রাজধানীর জন্য বৈদ্যুতিক বাস: দুই বছরে ব্যয় হবে ২,৫০০ কোটি টাকা

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২,৫০০ কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার; যার আওতায়, রাজধানী ঢাকায় ৪০০টি বৈদ্যুতিক বাস চালু করা হবে। বায়ুদূষণের ভয়াবহ সংকটে জর্জরিত বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর ঢাকার—শ্বাসরোধকারী পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বর্তমানে গণপরিবহনে আধিপত্য বিস্তার করা পুরনো, ডিজেলচালিত বাসবহর ধাপে ধাপে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নেতৃত্বে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের সম্পদ ব্যবস্থাপনা করবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইডকল। নতুন বৈদ্যুতিক বাসগুলো বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোর কাছে লিজে দেওয়া হবে, যাদের নির্বাচন করা হবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। আগের ব্যর্থ গণপরিবহন প্রকল্পের মতো রাজনৈতিক প্রভাব ও অদক্ষতা এড়াতেই এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে।
ডিটিসিএ'র উপ-পরিবহন পরিকল্পনাবিদ ও প্রকল্প পরিচালক ধ্রুব আলম বলেন, "আমরা ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেয়েছি। আশা করছি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একনেকের অনুমোদনও মিলবে। অনুমোদন পেলে পাঁচ বছরের প্রকল্পের দুই বছরের মধ্যেই বাসগুলো সড়কে নামবে।"
প্রাথমিক পরিকল্পনার মধ্যে আছে, বৈদ্যুতিক বাসের জন্য পূর্বাচল ও কাঁচপুরে দুটি চার্জিং ডিপো স্থাপন করা। বাসগুলো দুই বা তিনটি নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করবে।
নীতিগত প্রতিবন্ধকতা: বৈদ্যুতিক বাসের পথে বড় চ্যালেঞ্জ
এই উদ্যোগ কাগজে-কলমে আশাব্যঞ্জক মনে হলেও, বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যাপক প্রসারে নীতিগত জটিলতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, বৈদ্যুতিক বাসের একটি বহর শুধু চালু করলেই চলবে না। উচ্চ ব্যয়বহুল এই প্রকল্পকে একটি ব্যর্থ উদাহরণে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে— পরিবহন নীতিতে ব্যাপক সংস্কার, পরিবহন অপারেটরদের জন্য যথাযথ প্রণোদনা এবং ইভি চার্জিং-এর জন্য শক্তিশালী বিদ্যুৎ অবকাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য।
অতীতের ব্যর্থতা, নতুন প্রত্যাশা
এ প্রকল্পের আগে বাংলাদেশে একাধিক বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে বৈদ্যুতিক বাস সংযোজনের পরিকল্পনা ডিপোর নকশাগত ভুলের কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। একইভাবে, ভারত থেকে ১৫০টি বৈদ্যুতিক বাস আমদানির পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। বিআরটিসি বর্তমানে মাত্র ১২টি ইলেকট্রিক বাস কেনার চেষ্টা করছে।
তবে বিআরটির পরিচালক সীতাংশু কুমার বিশ্বাস মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রচেষ্টাকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছে, তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা ও অধিক পরিকল্পিত উদ্যোগের কারণে এবারের প্রচেষ্টা আগের ব্যর্থতা থেকে আলাদা।
"ইভি নিয়ে এখনও আন্তরিক নয় বাংলাদেশ" – বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
যদিও নতুন প্রকল্প ঘোষণা হয়েছে, তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও শক্তিশালী, ইভি-বান্ধব নীতিমালার ঘাটতি রয়েছে।
জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর গাড়িকে এখনো বেশি সুবিধা দেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি বলেন, "সবচেয়ে ক্ষতিকর দূষণ সৃষ্টি করছে ডিজেলচালিত বাণিজ্যিক যানবাহন। অথচ চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশ ইভি বা বৈদ্যুতিক যানকে জাতীয় অগ্রাধিকারে নিয়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশ তো অনেক পিছিয়ে।"
তিনি বলেন, "এ অর্থবছরের বাজেটে অবশেষে ইভি ও ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলারের উৎপাদনে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা আগে শুধু জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত গাড়ির জন্য ছিল। তবে এটি অনেক দেরিতে এসেছে, যা আরও আগেই নেওয়া দরকার ছিল।"
শামসুল হক আরও বলেন, "সরকার নিজে কিছু ইভি কিনলে বাজার পরিবর্তন হবে না। বেসরকারি খাত যেন গ্রিন মোবিলিটিতে (দূষণমুক্ত যানবাহনে) মুনাফা দেখতে পায়, সে জন্য উপযুক্ত নীতিমালা থাকা জরুরি।"
আমদানি শুল্ক বৈষম্যের ধাক্কায় ব্যাহত অগ্রগতি
