বাড়বাড়ন্ত আয়না বাজার!

কয়েক হাজার বছর আগে শুধু চেহারা দেখার কাজে ব্যবহার শুরু হলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে 'আয়না'। আধুনিকায়নেও আয়না এখন বেশ বড় ভূমিকা রাখছে।
আয়না ব্যবহারের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর বাজারের পরিসরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আয়না প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে আয়নার।
গৃহসজ্জা, গাড়ির কনভেক্স মিরর (যা 'লুকিং গ্লাস' নামে পরিচিত), চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত অপটিক্যাল কনকেভ মিরর, পেরিস্কোপ, বাইনোকুলার, সড়কের দিকনির্দেশনার জন্য ব্যবহৃত আয়না ও আরও নানা ধরনের সরঞ্জাম হিসেবে আয়নার ব্যবহার হচ্ছে আজকাল।
বাংলাদেশ কাচ ডিলার ও আয়না ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার যে বাজার রয়েছে, এর মধ্যে এক হাজার কোটি টাকার আয়না স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়। আর ৫০০ কোটি টাকার আয়না আমদানি করা হয়।"
দেশে উৎপাদিত আয়নার মধ্যে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার আয়না বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৯টি দেশে রপ্তানি হয় এসব আয়না।
তিনি বলেন, আমদানি করা আয়নাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই হলো গাড়ির কনভেক্স গ্লাস বা চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত অপটিক্যাল কনকেভ মিররের মতো আয়না। চীন, তাইওয়ান, রাশিয়া, জার্মানিসহ প্রায় ১১টি দেশ থেকে এসব আয়না আমদানি করা হয়।
মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানি করা আয়নার বাজার ছিল প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে ছিল ১৩০০ কোটি টাকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় বাংলাদেশে ছোটবড় প্রায় ১২০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে আয়না উৎপাদনের জন্য। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নাসির গ্লাস অব ইন্ডাস্ট্র্রিজ, আনোয়ার গ্লাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্র্রিজ, উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, এবি গ্লাস হাউস, উত্তরা গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম ফেব্রিকেটরস, টুং হিং (বাংলাদেশ) ম্যানুফ্যাকচারার, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটস লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড গ্লাস বি,ভি এবং দ্য বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কার্স লিমিটেড অন্যতম।
সাধারণ কাচ উৎপাদনের পাশাপাশি আয়না উৎপাদন করে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান।

আয়না তৈরিতে স্বনির্ভর বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ফাইবার ও পলিমার গবেষণা বিভাগের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার স্বপন কুমার রায় জানান, "বাংলাদেশে কাচ ও আয়না নির্মাণে স্বনির্ভর। কাচ উৎপাদনের সকল কাঁচামাল বাংলাদেশে সহজে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, সাধারণত স্বচ্ছ কাচ থেকে আয়না তৈরি করা হয়।"
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, বিশেষ ধরনের বালু থেকে কাচ উৎপাদন করা হয়, যেটিকে বলা হয় 'বালু কোয়ার্টজ'। এছাড়াও ডলোমাইট, ফেল্ডস্পার, সোডা এবং এদের যৌগগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে কাচ উৎপাদনে।
কাচ থেকে আয়নাতে রূপান্তরিত করার জন্য স্বচ্ছ কাচের এক পৃষ্ঠে টাইটানিয়াম, ক্রোমিয়াম এবং অন্যান্য ধাতবের সাথে অ্যালুমিনিয়াম, আয়রন মিশ্রণের স্প্রে করতে হয়। সর্বশেষ পেইন্ট এবং বার্নিশের একটি আবরণ প্রয়োগ করা হয়।
দেশের প্রতিষ্ঠিত গ্লাস কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানও তৈরি করছে আয়না। বাংলাদেশ কাচ ডিলার ও আয়না ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, আয়না প্রস্তুতকারী প্রায় ১২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সৈয়দপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিভিন্ন বড় কোম্পানির কাছে থেকে কাচ কিনে সেটি আয়নাতে রূপান্তরিত করে বাজারে বিক্রয় করছে।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার 'ইমদাদ আয়না ঘর'-এর স্বত্বাধিকারী রাইসুল ইসলাম সৌরভ জানান, তারা সাধারণত এবি গ্লাস হাউস ও পিএইচপির কাছ থেকে উন্নতমানের স্বচ্ছ কাচ কেনার পর তা আয়নায় রূপান্তরিত করে।
আয়না তৈরির পর নিজেদের শোরুমে তারা তা বিক্রি করেন। এছাড়াও বিভিন্ন পাইকারি বিক্রেতাও এখান থেকে আয়না কেনেন।
রাইসুল ইসলাম সৌরভ জানান, চেহারা দেখার জন্য ছোট আয়না, ড্রেসিংটেবিলের আয়না, ঘরের দেয়ালে ব্যবহার করার জন্য আয়না, বাথরুমে ব্যবহারের আয়না তারা বানিয়ে থাকেন। গৃহসজ্জার জন্যও বিভিন্ন আকারের আয়না প্লাস্টিকের কভারে মুড়িয়ে, বেত ও বাঁশের সমন্বয়ে সুদৃশ্য ডিজাইন করেও তারা বাজারে সরবরাহ করে থাকেন।

