্বিতীয়ত নিজেদের কাজ দ্বারা এটা প্রমান করা যে চেষ্টাতে, ইচ্ছাতে সব হয়। তৃতীয়ত রাজনীতি থেকে আত্নগোপন করলেও রাজনৈতিক প্রতিবাদের বলিষ্ঠতা প্রতীকের সাহয্য প্রকাশ করা।'
মাত্র আশি হাজার টাকায় নির্মিত হয়েছিল বিন্দু থেকে বৃত্ত। এরমধ্যে ছবির নায়ক মফিজ একাই দিয়েছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা।
লেখালেখি ও অন্যান্য
রেবেকা কখনো একটি কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না। কখনো ছবি এঁকেছেন, গান শিখেছেন, অভিনয় করেছেন, বিজ্ঞাপন চিত্রে কাজ করেছেন, গীতিনাট্য রচনা করেছেন, কবিতা গল্প লিখেছেন, টিভির অনুষ্ঠান নির্মান করেছেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছয়টি। এরমধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলো, ব্যাকুল ঠোটের বৃষ্টি, নদী বুঝি ডাকে ভালোবাসার ভুখণ্ডে।
এছাড়া রেবেকা ভাস্কর গড়তেন। তার ঢাকার বাড়ির নাম ছিলো শেষের কবিতা। এই বাড়িটি তিনি সাজিয়েছিলেন নানা ধরনের ভাস্কর ও নিজের আঁকা চিত্রকর্ম দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বীকৃতি
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন রেবেকা। তার বাড়িতে রাজনৈতিক নেতারা আসতেন। তাদের কথা শুনে, দেশের জন্য কিছু করার আহব্বানে বেবেকা বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে সাথে যুক্ত হোন। আওয়ামী লীগের আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী হিসেবেও কাজ করেন। আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে শিখেছিলেন সে সময়। সে কারণে ডেথ স্কোয়াডে নাম লিখেছিলেন তিনি।
নিজের কর্মের জন্য খুব বেশি স্বীকৃতি পাননি রেবেকা। গুটি কয়েক সন্মাননা হাতে এসেছে তার। এরমধ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি কতৃক চলচ্চিত্রের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৫ সালে একটি সম্মাননা পান। সমাজ সেবায় অবদানের জন্য পাবনা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে স্বর্ণপদক পান।
তাকে নিয়ে সরকারি অনুদানে স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র 'বিন্দু থেকে বৃত্ত: একজন বকুলের আখ্যান' নির্মিত হচ্ছে। সিনেমাটি প্রায় নির্মাণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটি নির্মাণ করছেন মেহজাদ গালিব।
রেবেকা নাম নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমি আমার নাম ঠিক করেছি রেবেকা। এর অর্থ যার অস্তিত্ব নাই, অবস্থান আছে। আমার মনে হয়েছে, আমার সঙ্গে এই নামটার একটা দারুণ মিল আছে।'