অধ্যাপক শামসুল হক উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ডিজেলচালিত বাস আমদানিতে ১৫–৩৭ শতাংশ শুল্ক থাকলেও – বৈদ্যুতিক বাস আমদানিতে শুল্ক ৫৮ শতাংশেরও বেশি। যা ইভি গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, "এত উচ্চ শুল্ক দিয়ে কোনো উদ্যোক্তা কেন ইভি আমদানি করবে? আমদানি, রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে চার্জিং অবকাঠামো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই ইভিকে (জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহনের চেয়ে) অগ্রাধিকার দিতে হবে।"
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এই নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া, সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ ইভি ব্যবহারের লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।
দেশীয় শিল্প প্রস্তুত, চায় সঠিক প্রণোদনা
নীতিগত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশের অটোমোবাইল শিল্প ইভি উৎপাদনে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবীর জানান, তাঁর কোম্পানি মীরসরাইয়ে একাধিক হালকা বাণিজ্যিক ইভি তৈরি করেছে, এবং দেশব্যাপী চার্জিং নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক এক্ষেত্রে সিএনজি থ্রি-হুইলারের শুরুর দিকের উদাহরণ টেনে বলেন, "শুরুতে সরকার শুধু কয়েকটি রিফুয়েলিং স্টেশন দিয়েছিল, পরে বেসরকারি খাত বুঝতে পেরেছিল যে এটি লাভজনক। তখনই দ্রুত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হয়েছে।"
তিনি বলেন, "বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) ক্ষেত্রেও একই পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব, তবে এর জন্য বেসরকারি খাতকে সঠিক সুযোগ বা প্রণোদনা দিতে হবে।"
ঢাকার ভয়াবহ বায়ু দূষণ সংকট
বিশ্বব্যাংকের 'বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্ট'-এর মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে বায়ুদূষণের অন্যতম সংকটাপন্ন দেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় দূষণের মাত্রা বছরের সব সময়ই জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক পর্যায়ে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি ও হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চলের (আইজিপি-এইচএফ) অংশ, যা বৈশ্বিক বায়ুদূষণের হটস্পট। বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) গড় মাত্রা ৬০ থেকে ১০০ মাইক্রোগ্রাম, আর ঢাকায় এটি ৯০ থেকে ১০০ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মানের ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি।
২০১৯ সালে অতিমাত্রায় পিএম ২.৫ এর কারণে দেশে ১ লাখ ৫৯ হাজারের বেশি অকাল মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সব প্রভাবিতদের মিলিয়ে ২৫০ কোটি দিন অসুস্থতায় অতিবাহিত হয়েছে। এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দেশের মোট জিডিপির ৮.৩ শতাংশ। এই বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী—যাদের মধ্যে দরিদ্র জনগণ, নারী, প্রবীণ এবং পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা সবচেয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত পরিবহন খাতে দূষণমুক্ত প্রযুক্তি চালু না করলে বায়ু দূষণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশে ৩৫৫ মিলিয়ন ডলারের 'বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্ট' ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বিআরটিএ, ডিটিসিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তর। এর আওতায় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ ও পরিবহন খাত থেকে নির্গমন কমানোর কাজ করা হবে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াও, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের নগরগুলোর বাসযোগ্যতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে—বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহর কেবল শীতকালে নয়, বরং বছরজুড়েই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, দ্রুততর সময়ে পরিবহন খাতে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে রূপান্তর না ঘটালে—দেশের বায়ুমানের আরও অবনতি ঘটবে, যার ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সংকট আরও গভীর হবে।
এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশে ৩৫৫ মিলিয়ন ডলারের 'বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্ট' বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ২৯০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ২০২৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িতব্য এই প্রকল্পটি পরিচালনা করবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকা পরিবহন সমম্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এবং পরিবেশ অধিদফতর। প্রকল্পটির লক্ষ্য হচ্ছে বায়ু মান ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং পরিবহনখাতে নির্গমন হ্রাস করা।