প্রতিবছর প্রায় তিন কোটি টাকার আয়নার ব্যবসা করেন বলে জানান ব্যবসায়ী রাইসুল।
তিনি বলেন, সারা দেশে এ রকম ছোট ব্যবসায়ীরা বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করে থাকেন।
মিরর ফর মোটরকার
গাড়ির কনভেক্স মিররের বেশিরভাগ আমদানি করতে হয়।
রাজধানীর বিজয়নগর এলাকার 'হাসান অটো'র মালিক শহিদুল হাসান জানান, বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কারসহ চার চাকা, তিন চাকার যানবাহন ও মোটরসাইকেলে ব্যবহৃত এসব আয়নার বেশিরভাগ জাপান, চীন, তাইওয়ান থেকে আমদানি করতে হয়।
হাসান অটো শুধু গাড়ির আয়না সরবরাহ করে থাকে। প্রতিবছর এই শোরুমে পাইকারি ও খুচরা প্রায় ৫ কোটি টাকার আয়না বিক্রি হয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী।
শহিদুল হাসান বলেন, সারা দেশে এ রকম প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা গাড়ির কনভেক্স মিরর আমদানি করে থাকে। বছরে এ ধরনের আয়নার ব্যবসা হয় প্রায় ১০০ কোটির টাকার।
গৃহসজ্জায় আয়নার ব্যবসা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর, নীলক্ষেত এলাকা, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলি, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন ও গুলশানের বিভিন্ন আয়না ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আগের তুলনায় গৃহসজ্জায় আয়নার ব্যবহার বাড়ছে।
গুলশান ১ নম্বর এলাকার ডিসিসি মার্কেটে 'সজল আয়না ঘরের' স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার বলেন, এখন বিভিন্ন বাড়ি ও ফ্লাটের ওয়েটিংরুম, ড্রয়িংরুম সাজানোর আয়না ব্যবহারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে এ সংক্রান্ত ব্যবসাও বাড়ছে।
তিনি বলেন, "সাধারণত আয়নার চারপাশে নানা ধরনের ডিজাইনযুক্ত করে এসব রুমের ওয়ালে বসানো হয়। আয়নার পার্শ্বে ডিজাইন করার জন্য নানা ধরনের ধাতব, প্লাস্টিক ফাইবার, বাঁশ ও বেত ব্যবহার করা হয়।"
মহামারিকালীন সময়েও গত বছর এবং এ বছর তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার আয়না বিক্রি করেছে বলে জানান প্রদীপ কুমার। আগের চেয়ে এ ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আয়নার অনলাইন বাজার
শুধু শোরুম বা শপিংমলগুলোতেই আয়নার বাজার নয়, অনলাইনেও এখন আয়না বিক্রির পরিধি বাড়ছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৬টি অনলাইন শপ আয়না বিক্রি করে থাকে। এর মধ্যে 'আজকের ডিল ডট কম' নামের অনলাইন শপটি উল্লেখযোগ্য।
এর একজন কর্মকর্তা জানান, আজকের ডিল ওয়াল ও নকশা করা ১৬ রকমের আয়না বিক্রি করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য ৪ ধরনের ফুলভিউ মিরর, ৫ ধরনের ফুলভিউ মিরর লার্জ, ৫ ধরনের কাঠের তৈরি ওয়াল মিরর।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন রকম আয়না বিক্রি হয়ে থাকে।
এছাড়া প্রতিটি অনলাইন শপে কনভেক্স মিরর, কনকেভ মিররসহ সকল ধরনের আয়না পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, "আয়নার এ রকম বাজার একসময় কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু মানুষের জীবনমান বদলের সাথে সাথে আয়নাও একটি অপরিহার্য বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আধুনিকায়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আয়নার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও দেশের অর্থনীতিতে আয়নার বাজার বেশ ভালো ভূমিকা রাখছে।"
ভালো খবর হলো, আয়না উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বনির্ভর। এই স্বনির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে আয়না রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।