ঢাকার সড়কে আবারও জ্বলছে ট্রাফিক বাতি; শৃঙ্খলা ফিরছে, তবে সিগন্যাল মানায় এখনো অনীহা চালকদের
ঢাকার দীর্ঘদিনের যানজটে সম্প্রতি কিছুটা শৃঙ্খলার ইঙ্গিত মিলছে। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে আবারও চালু হয়েছে ট্রাফিক সিগন্যাল, নতুন ডাইভারশনেও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে যান চলাচল—তবুও পুরোনো অভ্যাস, সিগন্যাল অমান্য করা, যেন সহজে কাটতে চাইছে না।
চলতি বছরের আগস্ট থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ৬৯টি মোড়ে ডাইভারসনের মাধ্যমে নতুনভাবে যান চলাচলের ব্যবস্থা করেছে। সহজ ও ব্যয়বিহীন এসব ডাইভারশন বাস্তবায়নের পরই এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে রাজধানীর সড়কগুলোতে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রযুক্তিগত সহায়তায় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) রাজধানীর ৭টি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে আধা–স্বয়ংক্রিয় (সেমি-অটোমেটিক) ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করেছে।
পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটি চালু করা হয়েছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, সোনারগাঁও (কারওয়ান বাজার), ফার্মগেট, বিজয় সরণি, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এবং জাহাঙ্গীর গেটে।
প্রাথমিক ফলাফলে ঢাকার যানজটে একটুখানি আশার আলো দেখা যাচ্ছে। দুই কোটিরও বেশি জনসংখ্যা ও প্রায় ১২ লাখ নিবন্ধিত যানবাহনের এই মহানগরে সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাবদ্ধ সড়ক ও যানজটমুক্ত চলাচল এখনো দুরূহ হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি একটি ইতিবাচক সূচনা।
আধা–স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী অপারেটররা ম্যানুয়ালি সিগন্যালের সময়সীমা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। চালক ও ট্রাফিক পুলিশের মতে, নতুন এই সিগন্যাল ব্যবস্থায় নির্ধারিত মোড়গুলোতে যানজট অনেকটাই কমেছে—তবে চালকদের আচরণ বদলানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আয়াত পরিবহনের চালক মনির হাসান বলেন, "আগের তুলনায় এখন যানজট অনেক কম। আমরা আগের চেয়ে দ্রুত মোড়গুলো পার হতে পারছি। কিন্তু এখনো সিগন্যালের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারছি না। ট্রাফিক পুলিশ হাত না নাড়লে বেশিরভাগ চালকই সবুজ বাতি জ্বলেও এগোতে দ্বিধা করেন।"
বিজয় সরণি মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট সোহেল রানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সড়কে শৃঙ্খলা কিছুটা ফিরেছে, কিন্তু এখনো চালকরা সামনে কেউ না থাকলে থামতে চান না। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হলেও আগের মতোই সমান সংখ্যক পুলিশ সদস্য দরকার হচ্ছে। মানুষের অভ্যাস না বদলালে এই পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়তা কার্যকর হবে না।"
তিনি জানান, বিজয় সরণির সিগন্যাল সাইকেলে দক্ষিণ লেনের জন্য ৮০ সেকেন্ড এবং উত্তর ও পশ্চিম লেনের জন্য ৫০ সেকেন্ড করে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। "এখন আর কাউকে ৩ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না—আগে যেখানে ৮ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত লাগত।"
প্রযুক্তির সহায়তা মিলছে, তবু অভ্যাস বদলায়নি
রোববার (২৬ অক্টোবর) সকালে মোটরসাইকেল আরোহী শফিকুল ইসলাম ফার্মগেট থেকে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলেন। কারওয়ান বাজার মোড়ে পৌঁছালে সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলে উঠলে তিনি থিম যান—কিন্তু আশপাশের বেশিরভাগ যানবাহন সিগন্যাল অমান্য করে চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এক ট্রাফিক পুলিশকে হাতের ইশারায় গাড়িগুলো থামাতে হয়।
শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ভাবছিলাম নতুন সিগন্যাল ব্যবস্থা আসলে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে, ট্রাফিক পুলিশের ওপর চাপও কমবে। কিন্তু আগের মতোই মনে হচ্ছে। আমার যারা নিয়ম মেনে থামি, তাদেরই উল্টো বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়।"
কারওয়ান বাজারে দায়িত্বে থাকা একজন ট্রাফিক কনস্টেবল বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "নতুন সিস্টেমে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে, তবে বেশিরভাগ চালকই সিগন্যাল মানছেন না। আমাদের এখনও গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।"
ট্রাফিক সিগন্যাল প্রকল্প নিয়ে কী বলছে কর্তৃপক্ষ
নতুন ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রতিটি মোড়ে ছোট কন্ট্রোল বুথ স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে একজন কন্ট্রোলার, ট্রাফিক পুলিশ সদস্য এবং বুয়েটের টেকনিশিয়ান দায়িত্বে রয়েছেন। যানবাহনের চাপ অনুযায়ী এসব সিগন্যাল অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিয়) বা ম্যানুয়ালি—দুইভাবেই পরিচালনা করা যায়।
