এমআরটি-৬ প্রকল্পের ব্যয় কমল ৭৫৪ কোটি টাকা, সময়সীমা বাড়ল ২০২৮ সাল পর্যন্ত
অনুমোদনের এক দশকেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো খরচ কমছে এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের। তৃতীয় সংশোধন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭৫৪ কোটি টাকা কমিয়েছে এবং সময়সীমা বাড়িয়েছে ২০২৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এমআরটি লাইন–৬ দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প। এর ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশটি ইতোমধ্যেই চালু রয়েছে, আর ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটারের মতিঝিল–কমলাপুর অংশ সম্প্রসারণের কাজ চলছে।
লাইনটি ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্বোধন করা হয়, তখন এটি উত্তরার থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল করত। পরে ২০২৩ সালের শেষে মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশন যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি গতকাল সংশোধিত প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। এখন এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আসন্ন বৈঠকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাছে পাঠানো হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)–এর তথ্যানুযায়ী, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশের নির্মাণকাজ আগামী ১৮ মাসের মধ্যে শেষ হবে। এই অংশে ট্রেন চলাচল শুরু হবে ২০২৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। এর পরবর্তী ১৮ মাস ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিজনিত দায়ভারের সময় (ডিফেক্ট লাইয়াবিলিটি পিরিয়ড) হিসেবে গণ্য হবে।
যেভাবে বদলে গেল খরচের পরিমাণ
প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী, এমআরটি-৬ প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১,৯৮৫.০৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৬,৫৯৪.৫৯ কোটি টাকা ছিল জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ। প্রকল্পটির প্রাথমিক বাস্তবায়ন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত।
২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পের প্রথম সংশোধন অনুমোদিত হয়, তবে তাতে ব্যয় পরিবর্তন করা হয়নি। পরে প্রকল্পটি আরও ১.১৬ কিলোমিটার বাড়িয়ে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়, এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩,৪৭১.৯৯ কোটি টাকা এবং সময়সীমা বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই দ্বিতীয় সংশোধন ২০২২ সালের ১৯ জুলাই অনুমোদন দেয় একনেক।
তৃতীয় প্রস্তাবিত সংশোধনে, আগের তুলনায় ব্যয় ৭৫৪ কোটি টাকা বা ২.৯৫ শতাংশ কমিয়ে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২,৭১৭.৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২,৫২১.৯৬ কোটি টাকা আসবে সরকারি অর্থায়ন থেকে এবং ২০,১৯৫.৭৬ কোটি টাকা জাইকার ঋণ হিসেবে।
এমআরটি-৬ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল ওহাব বলেন, "কিছু খাতে ব্যয় কমেছে—বিশেষ করে ভূমি অধিগ্রহণে—তবে পরামর্শক ফি ও কয়েকটি প্রযুক্তিগত খাতে ব্যয় বেড়েছে। সব সমন্বয় শেষে মোট ব্যয় ৭৫৪ কোটি টাকা কমে গেছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, মতিঝিল-কমলাপুর অংশের চলমান কাজের কারণেই প্রকল্পের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
কোন খাতে ব্যয় কমেছে
সর্বশেষ সংশোধনে প্রকল্পের বেশ কয়েকটি খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় কমেছে ১,২১১.৭২ কোটি টাকা, কারণ বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মতিঝিল স্টেশনের প্রবেশ ও প্রস্থান কাঠামোর জন্য অতিরিক্ত ৩.৫৬ হেক্টর জমি আর প্রয়োজন হয়নি।
উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য, আগারগাঁও ও মতিঝিল স্টেশনে প্রস্তাবিত স্টেশন প্লাজা নির্মাণ বাতিল করায় আরও ১৬৪ কোটি টাকা ব্যয় কমেছে।
এছাড়া মূল লাইন, সিভিল ও স্টেশন নির্মাণে ১১৬ কোটি টাকা, ইলেকট্রিক ও মেকানিক্যাল (ইঅ্যান্ডএম) রেলওয়ে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ৯০.৪৫ কোটি টাকা, এবং পুনর্বাসন পরামর্শ সেবায় ২.৯৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
ব্যয় বাড়ল কোন খাতে
এদিকে, প্রকল্পের সময়সীমা বাড়ানো এবং নকশা সংশোধনের কারণে কয়েকটি খাতে ব্যয় বেড়েছে। বেতন, ভাতা ও অফিস ভাড়ায় ব্যয় বেড়েছে ১৬৭ কোটি টাকা, আর সাধারণ পরামর্শ সেবা (জেনারেল কনসালটেন্সি সার্ভিস) ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন খাতে বেড়েছে আরও ২২২.২৫ কোটি টাকা।
বিদেশি ঋণ পরিশোধ—যার মধ্যে মূলধন ও নির্মাণকালীন সুদ অন্তর্ভুক্ত—বেড়েছে ২৭০ কোটি টাকা। রোলিং স্টক ও সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্যয় বেড়েছে আরও ৫৬১.১৭ কোটি টাকা।
এছাড়া আরও কিছু ছোটখাটো খাতে অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হয়েছে, যা মোট প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
সব মেট্রো প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করছে সরকার
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, বিদেশি ঋণের চাপ এড়াতে সরকার বর্তমানে সব মেট্রো প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করছে।
তিনি বলেন, "দুইভাবে ব্যয় কমানো হচ্ছে—প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র নিশ্চিত করে এবং অপ্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দিয়ে। যেমন–কমলাপুর থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর পর্যন্ত বিদ্যুতায়ন ও সিগন্যালিংয়ের যে খরচ, তা ঠিকাদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তিন ধাপে ১৭০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, নকশা পরিবর্তন, ডিপোর সংখ্যা যৌক্তিকভাবে কমানো এবং স্টেশন প্লাজা–এর মতো কিছু অবকাঠামো বাতিল করার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব হয়েছে।
