মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সবার প্রতি আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিতের আহ্বান টিআইবির

পতিত স্বৈরশাসনামলে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের সেনা হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্তটি সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং আইনের সমান প্রয়োগের মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের অন্য অভিযুক্তদের থেকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করার পেছনের যুক্তি ও কারণ সরকারকে ব্যাখ্যা করার আহ্বান জানিয়েছে। সেই সঙ্গে 'আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান'—এই মৌলিক নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে, সংস্থাটি এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'একই অভিযোগে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে পরিচয় বা পদমর্যাদার ভিত্তিতে বৈষম্য কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার প্রক্রিয়ায় পেশাগত পরিচয় বা পদমর্যাদা বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। কাউকে এভাবে বিশেষ সুবিধা দেওয়া বা বিবেচনা করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। অন্য অভিযুক্তরা যদি প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বেসামরিক হেফাজতে থাকতে পারেন, তাহলে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষায়িত সাবজেলের যৌক্তিকতা কী?'
'তাহলে কি সরকার রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় খাতের অভিযুক্তদের যত ধরনের পেশাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় রয়েছে, তত ধরনের সাবজেল চালু করবে?'- প্রশ্ন রাখেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে, বিশেষ করে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে সামান্যতম সন্দেহেরও যেন কোনো অবকাশ না থাকে, তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।'
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, 'বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে 'আইনের দৃষ্টিতে সমতা'র কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতি অনুসারে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিই বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী নন—এটি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। অধিকন্তু, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সনদের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে (অফিসিয়াল পদের অপ্রাসঙ্গিকতা) স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক বা সামরিক পদের কারণে কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি দায় থেকে অব্যাহতি পাবেন না বা আইনি প্রক্রিয়ায় বিশেষ কোনো সুবিধা পাবেন না। একইভাবে, নুরেমবার্গ নীতিমালার ৩ নম্বর নীতি—যা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি—প্রতিষ্ঠা করে যে, সরকারি পদ বা দায়িত্বকে দায়মুক্তির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। সংশ্লিষ্ট জাতীয় সামরিক আইনে যা-ই বলা থাকুক না কেন, তা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।'
এছাড়া, বাংলাদেশ গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ (ICPPED) স্বাক্ষরকারী দেশ, যা জাতিসংঘের একটি সনদ এবং এর অধীনে সরকার ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। টিআইবি মনে করে, এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের পেশাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়, পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'কিছু ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অভিযুক্তকে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল, যা আমরা একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত বলে মনে করি। সেই ব্যক্তি বর্তমানে বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে আটক আছেন। কাজেই, অন্য অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তাদের সামরিক হেফাজতে থাকার প্রয়োজন কেন? সামরিক কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। এ ধরনের খামখেয়ালি আচরণ ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'গুম, হত্যা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের জবাবদিহি যেন সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি মেনে নিশ্চিত করা হয়, তা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।'