বুয়েটের প্রশিক্ষণে ডিএমপি সদস্যরা এই সিস্টেম পরিচালনা শিখেছেন। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে লিফলেট বিতরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। পুরো উদ্যোগটি ধাপে ধাপে হাইকোর্ট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২৩টি মোড়জুড়ে সম্প্রসারিত হবে। প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এই ব্যয় যৌথভাবে বহন করছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক (ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান, ট্রাফিক ও ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার) মো. রাবিউল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঢাকায় অতীতে বেশ কয়েকবার ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে সেগুলো ব্যর্থ হয়। এবার আমরা ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। মানুষের অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে—আমরা সিটি করপোরেশন ও ডিএমপির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি।"
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের আওতাধীন পাঁচটি মোড়ে সিগন্যাল স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে, আরও দশটি মোড়ে কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। ফেন্সিং, ফুটপাত সংস্কার ও সংশ্লিষ্ট কাজে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাজিব খালেদ বলেন, "আমাদের এলাকায় দুটি সিগন্যাল চালু রয়েছে, আরও ছয়টি স্থাপনের কাজ চলছে। এবার আমরা স্থানীয়ভাবে তৈরি প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এতে ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে এবং সুফলও দেখা যাচ্ছে।"
তারা আশা করছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে বাকি ১৬টি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হবে। একই সঙ্গে সচেতনতা কার্যক্রমেও জোর দেওয়া হয়েছে; লিফলেট বিতরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণার কাজ চলছে।
সিগন্যালের সুফল মিললেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া বাকি
যানজট কিছুটা কমলেও জনশৃঙ্খলার অভাব এখনো প্রযুক্তিগত এই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আফ্রিকার অনেক দেশ আমাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও তারা সিগন্যাল ব্যবস্থার মাধ্যমে সফলভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। আমাদের ব্যর্থতা হলো, এখানে আগে এমন ব্যবস্থা চালু করা হয়নি।"
তিনি বলেন, "এখন যে সিস্টেম চালু হচ্ছে, তা ধীরে ধীরে দুই–তিন বছরের মধ্যে আরও উন্নত করা সম্ভব। একই সঙ্গে যারা সিগন্যাল অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।"
"যদি নির্ধারিত স্থানে বাসগুলোর পার্কিং সীমাবদ্ধ রাখা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং সড়ক ও ফুটপাত হকারমুক্ত করা যায়, তাহলে এই সিগন্যাল ব্যবস্থা বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে। ঢাকায় অন্তত ১০০টি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আছে—এর মধ্যে ধাপে ধাপে ৫০টিতে কার্যকর ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করা গেলে সড়কে বহুল আকাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে," যোগ করেন তিনি।
মোয়াজ্জেম হোসেন আরও বলেন, "ভুল বাস্তবায়ন, অনুপযুক্ত সমাধান বেছে নেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহনের কারণে অতীতের বেশিরভাগ প্রকল্পই ছিল অর্থের অপচয়—যার কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমান প্রকল্পটি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে এটি সফল হতে পারে।"
২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ ট্রাফিক সিগন্যাল প্রকল্পে ১৫০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে। এসব সিগন্যাল শেষে কেবল অলঙ্কারস্বরূপ খুঁটিতে পরিণত হয়েছে—চালকরা নিয়মিত লাল বাতি উপেক্ষা করেছেন, আর ট্রাফিক পুলিশকে আবারও হাতের ইশারায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস ঢাকার ট্রাফিক সংকটের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকেই নতুন সিগন্যাল বাতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—যা এবার স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত এবং আগের তুলনায় অনেক কম ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
১৯৮০–এর দশকের শেষ দিকেও শাহবাগসহ ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর ছিল। লাল বাতি জ্বললে যানবাহন থেমে যেত, পথচারীরাও নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারতেন। পরবর্তীতে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আধুনিক ও কার্যকর করতে সিগন্যাল ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তি যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে শত কোটি টাকার সেই প্রকল্পগুলো শেষ পর্যন্ত সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
