নওগাঁয় ৪ হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যের সম্ভাবনা, দিনাজপুরের আম যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে

আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নওগাঁ আম উৎপাদনে দারুণ সাফল্য অর্জন করছে। সুমিষ্ট ও সুস্বাদু হওয়ায় নওগাঁর আমের চাষাবাদ ও চাহিদা উভয়ই বাড়ছে, বাড়ছে আমের বাণিজ্যিক অর্থনীতির পরিসরও। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর জেলায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আম উৎপাদনে এখনো আধিপত্য ধরে রেখেছে রাজশাহী অঞ্চলের জেলাগুলো। দেশের মোট আম উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকই হয় রাজশাহীসহ আশপাশের চার জেলায়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৪ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
মৌসুমে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নওগাঁ। গত বছরের তুলনায় ৩০০ হেক্টর জমি বেড়ে এ বছর জেলায় আম চাষ হয়েছে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। এরপর রাজশাহী জেলায় ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৩ মেট্রিক টন এবং নাটোরে ১ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সে হিসাবে, রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে চার জেলায় এবারের আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। গত মৌসুমে এই চার জেলায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫০৬ মেট্রিক টন। এ থেকে স্পষ্ট, বরেন্দ্র অঞ্চলে আমের আবাদ ও উৎপাদন উভয়ই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নওগাঁয় আম চাষ হয়েছিল ১২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে। সে তুলনায় গত ১০ বছরে আম চাষ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিনগুণে। চলতি মৌসুমেও এ প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার উৎপাদিত আমের প্রায় ৭০ শতাংশই আম্রপালি জাতের। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে বারি-৪ জাতের আম, যার চাহিদাও ব্যাপক। এছাড়াও ল্যাংড়া, গৌড়মতি, আশ্বিনা, হিমসাগর, গোপালভোগ ও কাটিমন জাতের আম চাষ হয় এ জেলায়।
আমের মান বজায় রাখতে আগে থেকেই সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২২ মে গুটি ও ৩০ মে গোপালভোগ জাতের আম সংগ্রহ শুরু হয়। ক্ষীরশাপাতি ও হিমসাগর ২ জুন, নাগ ফজলি ৫ জুন, ল্যাংড়া ও হাঁড়িভাঙ্গা ১০ জুন, ব্যানানা ম্যাংগো ও ফজলি ২৫ জুন, আম্রপালি ১৮ জুন এবং আশ্বিনা, বারি-৪ ও গৌড়মতি জাতের আম ১০ জুলাই থেকে সংগ্রহের সময় নির্ধারিত হয়েছে।
নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আমচাষী রমজান আলী জানান, আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। এখন দম ফেলারও সময় নেই। তবে গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা কম।
পত্নীতলা উপজেলার উত্তরামপুর গ্রামের আমচাষী আমিনুল ইসলাম বলেন, আগে আমাদের অঞ্চলে ধান প্রধান ফসল ছিল, এখন তা বদলে গেছে। এখন আমাদের অর্থনীতি আমের ওপর নির্ভর করে। আবহাওয়া ও দাম ঠিক থাকলে আমচাষে ভালো লাভ হয়। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতিও সন্তোষজনক।
সাপাহার বাজারে আজ পতি মণ আম্রপলি ১ হাজার ৩০০ থেকে ৫ হাজার টাকা, বারি-৪ জাতের আম ১ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ফজলি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ২ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং হাঁড়িভাঙা আম ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সাপাহারের আমচাষী ও ব্যবসায়ী রাকিব হোসেন বলেন, তিনি এবার ১৪ বিঘা জমিতে আমের আবাদ করেছেন। ঈদের পর কিছুটা দাম কম থাকলেও এখন বাজার ভালো। এভাবে থাকলে চাষীরা লাভবান হবেন। আমাদের এলাকার মানুষ এখন আমের ওপরই নির্ভরশীল।
প্রতি বছর আমকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে জানিয়ে সাপাহার উপজেলা আম আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত ব্যবসায়ী আসেন এখানে। এবার নওগাঁর আমের আকারও বড় হয়েছে, দামও ভালো পাচ্ছেন চাষীরা। আমচাষকে ঘিরেই এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আম সংগ্রহ, পরিবহন, মজুত, চালান ও প্যাকেজিংসহ আমকেন্দ্রীক কর্মকাণ্ডে নওগাঁয় অন্তত ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
মাটি ও জলবায়ুর কারণে নওগাঁর আম অতিরিক্ত সুস্বাদু উল্লেখ করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট থাকায় অন্যান্য ফসলের চাষ কমছে। ফলে প্রতি বছর আমবাগানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। চলতি বছর আমের সম্ভাব্য বাণিজ্য মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত।
দিনাজপুরের বাগান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে
এবার দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জের বাগান থেকে সরাসরি আম যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। বগুড়ার প্রবাসী বাংলাদেশি আব্দুল্লাহ মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজন.কম নামের এক অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এ ব্যবসা শুরু করেছেন। দেশে থেকে দিনাজপুরের বাগানের আম সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছেন হেদায়েতুল ইসলাম।
তিনি জানান, প্রথবারের মতো এবার যুক্তরাষ্ট্রে আম্রপালি জাতের আম পাঠানো হচ্ছে। এটি প্রথম চালান। পর্যায়ক্রমে আরও পাঠানো হবে। প্রাবাসী বাংলাদেশিই শুধু নন, এ আমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বাজার তৈরিই আমাদের উদ্দেশ্য। আগামীতে আরও অন্যান্য দেশীয় পণ্য বিশ্বের নানান দেশে পাঠানো হবে।